আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুধু বিদ্রোহী নয়, বিপ্লবী কবি নজরুল ইসলাম

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

শোষিত মানুষের কবি _কাজী নজরুল ইসলাম আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধবনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- --------------------------------------- আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন ! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন ! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে সকল কবি-সাহিত্যিক তাঁদের লেখনির মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশের তরুণ-যুবকদের চেতনার কারফিউ- তন্দ্রা ভেঙ্গে দিয়ে দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাগরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের কাছে ছিলো আগ্নেয়াস্ত্র আর কবি-সাহিত্যিকদের ছিলো কলম এবং মুকুন্দদাসের ছিলো কন্ঠ। কলমাস্ত্র ও কন্ঠ দিয়ে নির্মাণ হতো চেতনা। চেতনা সৃষ্টি করতো বিপ্লবীদের সাহস ও দৃঢতা।

যার কারণে ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ------ গাজনের বাজনা বাজা, কে মালি কে সে রাজা কে দেয় সাজা, মুক্ত স্বাধীন সত্ব কেড়ে হা... হা... হা... পায় যে হাসি ভগবান পরবে ফাসিঁ------------ কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের কবি। মানুষের কবি। চারণ কবি।

জাতীয় কবি। বিদ্রোহী কবি। বিপ্লবী কবি। শোষিত মানুষের কবি। শুধু কবি নন, তিনি সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যেও অন্যতম।

গীতিকার, সুরকার, গায়ক, নাট্যকারও তিনি। অন্যদিকে অস্ত্র হাতে সাহসী সৈনিকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকে ব্যয় করেছেন। স্বাধীনতা-সাম্যের জন্য তিনি বজ্র-ইস্পাত কঠিন কবিতা রচনা করেছেন। অন্যদিকে সময় পেলেই প্রকৃতির প্রেমে ডুবে যেতেন তিনি।

লিখতেন মা-মাটি-প্রকৃতি ও প্রকৃতির প্রকৃতি নারী নিয়ে। ---------- তুমি আমায় ভালোবাস তাই আমি কবি আমার এরূপ- সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি। নজরুল ছিলেন মানবতাবাদী কবি। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন সর্বত্র। লিঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, মানুষ হিসেবে বিচার করেছেন সকলকে।

বিশ্ব সভ্যতায় সকলের সম আবদান। তাই তিনি বলেছেন ----- বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। মানুষ আর মানবতা বিষয়ে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। মানুষ কবিতায় তিনি রচনা করেন মানুষের সাম্যের পথ। যে পথ শোষণ-বৈষম্যে অবসান ঘটিয়ে সাম্য ভালবাসার সমাজ – পৃথিবী নির্মাণ করবে।

পৃথিবীর সভ্যতার মূলে মানুষেরই অবদান। সভ্যতা নির্মাণে আর কারো কোনো অবদান নেই। তাই তিনি মানুষ কবিতায় বলেছেন ----------- গাহি সাম্যের গান-- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাহি, নহে কিছু মহীয়ান! মুক্তসমাজ মুক্তসংস্কৃতি মুক্তচিন্তা নির্মাণের কবি ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও ছোট-বড় এসকল কুসংস্কার ও সংকীর্ণতাকে কখনও আমল দেননি। গোড়ামিঁ-ধর্মান্ধতা ও কথিত কাল্পনিক কোনো দেব-দেবী-ঈশ্বরে আস্থা রাখেননি।

বরং এসব গোঁড়ামির মূলে নির্মমভাবে আঘাত করেছেন বারংবার। মানুষকে সব ধরনের চেতনার দৈণ্যতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য শক্ত হাতে লিখেছেন অবিরাম। তিনি বলেছেন--------------- পুজিছেঁ গ্রন্থ ভন্ডের দল। মূর্খরা সব শোন, মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন! কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে।

চুরুলিয়া জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। দাদা কাজী আমিনউল্লাহ। বাবা কাজী ফকির আহমদ, মা জাহেদা খাতুন। নজরুল ইসলামের বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন ছয় ভাই এবং বোন।

কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। তিনি বাল্য বয়সে স্থানীয় মক্তবে ‘মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল’পড়াশুনা শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার বাবা মারা যায়। তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হয়।

মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁকে নেমে যেতে হয় রুটি-রুজির সন্ধানে। এসময় তিনি মক্তবে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসাবে যুক্ত থাকেন। এভাবে তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ের সাথে পরিচিত হন। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে তিনি বেশি দিন ছিলেন না।

শুরু হলো ভবঘুরে ও বাউণ্ডুলে জীবন। বাল্য বয়সেই তিনি লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। একটি লেটো দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী ফজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের ওস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল।

ফজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয় বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর এবং কবিয়াল বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন।

তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন। তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। এসময়ে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নও চলতে থাকে। নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন তিনি।

চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতাকর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। তিনি প্রথমে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। আর্থিক সমস্যার কারণে বেশী দিন পড়াশোনা করতে পারেন নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার রুটি-রুজির সন্ধানে যেতে হয়।

প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। জীবনযুদ্ধে কষ্টের জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার প্রকৃতি বুঝতে সক্ষম হন।

তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তমশ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ সালে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টমশ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই নজরুল পড়াশুনা করেন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে মাধ্যমিক প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এই স্কুলে পড়াশুনার সময় নজরুল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত।

এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদ মর্যাদায় আসীন হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফারসি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন। আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে সমভাবে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি।

করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। মূলত নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি করাচি সেনানিবাসে। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন।

এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। যুদ্ধ শেষে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন।

তার সাথে থাকতেন ওই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্‌ফর আহমদ। এখান তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকে মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্‌ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌দম্‌। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।

কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের নজরে আসতে শুরু করেন। । বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে।

১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক।

এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ওই বছরই এই পত্রিকায় ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী’ কে? শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: ‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন’। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন।

তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে বেড়াতে আসেন। আর এখানেই পরিচয় হয় প্রমীলা দেবীর সাথে। যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল। এতে নজরুল অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’।

নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর উদাহরণ বিদ্রোহী কবিতাটি। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন--কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়।

এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন।

১৬ জানুয়ারি বিচারে তাকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়।

কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরোসার্জারি করে ভাল করা যেত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন।

১৯৫২ সালে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। বলেছিলেন ‘ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস’ রোগে ভুগছেন।

১৯৫৩ সালের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্‌স ডিজিজ নামক একটি নিউরণ ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিস্কের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়। অনেক দিন পর নজরুলকে নিয়ে তার সঙ্গীরা ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯৭৪ সালে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মারা যায়। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তিনি মারা যান। আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধুমকেতু! ঐ বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়িয়েছিল রে হাত মম অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুটো সে জগন্নাথ! আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী, তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে ঠুঁটি বিধাতার বুকে হাতুড়ি, আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তা’ও! তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাঁ’ও! তোর নিযুত নরকে ফুঁ’দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি, আর যে যত রাগে তারে তত কাল-আগুনে কাতুকুতু দি,

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.