আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাব্বালাহ: একুশ শতকে ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
নির্জনতা অন্যতম অনুষঙ্গ হওয়ায় প্রাচীনকালে মরমীবিদ্যার চর্চা হত নিভৃতে; লোকচক্ষুর আড়ালে। আধুনিক বিশ্বে মরমীবিদ্যার চর্চাও হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক-যেন মরমীবিদ্যার চর্চার সঙ্গে নির্জনতার কোনওরুপ সম্পর্ক নেই! ইহুদি ধর্মের মরমী শাখা কাব্বালাহও প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসনের শিকার। কাব্বালাহ চর্চার জন্য কুড়ি শতকের শেষের দিকে ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য কাব্বালাহ সেন্টার-একুশ শতকে পৌঁছে সেসব প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি চটকদার, ঝলমলে আর বিজ্ঞাপনপ্রবণ হয়ে উঠেছে।

সেসব সেন্টারে সাধারন কৌতূহলী মানুষ যেমন আসছে তেমনি আসছে বিশ্বমিডিয়ার সেলিব্রেটিগন। এই কিছুদিন আগে ম্যাডোনা, ব্রিটনি স্পিয়ার্স কাব্বালাহ সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। ম্যাডোনার বাঁ হাতের লাল রঙের সুতলির নাম রোইটি বিনডেলে। এটির গুরুত্ব আগে না-থাকলেও কুড়ি শতকে রোইটি বিনডেলে হয়ে উঠেছে কাব্বালাহর অন্যতম প্রতীক। আশ্চর্য এই-যে ওল্ড টেস্টামেন্টের ব্যাখ্যা-বয়ানের ওপর কাব্বালাহ গড়ে উঠেছে সেই ওল্ড টেস্টামেন্টেই হাতে লাল রঙের সুতলি পরা নিষেধ! একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল: কাব্বালাহ চর্চা করতে চাই।

ভালো। ভালো তো বললেন-কিন্তু, শিক্ষক কোথায় পাব? কাব্বালাহ চর্চার জন্য শিক্ষক খোঁজার দরকার নেই মানে? মানে, শিক্ষক সময়মতো চলে আসবে। এই ঘটনাটি হয়তো -আমাদের বর্তমান আধুনিক সময়ে নয়- অনেক কাল আগে ঘটেছিল। কেননা, এখন আর প্রশ্নটির গুরুত্ব নেই। নানা ভাষায় অসংখ্য পুস্তকাদি আছে।

তাছাড়া কাব্বালাহ চর্চা করার জন্য এখন কোচিং সেন্টারের মতন রীতিমতো কাব্বালাহ সেন্টার আছে। তবে কাব্বালাহ সেন্টারে নাম লেখানোর জন্য একটি শর্ত প্রযোজ্য। কি শর্ত? আপনার ব্যাঙ্কে প্রচুর ডলার থাকতে হবে। কেননা, একটু খোঁজ নিলে আপনি জানতে পারবেন কাব্বালাহ সেন্টার এর মালিক-মালকিনরা আর তাদের পোষা রাব্বিরা রিয়েলি রিয়েলি রিচ। রিচ হবে না কেন? খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাব্বালাহ সেন্টারের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কত জানেন? ৪ লক্ষ! কাব্বালাহ সেন্টার; লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া।

গত দু-হাজার বছরে বিবর্তিত হয়ে একুশ শতকে পৌঁছে কাব্বালাহ কী অবস্থায় আছে সেটি পর্যালোচনার আগে কাব্বালাহ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা সংক্ষেপে বলে নিই। কাব্বালাহ শব্দটি হিব্রু; শব্দটির মানে “গৃহিত ঐতিহ্য। ” ওল্ড টেস্টামেন্টের যে প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে স্বয়ং নবী মুসা উপস্থিত সেই প্রথম পাঁচটি অধ্যায়কে বলা হয় তোরাহ। তোরাহ শব্দটি হিব্রু; শব্দটির মানে “আইন। ” মূলধারার ইহুদিরা প্রত্যহ তোরাহ পাঠ করে।

তবেকাব্বালাহপন্থিরা তোরাহর লিখিত শব্দের লুক্কায়িত তাৎপর্য অনুসন্ধান করে। প্রাচীনকাল থেকেই কাব্বালাহ সাধকগন বিশ্বাস করে আসছেন যে- ঈশ্বর দশটি ‘বিকিরণ’ দ্বারা অলংকৃত। যার মধ্যে রয়েছে দয়া, শক্তি, প্রজ্ঞা ও মহিমা; এবং কাব্বালাহ চর্চার দ্বারা মানুষ ‘আননোয়াবল’ বা অজ্ঞাত বা জানা যায় না এমন ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে পারে। এটা করা যায় জোহার পাঠ করে। জোহার হল শিমোন বার য়োচাই নামে ২য় খ্রিস্টাব্দের ফিলিস্তিনের একজন রাব্বিকৃত তোরাহর তফসির বা টীকাভাষ্য।

অজ্ঞাত ঈশ্বরের কাছে জ্যোতিষ তথা সংখ্যাতত্ত্ব চর্চা করেও পৌঁছনো যায়। ইহুদিদের ঈশ্বরের অনেক নাম। তার একটি হল, ইলোহিম। হা-তেভা, এই হিব্র“ শব্দের অর্থ প্রকৃতি। কাব্বালাহ মতে, হা-তেভা (প্রকৃতি) এবং ইলোহিম (ঈশ্বর) এর নিউমেরিক ভ্যালু বা সংখ্যাতাত্ত্বিক মূল্য সমান ।

এর উপর ভিত্তি করে কাব্বালাহপন্থি জ্যোতিষগন দাবী করেন: ‘প্রকৃতিতে ঈশ্বরের উপস্থিতি রয়েছে। ’ প্রকৃতিতে যে ঈশ্বরের উপস্থিতি রয়েছে তা শেখানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য কাব্বালাহ সেন্টার। যেসব সেন্টারে উচ্চ ফিতে ভর্তি হতে হয়। তারা চটকদার লিফলেটও ছাপে। যে লিফলেটে লেখা থাকে...বর্তমান কালে অনেকেরই বিশ্বাস মানবসভ্যতার অগ্রগতি কানা গলিতে এসে ঠেকেছে।

বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক প্রগতির মাধম্যে সুখি জীবন সংক্রান্ত অতীতের আশা নৈরাশ্যের কালিমা লিপ্ত হয়েছে। আমরা দেখছি যে অসংখ্য মানুষ তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। একদা আমরা ভেবেছিলাম আমরা ভবিষ্যতের দিকে বিশাল লাফ দিয়েছি- বিশ্বাস করেছি আমরা যথেস্ট অগ্রগতি অর্জন করেছি কিন্তু এখন আমরা একটি দেওয়ালে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ... মানবজাতি আজ হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে; নেশা ও আত্মহত্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাক্তিমানুষ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ক্রমেই, সে তার অনুভূতিকে দমন করে নিজেকে ভোঁতা করে দিচ্ছে; অবশ হয়ে উঠতে তাদের মনন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসবাদ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়- যা বৈশ্বিক সঙ্কট।

এসবই একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। জীবনের মানে কি? কাব্বালাহ সেন্টার; নিউ ইয়র্ক জীবনের মানে কি? অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছেন। গত কুড়ি বছরের আধ্যাত্বিক ব্যাক্তিদের জীবন পর্যালোচনা করলেই আমরা এই সত্যের যথার্থতা টের পাই। ...(এখান থেকে লক্ষ করুন) ...বহু আগেই জোহার এ লিখিত হয়েছে ...বিংশ শতকের শেষে মানবজাতি আবার জীবনের মানে খুঁজতে শুরু করবে। এবং সেই প্রশ্নের উত্তর কাব্বালাহর প্রাচীন বিজ্ঞানে নিহিত এবং যা আমাদের সময়েই ( অর্থাৎ কুড়ি শতকে)কেবল উম্মোচিত হবে।

কেননা, আমাদের সময়টি অত্যন্ত জটিল! আর এই বিশেষ কারণেই প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান শতাব্দীর পর শতাব্দী লুক্কায়িত রয়েছে । ইতোপূর্বে মানুষ এর জন্য প্রস্তুত হয়নি, সে কারণেই প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান মানুষের প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞানের আবেদন নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাব্বালাহর ওপর লেখা বইগুলি অনেকেই পাঠ করছে ; আমাকে কাব্বালাহ কি দিতে পারে- এই ভেবে কৌতূহলী হয়ে উঠছে। যখন একজন মানুষ উপলব্দি করে - কাব্বালাহ জীবনের মানে সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়-তখন সে আর শাস্ত্রটিকে ভয় পায় না বরং অতি উৎসাহে শাস্ত্রটি চর্চা করতে থাকে ...অতীতে মানুষের ধারনা ছিল, কাব্বালাহ হল যাদুটোনা, অলৌকিকতা, লাল সুতা এবং পবিত্র জলের আদিখ্যেতা মাত্র- আজ এসব ধারনা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

আসলে ওসব মানসিক প্রপঞ্চ (সাইকোলজিক্যাল ফেনোমেনা) ছাড়া আর কিছুই না! ...সত্য ও অভ্রান্ত কাব্বালাহর জন্য মানুষের দাবী জোরদার হচ্ছে। মহৎ মহাবিশ্ব, শাশ্বত অস্তিত্ব ও উচ্চতর নিয়ন্ত্রকারী শক্তির প্রতি মানুষের কৌতূহল দিনে দিনে বাড়ছে। মানুষ জানতে চায় কেন আমাদের জীবন ও জগৎ ঠিক এই ভাবেই আমাদের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে; আর আমরা কোথা থেকে এসেছি-আমরা যাচ্ছিই বা কোথায়। আমাদের এই সময়ে পৃথিবীজুড়ে মানুষ এই সব হাজারও প্রশ্নে হয়ে উঠছে কৌতূহলী। এসব কারণেই কারণেই প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান-এর প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

মানুষের কাছে যখন জাগতিক অস্তিত্ব বিস্বাদ ও সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে- তখনই চেনা জগতের বাইরে মানুষের চোখ চলে যায় । কাজেই, মানুষ আজ প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান-এর জন্য প্রস্তুত। যারা সত্যি সত্যিই জীবনের মানে খুঁজতে চায়- প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান তাদের স্বাগত জানায়। আমাদের অস্তিত্বের উৎস কী-তা জানতেই কাব্বালাহ একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতির পথ দেখায়। ভালো কথা।

কিন্তু, ম্যাডোনা কাব্বালাহ সেন্টার-এ যোগ দিলেন কেন? জীবন ও জগতের মানে খুঁজতে? আমার বিশ্বাস হয় না। ম্যাডোনা কাব্বালাহ সেন্টার-এ যোগ দিলেন কেন- এই প্রশ্নটি তাকে করাও হয়েছিল। উত্তরে ম্যাডোনা বলেছেন, I've learned from studying Kabbalah that if your happiness is based on people approving of everything you do, you're doomed to fail. শুনুন কথা! এমন আজীব কথা তিনি কাব্বালাহ সেন্টার-এ শিখেছেন! কথাটা হয়তো সত্য-কিন্ত, এসব কথা কি কাব্বালাহ সেন্টার-এ শেখানো হয়? কাব্বালাহ সেন্টার কি জীবনের উৎসের মানে খোঁজার বদলে আধুনিক জীবনের নানান বিড়ম্বনা নিয়ে মাথা ঘামায়? কাব্বালাহ সেন্টার-এর লিফলেটে দাবী করা হয়েছে ...যারা সত্যি সত্যিই জীবনের মানে খুঁজতে চায়- প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান তাদের স্বাগত জানায়। আমাদের অস্তিত্বের উৎস কী-তা জানতে কাব্বালাহ একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতির পথ দেখায়। অথচ, ম্যাডোনা বলছেন সম্পূর্ন অন্য ধরনের কথা।

নাকি তাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে। আমাদের দেশের মেধাবী যেমম এককালে এইচ এস সি পরীক্ষায় বোর্ডে প্রথম হয়ে বলত অমুক কোচিং সেন্টার ভালো। ম্যাডোনা কাব্বালাহ চর্চার পক্ষে আরেকটি অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়েছেন। কাব্বালাহ নাকি ঈশ্বরের নারীরুপটির গুরুত্ব দেয়। ঈশ্বরের নারীরুপ? এও সম্ভবত বানোয়াট! নারীবাদের যুগে ঈশ্বরকেও তো নারী হতে হবে।

নারীবাদীদের সমালোচনা থেকেও তো কাব্বালাহ সেন্টার কে রক্ষা করতে হবে। কেননা, কাব্বালাহপন্থিরা প্রাচীন যুগ থেকেই বলে আসছেন যে- কাব্বালাহ চর্চায় নারীর অধিকার নেই। এখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। ম্যাডোনা, আমি বিশ্বাস করি, ‘অস্তিত্বের উৎস খুঁজতে’ কাব্বালাহ সেন্টারে নাম লেখাননি। যারা ‘অস্তিত্বের উৎস খোঁজেন-তারা ছোটবেলা থেকেই খোঁজেন এবং তারা খোলামেলা পোশাক পরে লোকজনের সামনে আসতে বিব্রত বোধ করেন।

কাজেই ম্যাডোনা ওখানে গিয়েছেন শান্তির খোঁজে। এর আগেও তিনি কোন্ ভারতীয় গুরুর কাছে গিয়েছিলেন-শান্তি পাননি। ম্যাডোনার জন্য শান্তি কি সহজ? তিনি তো জাগতিক ভোগসুখের চরমমাত্রা স্পর্শ করেছেন। যাক। ম্যাডোনা উচ্চতর দর্শনের খোঁজে কাব্বালাহ সেন্টার যাননি; গিয়েছেন শান্তির খোঁজে কিংবা বৈচিত্রের আশায়।

ভূতপ্রেত তাড়াতে এখন তিনি কব্জিতে লাল সুতা পরছেন। কী অধঃপতন! এ ক্ষেত্রে দুটো প্রশ্ন উঠে আসে। জীবনের মানে খুঁজতে হলে অযৌক্তিক কুসংস্কার আঁকড়ে ধরতে হবে কেন? কেনই-বা প্রাচীন সেমেটিক কুসংস্কার ফিরিয়ে আনতে হবে? রোইটি বিনডেলে অশুভ শক্তির নজর এড়াতে কাব্বালাহপন্থিরা কব্জিতে এক ধরনের পাতলা লাল রঙের সুতলি পরে। আগেই বলেছি- ইড্ডিশ ভাষায় সুতলির নাম রোইটি বিনডেলে। রোইটি বিনডেলে তৈরি হয় পাতলা লাল রঙের উল দিয়ে।

পরতে হয় বাঁ কবজিতে। নব্বুয়ে দশকে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পপুলার হয়ে ওঠে। ম্যাডোনা ছাড়াও রোইটি বিনডেলে মার্কিন সেলিব্রেটিরা অনেকেই পরেন । মাইকেল জ্যাকসনও পরতেন। অথচ অনেক বিজ্ঞ রাব্বির মতে, মানুষকে রক্ষা করার শক্তি লাল সুতলির নেই! উপরোন্ত তোরাহয় লাল রঙের সুতা বা কাপড় পরা নিষিদ্ধ।

তোরাহয় বলা হয়েছে,“ যে ব্যাক্তি হস্তে রক্তিম বর্ণের সুতলি ধারণ করে তাহার আত্মা বিশুদ্ধ নয়! মূলধারা ইহুদিরা কাব্বালাহ সেন্টার এর বিরোধী। প্রথমত, তারা মনে করে, কাব্বালাহ একান্তভাবেই ইহুদিদের গুপ্ত বিদ্যা। কাজেই এটির চর্চা বিশ্বজনীন হতে পারে না। মূলধারা ইহুদিদের কাব্বালাহ সেন্টার-এর বিরোধীতার কারণ আরও আছে। কাব্বালাহ চর্চাকারীকে পুরুষ হতে হবে, বিবাহিত হতে হবে, তার সন্তানাদিথাকতে হবে এবং তার অতি অবশ্যই তালমুদ মুখস্ত থাকতে হবে।

(তালমুদ=ইহুদি আইনের শাস্ত্রীয় সমীক্ষা) এতসব বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও সবার জন্য কাব্বালাহ উন্মুক্ত হল কেন? আসুন কারণ অনুসন্ধান করি। সাব্বাতাই যেভি ছিলেন একজন ইহুদি রাব্বি। তিনি ১৬২৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বর্তমান পূর্ব ইউরোপের মন্টেনেগ্রোয় জন্ম গ্রহন করেছিলেন । ১৬৬৫ সাল। নাথান অভ গাজা নামে একজন রাব্বি বাস করতেন জেরুজালেমে।

তিনি সাব্বাতাই যেভি-কে ইহুদি মেসাহ দাবী করে বসেন। এ জন্য রাব্বি নাথান অভ গাজা নাকি কাব্বালাহ বিচারপদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। যাই হোক। মূলধারার ইহুদিরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা রাব্বি নাথান অভ গাজা কর্তৃক সাব্বাতাই যেভি-কে ইহুদি মেসাহ দাবী করাকে ধর্মীয় নীতির পরিপন্থি ঘোষনা করে কাব্বালাহ চর্চার পথটিই অবরুদ্ধ করে দেয়।

তবে কাব্বালাহকে বেশি দিন অবরুদ্ধ করে রাখা যায়নি। কেন যায়নি? তারও কারণ আছে। কাব্বালাহ আর্ট। যতই ঢেকে রাখুক । কাব্বালাহ জীবনবৃক্ষের কথা বলে, বলে পবিত্র জলের কথা, সংখ্যার রহস্যময় শক্তির কথা ... স্পেন ও পর্তুগালের ইহুদিদের বলা হয় সেফহারদিক।

ঐ সেফহারদিক ইহুদিদের নিত্যদিনের জীবনে কাব্বালাহ অপরিহার্য ছিল। এর প্রধান কারণ কাব্বালাহ জ্যোতিষ বিশেষ করে সংখ্যাতত্ত্ব । মানুষ ভবিষ্যৎ জানতে চায়ই। শান্তি চায়, বৈচিত্র চায়। রহস্যময় কাব্বালাহ আছে শান্তি ও বৈচিত্র।

এ ক্ষেত্রে আমরা ম্যাডোনার উদাহরণও নিতে পারি। যা হোক। সাব্বাতাই যেভির মৃত্যুর ১০০ বছরের মধ্যেই কাব্বালাহ ইউরোপে অবাধ ও উন্মুক্ত হয়ে ওঠে। এর পিছনে ছিল অষ্টাদশ শতকের পূর্ব ইউরোপের হাসিদিক আন্দোলন। হাসিদিক ইহুদিদের কট্টরপন্থিই বলা চলে।

এদের অনেক নেতাই কাব্বালাহ চর্চা করতেন। এভাবে কুড়ি শতকে পৌঁছে আর কাব্বালাহ আর একদল শাস্ত্রপ্রিয় মানুষের দখলে রইল না। মূলধারা ইহুদিরা আরেকটি বিশেষ কারণে কাব্বালাহ সেন্টার এর বিরোধী। কাব্বালাহ সেন্টার দাবী করে কাব্বালাহ জীবন বদলে দেবে। তাদের মতে এই দাবী অমূলক।

মূলধারা ইহুদিরা মনে করে অন্যান্য ইহুদি আধ্যাত্মিক গোষ্ঠী এমন হাস্যকর দাবী করে না। কাব্বালাহ সেন্টার আরও অনেক দাবী করে। সেসবও অসার। কথাটা ব্যাখ্যা করি। আমি আগে বলেছি কাব্বালাহ চর্চার আকর গ্রন্থর জোহার ।

আলোচনার এ পর্যায়ে জোহার লেখার পটভূমি সম্বন্ধে আলোকপাত করি। খ্রিষ্টিয় ১ম ও ২য় শতকে প্রাচীন ফিলিস্তিনের ভাষা ছিল আরামিক। জোহার লিখিত হয়েছিল আরামিক ভাষাতেই। সেটা খ্রিষ্টিয় ২য় শতকের ঘটনা। ইজরেলজুড়ে ইহুদিদের ওপর চলছিল ভয়ঙ্কর রোমান নির্যাতন; রোমান শাসনের বিরুদ্ধেও ইহুদিদের বিদ্রোহসংগ্রাম চলছিল।

সে সময় শিমোন বার য়োচাই নামে একজন রাব্বি (ইহুদি মৌলানা) রোমান নির্যাচন এড়াতে গুহায় লুকিয়ে থাকবেন ঠিক করলেন। সঙ্গে ছেলে। সে ছেলের নাম এলাজার। ছেলের সঙ্গে শিমোন বার য়োচাই প্রত্যহ তোরাহ পাঠ করতেন। সেই সঙ্গে তোরাহর মরমী তফসির বা টীকা।

যার বিষয় ছিল-ঈশ্বরের প্রকৃতি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও কাঠামো, আত্মা, পাপ, মোক্ষ, শুভ-অশুভ, মানুষ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক -ইত্যাদি । এভাবে ১৩ বছর কাটল গুহায় । সে সময়ই নাকি একদিন প্রোফেট এলিজাহ গুহায় এসে শিমোন বার য়োচাই কে তোরাহর নতুন একটি টীকাভাষ্য লিখতে অনুপ্রাণিত করেন। অনুপ্রাণিত শিমোন বার য়োচাই তখন ঐ আরামিক ভাষাতেই তোরাহর নতুন একটি টীকাভাষ্য রচনা করেন। রচনা শেষ করে রচনার নাম দেন, ‘জোহার।

’ জোহার মানে- ‘জ্যোতি’ এবং এটি একটি গ্রন্থ নয়। লক্ষ করুন, প্রোফেট এলিজাহ শিমোন বার য়োচাই কে কেবলমাত্র তোরাহর নতুন একটি টীকাভাষ্য লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। অথচ, কাব্বালাহ সেন্টারের প্রচার পুস্তিকায় দাবী করা হয়েছে-বহু আগেই জোহার এ লিখিত হয়েছে ...বিংশ শতকের শেষে মানবজাতি আবার জীবনের মানে খুঁজতে শুরু করবে। (যেন জজীবনের মানে মানুষ এর আগে খোঁজেনি!) এবং সেই প্রশ্নের উত্তর নিহিত কাব্বালাহর প্রাচীন বিজ্ঞানে। (শুধুই কাব্বালাহর প্রাচীন বিজ্ঞানে? মায়া অ্যাজটেক সভ্যতার জ্ঞানীরা কিছু লিখে যাননি?) যা আমাদের সময়েই কেবল উম্মোচিত হবে।

(সর্বনাশ! তা হলে জোহার কি হরর পুস্তক?) কেননা, সময়টি অত্যন্ত জটিল! (মানবসভ্যতার কোন্ সময়টি অ-জটিল ছিল?) আর এই বিশেষ কারণেই প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান লুক্কায়িত রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মানুষ এর জন্য প্রস্তুত হয়নি। প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞান মানুষের প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রাচীন কাব্বালাহ বিজ্ঞানেরর আবেদন নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ... এসব কারণেই আমি শুরুতে বলছিলাম । নির্জনতা অন্যতম অনুষঙ্গ হওয়ায় প্রাচীনকালে মরমীবিদ্যার চর্চা হত নিভৃতে; লোকচক্ষুর আড়ালে।

আধুনিক বিশ্বে মরমীবিদ্যার চর্চাও হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক-যেন মরমীবিদ্যার চর্চার সঙ্গে নির্জনতার কোনওরুপ সম্পর্ক নেই! ইহুদি ধর্মের মরমী শাখা কাব্বালাহও এর প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসনের শিকার। কাব্বালাহ চর্চার জন্য কুড়ি শতকের শেষের দিকে ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য কাব্বালাহ সেন্টার-একুশ শতকে পৌঁছে সেসব প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি চটকদার, ঝলমলে আর বিজ্ঞাপনপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নির্জনতা অন্যতম অনুষঙ্গ হওয়ায় প্রাচীনকালে মরমীবিদ্যার চর্চা হত নিভৃতে; লোকচক্ষুর আড়ালে। আধুনিক বিশ্বে মরমীবিদ্যার চর্চাও হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক-যেন মরমীবিদ্যার চর্চার সঙ্গে নির্জনতার কোনওরুপ সম্পর্ক নেই! ইহুদি ধর্মের মরমী শাখা কাব্বালাহও এর প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসনের শিকার। কাব্বালাহ চর্চার জন্য কুড়ি শতকের শেষের দিকে ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য কাব্বালাহ সেন্টার-একুশ শতকে পৌঁছে সেসব প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি চটকদার, ঝলমলে আর বিজ্ঞাপনপ্রবণ হয়ে উঠেছে।

সেসব সেন্টারে সাধারন কৌতূহলী মানুষ যেমন আসছে তেমনি আসছে বিশ্বমিডিয়ার সেলিব্রেটিগন। এই কিছুদিন আগে ম্যাডোনা, ব্রিটনি স্পিয়ার্স কাব্বালাহ সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। ধর্ম কেবল ধর্মই নয়-ধর্ম সংস্কৃতির অনিবার্য উপাদানও বটে। আজ বৈশ্বিক যুগের মানুষ অপর ধর্মের সাংস্কৃতিক দিকটি অসঙ্কোচে গ্রহন করছে। এটিই আশার দিক।

এই মেয়ে খ্রিস্টান না ইহুদি-সেটি বড় কথা না, এর গলায় লাল রঙের রোইটি বিনডেলে ঝুলছে। দেখতে যে ভালো লাগছে - সেটাই বড় কথা। মনে থাকার কথা- কাব্বালাহ শব্দটি হিব্রু; শব্দটির মানে “গৃহিত ঐতিহ্য। ”আধুনিক যুগের আধুনিক মানুষ কাব্বালাহ কে এভাবে গ্রহন করেছে ....
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.