আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুষ্টিয়ায় সাংসদপুত্রদের রাজত্ব

প্রেম ছিল, আশা ছিল

গত কয়েকদিন যাবত গনমাধ্যমে খবরের শিরোণাম হচ্ছে কুষ্টিয়া জেলা। তবে সেটা নেতিবাচক খবরের জন্য। যেটা কুষ্টিয়াবাসীর জন্য খুবই লজ্জাকর। প্রথম আলো ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরী করেছে এই জেলার রাজনৈতিক নেতা, তাদের সন্তান ও সাঙ্গপাঙ্গদের বর্তমান কর্মকান্ড নিয়ে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে কুষ্টিয়া জেলার কয়েকটি ঘটনার অবতারণা করতে চাই।

ইতোমধ্যে অবশ্য প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বরাবরই আমরা দেখে আসছি, এদেশে রাজনৈতিক নেতাদের নামে কোন অভিযোগ এলেই তারা বলেন- এটা মিথ্যা এবং যড়যন্ত্র মুলক। তার সুনাম নষ্ট করার জন্য প্রতিপক্ষ এই ধরণের অপপ্রচার চালাচ্ছে। এযেন তোতা পাখিকে শেখানো বুলি। বাড়ীতে অতিথি এলেই বলতে হবে- আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন? বেশীরভাগ নেতার কথা শুনলে মনে হয় তারা যেন স্বর্গীয় দূত।

পৃথিরীর কোন পাপাচারে তারা লিপ্ত হননা বরং পৃথিবীর মানুষ তাদের সুনাম নষ্ট করার অপপ্রচারে ব্যস্ত। ২২ আগষ্ট প্রথম আলোতে শিরোণাম ছিল- ”তিন সাংসদের সহযোগী ও ছেলেদের নিয়ন্ত্রনে কুষ্টিয়া”। প্রথমেই এসেছে কুষ্টিয়া-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ সুলতানা তরুনের গুনধর পুত্র গোলাম মোরশেদ পিটারের কর্মকান্ডের বিবরণ। কাবিখা চাল-গম, ঠিকাদারি, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বদলি ও স্কুল-কলেজ সবই তার নিয়ন্ত্রনে। ঢাকায় বসেই তিনি এইসব কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।

মা সুলতানা তরুণও ছেলের ওপর সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত। তাঁর কথায়- দলের সব লোকের ওপর কাজের দায়িত্ব দিয়ে শান্তিতে থাকা যায় না। তাদের ওপর আমার বিশ্বাসও নেই। আমার যোগ্য ছেলের ওপর দায়িত্ব চাপালে দোষ কোথায় (প্রথম আলো ২২ আগষ্ট, ২০০৯) ? ঠিকই তো। ছেলে যদি যোগ্য হয় আর সেই যোগ্য ছেলের ওপর কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে তো দোষের কিছু নেই।

কিন্তু সাংসদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কেন তিনি ছেলের ওপর দিচ্ছেন? ছেলে তো আর সাংসদ নির্বাচিত হন নাই। সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তিনি নিজেই সব কাজ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। পিটারের মত আরেকজন হলেন আরিফ বিশ্বাস। তিনি কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ আফাজ উদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে এবং দৌলতপুর থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক।

দৌলতপুর থানার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকাই এখন সাংসদ মানেই আরিফ বিশ্বাস। সাংসদের সব কাজ তিনি করেন। ছেলের ব্যাপারে নিজে সরাসরি কোন মন্তব্য করেননি সাংসদ আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস বরং তিনি ফোনে তার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসির অভিযোগ সম্পর্কে আরিফ জানিয়েছেন- তাঁর বাবা বৃদ্ধ। তাঁর পক্ষে তিনি কিছু কাজ করে দেন, এটা খারাপ কিছু নয় (প্রথম আলো ২২ আগষ্ট, ২০০৯)।

অথচ পরদিন তিনি প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ করে বলেছেন- তাঁর ও তাঁর বাবাকে জড়িয়ে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা আদৌ সত্য নয় (প্রথম আলো ২৩ আগষ্ট, ২০০৯)। বিগত বিএনপি সরকারের সময়ও বারবার আলোচনায় এসেছে কুষ্টিয়া জেলার সাংসদ , তাদের পুত্র ও সহযোগীদের নানান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের খবর। কুষ্টিয়া-২ আসনের সাংসদ শহিদুল ইসলাম নিজে এবং তার বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাশের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। সাংসদ হয়েও তিনি ছিলেন সন্ত্রাসীদের গড ফাদার। কুষ্টিয়ার আরেক সন্ত্রাসী কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ পচা মোল্লার ছেলে রেজা আহমেদ ওরফে বাচ্চু মোল্লা।

এক সময় এলাকার বাসিদের মুখে মুখে শোনা যেত- ’উপরে আল্লাহ্ মাঝখানে পচা মোল্লা আর যা করে সব বাচ্চু মোল্লা’। গরু চুরি ও চোরাচালান থেকে শুরু করে সব ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে বাচ্চু মোল্লা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে । প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষ কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতে পারতো না। শোনা যায়, তার প্রত্যক্ষ মদদে দৌলতপুরের নিচে করারীর চরে অন্তত ৩০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সেই সময় ঐ চরের বাসিন্দারা কেউ রাতের বেলায় ঘরে থাকতে পারতো না।

জীবনের ভয়ে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এতেই তিনি ক্ষ্যান্ত হননি সাংবাদিক পিটিয়ে এবং হত্যার হুমকি দিয়ে সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে এসেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি অবশ্য সংসদও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা বিগত দিনে অনেক রাজনৈতিক নেতার গুনধর পুত্রদের কুকর্মের ইতিহাস জানি। নেতারাও তাদের সন্তানদের অপকর্মের কাহিনী আমলে নিতে চাননি।

বরং ছাপাই গেয়েছেন নিজ সন্তানের পক্ষে। কখনো দোষ চাপিয়েছেন মিডিয়ার ওপর আবার কখনোবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর। তাঁরা সাময়িকভাবে সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করলেও ডেকে এনেছেন নিজের স্থায়ী বিপদ এবং তার মাশুলও গুনেছেন। ভুলে যাবেন না আপনারা জনপ্রতিনিধি। আপনাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত জনগনের হাতে।

অতিতের অনেক নির্বাচনে পুত্রের কৃতকর্মের ফল হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তাদের বাবা-মা। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আবুল হাসনাত আবদূল্লাহ, আলহাজ মকবুল হোসেন, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, সাইফুর রহমান তার জলন্ত উদাহরণ। বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির কারণ হিসাবে অনেকেই তারেক রহমান ও তার হাওয়া ভবণকে দায়ী করেন। আমাদের সবচেয়ে বড় দোষ হল আমরা অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহন করিনা। দল ক্ষমতায় গেলেই মন্ত্রী-সাংসদদের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনরা বেপরোয়া হয়ে উঠে।

আর নেতারাও ব্যস্ত থাকেন এদের সমস্ত অপকর্মের উৎসাহ প্রদানে। বারবার রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের কথা বললেও বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ আমাদের চোখে পড়ছেনা। দিনবদলের সরকার তার দলের নেত্-কর্মীদের গুনগত পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দিন। পরিশেষে একটা শোনা গল্প বলি। এক রাজনৈতিক নেতা বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফেরা ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত।

কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেকে তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলেন না। অগত্যা তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। ছেলের ঘরে একদিন তিনি রাখলেন, ধর্মগ্রন্থ, পিস্তল, মদ এবং কিছু টাকা। এরপর তিনি এক বন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন ছেলের কর্মকান্ড দেখার জন্য। ছেলে ঘরে ঢুকেই প্রথমে ধর্মগ্রন্থ’টি যতœ করে আলমারীতে তুলে রাখলো, পিস্তলটি বালিশের রাখলো নিচে, টাকাগুলো ঢোকালো পকেটে এবং চেয়ারে বসে মদের বোতল খুলে গিলতে শুরু করলো।

রাজনীতিবিদ খুশি হয়ে তার বন্ধুকে বললেন- দেখ দেখ আমার ছেলে আমার মত মন্ত্রী হবে! তারেক মাহমুদ গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী (লেখাটি ২৬ আগষ্ট ২০০৯ প্রথম আলোয় প্রকাশিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.