আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ‘আমার একমাত্র ভরসা হল গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক দল। অর্থাৎ আমার দেশের দরিদ্র জনগণ, তাঁরাই আমার একমাত্র ভরসা। কারণ তাঁদের কল্যাণই আমার লক্ষ্য। এই শাসন ব্যাবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে আমি সচেতন।

গণতন্ত্র মানুষেরই সৃষ্টি, এরও অনেক দূতি আছে। কিন্তু মোটের উপর গণতন্ত্রই হচ্ছে প্রগতি ও বিবর্তনের একমাত্র নিশ্চিত পথ। -------কোনো ব্যক্তির খেয়ালের উপর নয় বরং জনগণের ইচ্ছাই সরকারী নীতির ভিত্তি হবে। ------গণতন্ত্রকে স্বতঃসিদ্ধরূপে গ্রহণ করতে হবে। নির্ভুল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র কখনো ব্যর্থ হতে পারে না’।

_হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজীবন গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, গণতন্ত্র নির্মাণ করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক বোধ ও সংস্কৃতি নির্মাণ করা। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষে বসে তিনি তাঁর আদর্শ অর্থাৎ গণতন্ত্র বিনির্মাণে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। তিনি যে আদর্শ ও দর্শন বিশ্বাস করতেন, ধারণ করতেন তা-ই বাস্তবায়ন করার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্যক্তিগত জীবনাচরণ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই_ ত্যাগ ও দেশপ্রেম মহিমায় মানুষের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার এক মহান ব্যক্তিত্ব হলেন তিন।

এই উপমহাদেশের গণতন্ত্রকে বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বুঝতে গেলে আমাদেরকে বার বার ফিরে যেতে হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। গণতন্ত্রের স্বরূপ উম্মোচনে আমরা তাঁরই দারস্থ হই। যে কারণে তাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম ১৮৯৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। মেদেনীপুর জেলার এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে।

এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন_হযরত শেখ শাহাবদ্দীন ওমর বিন মোহাম্মদ-উম-সোহরাওয়ার্দী। তিনি বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীর প্রধান শিষ্য ছিলেন। মোঘল আমলে এই পরিবার বাগদাদ থেকে বাংলাদেশের মেদেনিপুর জেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সোহরাওয়ার্দীর বাবা জাহিদুর রহিম সোহরাওয়ার্দী, মা খুজিস্তা আখতার বানু। কলিকাতা মাদ্রাসায় সোহরাওয়ার্দীর শিক্ষা জীবন শুরু হয়।

সেখানে অধ্যায়ন শেষে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে অনার্সসহ বিএসসি পাশ করার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আরবীতে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯১১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ আইনে সর্বোচ্চ ডিগ্রী বিসিএল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯১৯ সালে স্যার আব্দুর রহিমের কন্যা নিয়াজ ফাতেমাকে সহধর্মিনী করেন।

কিন্তু বিয়ের ৩ বছর পর তাঁর সহধর্মিনী মারা যায়। ১৯৪০ সালে তিনি এক রাশিয়ান মেয়েকে সহধর্মিনী করেন। তাঁদের ঘরে দুটি সন্তান জন্মে ছিল। মেয়ে আখতার সোহরাওয়ার্দী, ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। শেষ পর্যন্ত তাঁর দ্বিতীয় সহধর্মিনীর সাথেও তাঁর সম্পর্ক থাকেনি।

১৯২০ সাল। রাজনৈতিক জীবন শুরু। এ এক বর্ণাট্য রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যলয়ে আইন পড়ার সময়ই সিদ্বান্ত নিয়েছিলেন যে, সারা জীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করবেন। তাঁর সিদ্বান্ত জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর এই বর্ণাট্য রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসে কোনো লোভ-ভোগ-সুবিধাবাদিতা ছিলো না। ছিল শুধু দেশপ্রেম ও ত্যাগের মহিমা। ১৯২১ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯২৩ সালে হিন্দু-মুসলিম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তি মূলত সোহরাওয়ার্দীর চেষ্ঠায় সম্ভব হয়ে ছিল। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসে তাঁকে স্বরাজ পার্টির ডেপুটি লীডার পদে মনোনিত করেন এবং কলিকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র পদে নির্বাচিত করেন। ১৯২৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মারা যায়। এ সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সুরাহা করতে যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও তিনি নেতৃত্ব দেন।

এরপর তিনি খিলাফত সম্মেলনের আয়োজন করে ছিলেন। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী। ১৯২৮ সালে বেঙ্গল মুসলিম লীগের কনফারেন্সে অনুষ্ঠত হয়। তিনিই এই কনফারেন্সে আয়োজন করেছিলেন। তিনি ছিলেন এই কনফারেন্সের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি।

১৯৩১ সালে বোম্বেতে নিখিল ভারত সেচ্ছাসেবক লীগের কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩২ সালে অনুষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন। ১৯৩৩ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৩৫ সালে খিলাফত কনফারেন্স, সেচ্ছাসেবক, ফিজাক্যাল কনফারেন্সের ব্য্যবস্থা করেন এবং একই সাথে কলকাতা কর্পোরেশনে বর্জন আন্দোলন করেন। ১৯৩৬ সালে বেঙ্গল মুসলিম উনাইটেড পার্টি গঠন করেন।

ওই বছর তিনি মুসলীম লীগে যোগ দেন। ওই একই বছর মুসলীম লীগ মন্ত্রীসভা গঠন করে। তিনি ১৯৩৭-৪১ সাল পর্যন্ত এই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি মুসলীম লীগ যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে তা মূলত তাঁর কারণে। এ সময়েও মুসলীম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতারা খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে উঠেন। ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিন, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরোক্ষ সমর্থনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী হবার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ এবং ‘পাকিস্তানের শত্রু’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত করা হয়।

১৯৪৭ সালের নবেম্বর মাসে তিনি কলকাতায় নিজের বাস ভবনে নিখিল ভারত লীগ ও কনভেনশন আয়োজন করেন। ওই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত লীগ কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৮ সালের ৩ জুন পূর্ববঙ্গের নাজিম উদ্দীন সরকার তাঁকে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগতাদের মধ্যে তিনিই প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

এই দলের সভাপতি হন তিনি এবং মাহামুদুল হক উসমানী হন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর যে বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে তাকেও সংগঠিত করার নেতৃত্বে অগ্রজ ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। তাঁরই রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় হয়।

তখন মন্ত্রীসভায় সোহরাওয়ার্দি আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪-৫৫ সাল পর্যন্ত আইনমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রনয়ণে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

১৯৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে তিনি পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনের তার চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়।

১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করেন। ১৯৫৯ হতে ইলেক্টিভ বডি ডিসকুয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাঁকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। রাস্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট তিনি মুক্তি পান। অক্টোবার, ১৯৬২ তে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এন ডি এফ ) গঠন করেন।

১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। পাকিস্তানের গণতন্ত্র যে ব্যর্থ হয়েছে তা সোহরাওয়ার্দী কখনো স্বীকার করেন নি। তিনি সব সময়ই বলেছেন, পাকিস্তানে কোনোদিন গণতন্ত্রকে সুযোগ দেয়া হয়নি। এমন কি ১৯৫৬ সালের যে শাসনতন্ত্র তাও কার্যকর হওয়ার আগে বাতিল হয়ে যায়।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.