আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পতিসর ।। ৩০ ভাদ্র, ১৮৯৩

বাঙলা কবিতা

এবার এই বিলের পথ দিয়ে কালীগ্রামে আসতে আসতে আমার মাথায় একটি ভাব বেশ পরিষ্কার রূপে ফুটে উঠেছে। কথাটা নতুন নয়, অনেকদিন থেকেই জানি, কিন্তু তবু এক-একবার পুরনো কথাও নতুন করে অনুভব করা যায়। দুইদিকে দুই তীর দিয়ে সীমাবদ্ধ না থাকলে জলস্রোতের তেমন শোভা থাকে না। অনির্দিষ্ট অনিয়ন্ত্রিত বিল একঘেঁয়ে, শোভাশূন্য। ভাষার পক্ষে ছন্দের বাঁধন ঐ শোভার কাজ করে।

ভাষাকে একটি বিশেষ আকার এবং বিশেষ শোভা দেয়, তার একটি সুন্দর চেহারা ফুটে ওঠে। তীরবদ্ধ নদীগুলির যেমন একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব আছে, তাদের যেমন এক-একটি স্বতন্ত্র লোকের মতো মনে হয়, ছন্দের দ্বারা কবিতা সেইরূপ এক-একটি মূর্তিমান অস্তিত্বের মতো দাঁড়িয়ে যায়। গদ্যের সেইরকম সুনির্দিষ্ট স্বাতন্ত্র্য নেই, সে একটা বৃহৎ বিশেষত্বহীন বিলের মতো। আবার তটের দ্বারা আবদ্ধ হওয়াতেই নদীর মধ্যে একটা বেগ আছে, একটা গতি আছে; কিন্তু প্রবাহহীন বিল কেবল বিস্তৃতভাবে দিগ্- বিদিক গ্রাস করে পড়ে থাকে। ভাষার মধ্যেও যদি একটা আবেগ, একটা গতি দেবার প্রয়োজন হয় তবে তাকে ছন্দের সংকীর্ণতার মধ্যে বেঁধে দিতে হয়; নইলে সে কেবল ব্যপ্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু সমস্ত বল নিয়ে একদিকে ধাবিত হতে পারে না।

বিলের জলকে পল্লি-গ্রামের লোকেরা বলে বোবা জল; তার কোনো ভাষা নেই, আত্ম-প্রকাশ নেই। তটবদ্ধ নদীর মধ্যে সর্বদা একটা কলধ্বনি শোনা যায়; ছন্দের মধ্যে বেঁধে দিলে কথাগুলোও সেইরকম পরস্পরের প্রতি আঘাত সংঘাত করে একটা সংগীতের সৃষ্টি করতে থাকে___ সেই জন্য ছন্দের ভাষা বোবা ভাষা নয়, তার মুখে সর্বদাই কলগান। বাঁধনের মধ্যে থাকাতেই গতির সৌন্দর্য, ধ্বনির সৌন্দর্য এবং আকারের সৌন্দর্য। বাঁধনের মধ্যে থাকাতে যেমন সৌন্দর্য তেমনি শক্তি। কবিতা যে স্বভাবতই ধীরে ধীরে একটি ছন্দের মধ্যে ধরা দিয়ে আপনাকে পরিস্ফুট করে তুলেছে ওটা একটা কৃত্রিম অভ্যাসজাত সুখ দেবার জন্য নয়, ওর একটি গভীর স্বাভাবিক সুখ আছে।

অনেক মূর্খ মনে করে কবিতার ছন্দোবদ্ধ কেবল একটা বাহাদুরী করা, ওতে কেবল সাধারণ লোকের বিস্ময় উৎপাদন করে সুখ দেয়, ও কেবল ভাষার ব্যায়াম মাত্র। কিন্তু, সে ভারি ভুল। কবিতার ছন্দ যে নিয়মে উৎপাদন হয়েছে, বিশ্বজগতের সমস্ত সৌন্দর্যই সেই নিয়মে সৃষ্ট হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট বন্ধনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মনের মধ্যে আঘাত করে বলেই সৌন্দর্যের এমন অনিবার্য শক্তি। আর সুষমার বন্ধন ছাড়িয়ে গেলেই সব একাকার হয়ে যায়, তার আর আঘাত করবার শক্তি থাকে না।

বিল ছাড়িয়ে যেমনি নদীতে এবং নদী ছাড়িয়ে যেমনি বিলে গিয়ে পড়ছিলুম, অমনি আমার মনে এই তত্ত্বটি দেদীপ্যমান হয়ে জেগে উঠছিল। ১. পত্র সংখ্য : ১০৯ ছিন্নপত্র । । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২. কালীগ্রাম ( কালিগঞ্জ কেই ভুলক্রমে তিনি কালিগ্রাম লিখেছেন, কালিগ্রাম যেতে কখনই নদী ও বিল পড়বার কথা নয়...) : নাটোরের সিংড়া থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী ও নওগাঁ জেলা সদর থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত সিংড়া থানার একটি গ্রাম, পতিসর এর লাগোয়া___ পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ি আছে; এখানেই কৃষিঋণ বিতরণার্থে স্থাপিত কো-অপারেটিভ ব্যাংকও স্থাপণ করেন কবি। ৩. কবি ভুলক্রমে কালিগ্রাম লিখলেও ওটা যে কালিগঞ্জ তার সপক্ষে অজস্র যুক্তি আছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।