আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেখ সেলিমের সন্দেহের তীর : শফিউল্লাহর আত্মপক্ষ সমর্থন



দৈনিক সমকাল / ২৩ আগষ্ট ২০০৯ রোববার শেখ সেলিমের সন্দেহের তীর : শফিউল্লাহর আত্মপক্ষ সমর্থন সমকাল প্রতিবেদন ----------------------------------------------------------------- ইতিহাসের এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় রহস্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে লোকসম্মুখে কি উন্মোচিত হতে যাচ্ছে? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলবদের পাদপ্রদীপের আলোয় কি অবশেষে নিয়ে আসা হবে? ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর তাই তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সন্দেহের তীক্ষষ্ট তীর ছুড়ে মেরেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্র প্রতি। শেখ সেলিম সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তৎকালীন সেনাপ্রধানের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা সম্ভব হতো। কিন্তু ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে কেন তিনি সে দায়িত্ব পালন করেননি, তা রহস্যজনক। শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

পক্ষান্তরে কেএম শফিউল্লাহ্ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তখন তার কিছুই করার ছিল না। তিনি এক বৈরী পরিস্থিতিতে কিছু উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তার আদেশ-নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। শেখ সেলিম গত শুক্রবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রথম সারিতে উপবিষ্ট কেএম শফিউল্লাহ্কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, কেন সে রাতে আপনি ৩২ নম্বরে যাননি? জিয়ার জন্য, খালেদ মোশাররফের জন্য? আপনি সেখানে গিয়ে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতেন, আপনি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। শফিউল্লাহ্ তখন নিরুত্তর ছিলেন।

সম্প্রতি সমকালে আয়োজিত এক বৈঠকে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) হারুন-অর-রশীদ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ঘটনা উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। দায়িত্ব শফিউল্লাহ্কেই নিতে হবে : সেলিম হ শাহেদ চৌধুরী সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো বেদনাদায়ক ঘটনার পেছনের কারণ উদ্ঘাটন করতে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানালেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি। শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধুর ট্র্যাজিক পরিণতির পেছনে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ্ বীরউত্তম, উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম ও ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নিষ্ক্রিয় সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত দাবি করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তাদের ভূমিকা কী ছিল এবং কী কারণে তারা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন তার তদন্ত চেয়েছেন। এই তদন্তভার সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর) এবং পুলিশকে দেওয়া যেতে পারে বলে অভিমত দিয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, আলোচিত চার সেনা কর্মকর্তা আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা জানতেন।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কেউ তা করেননি। তারা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। দায়িত্ব তাদের নিতেই হবে। শেখ সেলিম এমপি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন নেতাকে সপরিবারে কেন হত্যা করা হয়েছে, পৈশাচিক ওই হত্যাকাণ্ড কী কারণে ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট ও কারণ বিশ্লেষণ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের শনাক্ত করে বিস্তৃত দলিল প্রকাশ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার আদ্যোপান্ত তদন্তে একটি কমিশন গঠন জরুরি।

স্বতন্ত্র তদন্তের মাধ্যমে এর নেপথ্যের কারণ বের করে আনা বড্ড প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার বড় ভাই আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি এবং ভাবী আরজু মনিও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ হয়েছেন। শেখ সেলিম এমপি সেদিন তার বড় ভাইয়ের ধানমণ্ডির বাড়িতেই ছিলেন। তাকেও হত্যার জন্য একই সারিতে দাঁড় করানো হয়েছিল।

তিনি ঘাতকদের গুলিতে আহত হওয়ার ভান ধরে মেঝেতে পড়ে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। শুক্রবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে একুশ আগস্ট স্মরণে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধু হত্যার সময়কার সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্র উদ্দেশে জানতে চান, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি কেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিলেন না? কেএম শফিউল্লাহ্ এ সময় নিরুত্তর থাকেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ১৯৯৬ সালে তিনি এমপি হওয়ার পরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্র ভূমিকা প্রসঙ্গে শনিবার বনানীর বাসভবনে সমকালের সঙ্গে শেখ সেলিমের বিশদ আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, কখন বঙ্গবন্ধু শহীদ হলেন এবং ওই সময়ে মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্, ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের কী ভূমিকা ছিল, তারা কেন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না, কে কী বলেছেন, এসবের রহস্য খুঁজে বের করতে হবে। \'বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার দায়িত্ব ছিল এই চার পদস্থ সেনা কর্মকর্তার\'_ এ কথা উল্লেখ করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, এখন মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। পরস্পরকে দুষছেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাতে কথিত সিপাহি বিদ্রোহের শুরুতে নিহত হন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবিদ্রোহে নিহত হন ১৯৮১ সালের ৩০ মে।

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু কারা কী ষড়যন্ত্র করছে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছিল না। ওই সময়ে গোয়েন্দারা ফেল করেছে। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ড কোনো সেনা অভ্যুত্থান নয়। হাতে গোনা কয়েকজন দুষ্কৃতকারী ও উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা এবং সৈনিক ওই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।

\'বঙ্গবন্ধুকে অবশ্যই বাঁচানো যেত\'_ এই মন্তব্য করে শেখ সেলিম জানান, ওই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা আতঙ্কে ছিল। এ কারণে ওরা পালানোর চিন্তাও করে রেখেছিল। তাই শুধু ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলেই হতো। কেননা মাত্র ১৫ জন সেনা কর্মকর্তা ও দুই শতাধিক সৈনিক এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল। কেএম শফিউল্লাহ্ বীরউত্তমের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ঘাতক পরিবেষ্টিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্ বীরউত্তমকে ঘটনা জানান।

অথচ অবাক করা কাণ্ড হলো, সেনাপ্রধান এর উত্তরে রাষ্ট্রপ্রধানকে জানান, \'তিনি (বঙ্গবন্ধু) কি একটু সরে যেতে পারেন না!\' কী অদ্ভুত কথা! বঙ্গবন্ধু রাগ করে টেলিফোন রেখে দিয়েছিলেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মতে, বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করার আগেই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্ পুরো ঘটনা জানতেন। এমআই (মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) মেজর (অব.) সালাহ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী মুভ করার বিষয়টি তাকে অবহিত করেছিলেন। তিনি এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না। অর্থাৎ \'বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য সেনাসদস্যরা যাচ্ছে\'_ এ তথ্য জানার পর সেনাপ্রধান যে সময় পেয়েছিলেন, সেই সময়ের মধ্যেই তিনি ইচ্ছা করলে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারতেন।

সেনাপ্রধানের অনুমতি ছাড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বেরোনোর কথা নয় উল্লেখ করে শেখ সেলিম বলেছেন, মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বরিত ব্যবস্থা নিলে বঙ্গবন্ধু বেঁচে যেতেন। তিনি তা করেননি। তাই দায়িত্ব তাকে নিতেই হবে। রাষ্ট্র এবং সরকারপ্রধানকে রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। বঙ্গবন্ধু সরকারপ্রধান ছিলেন।

সেনাসদস্যরাই (প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট) তার বাড়িতে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। তারা কার অধীনে? তারা তো সেনাপ্রধানের অধীনে ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা সেনানিবাসে গিয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টে সর্বোচ্চ সতর্ক সংকেত (রেড অ্যালার্ট) দিয়ে ওদের ব্লক করলেই হতো। অথচ সেটা হলো না।

ওই খুনিদের কাছে সেনাপ্রধানসহ সবাই আত্মসমর্পণ করল। এটা কীসের দুর্বলতা? এর রহস্য কী? কেন তারা খুনি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের কথায় চলল? অথচ সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় তাদের সেনা আইনে (কোর্ট মার্শাল) বিচার হওয়া উচিত ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ্ বেতারে গিয়ে খুনিদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। মেজর (অব.) শরফুদ্দিন আহমেদ ডালিম তাকে বেতারে নিয়ে গিয়েছিল। শেখ সেলিম জানতে চান, কেন কেএম শফিউল্লাহ্ একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করলেন? ওই খুনিই বলতে গেলে সেনাপ্রধানকে গ্রেফতার করে বেতারে এনেছিল বলে আওয়ামী লীগের এই নেতার মন্তব্য।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খোন্দকার আবদুর রশীদ ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের রুমে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খুন করার কথা জানিয়ে দম্ভোক্তি করেছিল। এজন্য তখনই তাকে গ্রেফতার করা উচিত ছিল উল্লেখ করে শেখ সেলিম বলেন, রহস্যজনক কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকে খুনি সেনা কর্মকর্তারাও বক্তৃতা করেছে। এই সাহস ওরা কোত্থেকে পেয়েছে? শেখ ফজলুল করিম সেলিম বললেন, বঙ্গবন্ধু ডাকার পরও যেসব সেনা কর্মকর্তা সাড়া দেননি, তাদের চিহ্নিত করে তদন্ত চালাতে হবে। ওই তদন্তে কারও বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা এবং ইচ্ছা করেই বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য কোনো ভূমিকা নেয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া গেলে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৩৪ বছর পেরিয়ে গেছে। যদি সম্পূর্ণ বিচারকার্য সম্পন্ন হয়, তাহলে অপরাধীরা বুঝতে পারবে অতীতের মৃত্যু নেই। অতীত কখনও অতীত হয় না। অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না। আমার বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্ত : শফিউল্লাহ্ হ সজল জাহিদ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময় সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগকে নতুন চক্রান্তের উৎস হিসেবে বিবেচনা করছেন।

তিনি বলেন, এখনকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে তখনকার সেনাবাহিনীকে মিলিয়ে ফেলার কারণেই অনেকে অনেক রকম অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তার কাছে আগে থেকে কোনো তথ্যই ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে হুশিয়ার করা হলেও সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে তখনও তিনি কিছুই জানতেন না। গতকাল শনিবার সেনানিবাসে নিজ বাসভবনে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক সেনাপ্রধান নানাভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করেও সাহায্য না পাওয়ার বহু দিনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাহায্য চেয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোন করেননি।

বরং তিনিই খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করেন। গতকাল শনিবার সেনানিবাসে নিজ বাসভবনে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ সংশ্লিষ্ট নানা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হওয়ার পর খবর পাওয়ার সময় সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবির প্রেক্ষাপটে এসব অভিযোগ আসছে কি-না সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই বলে সমকালকে বলেন তিনি। তিনি বলেন, এসব অভিযোগে স্বাধীনতার শক্তি দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনকারীদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি তোলেন। বৈঠকে কেএম শফিউল্লাহ্ও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তখন এর কোনো প্রতিবাদ জানাননি তিনি। কিন্তু গতকাল সমকালকে বলেন, ফজলুল করিম সেলিম যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সেই একই দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তিনি। এটি যদি সেলিমের নিজস্ব অভিযোগ হতো তাহলে তিনি নিজেই এ বিষয়ে তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারতেন।

আর এটি যদি দলের বক্তব্য হয় তাহলে তাকে দলে রাখা কেন? তিনি বলেন, তাহলে তো আর আমার আওয়ামী লীগ করা চলে না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ৩৪ বছর পর এ বিষয়ে অভিযোগ তোলায় তার সন্দেহ হচ্ছে। তিনি বলেন, ফজলুল করিম সেলিমের সঙ্গে একসঙ্গে ট্রেজারি বেঞ্চে বসেছি আমি। বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার বিষয়ে কথাও হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি কেন এমন বক্তব্য দিলেন সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই বলে বলেন তিনি।

প্রথমে শেখ সেলিমের বক্তব্য সম্পর্কে দল এবং দেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া দেখে তারপর নিজের বক্তব্য দেবেন বলেও পরে নিজেই আবার সমকালকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন তিনি। তিনি বলেন, তিনি ক্ষুব্ধ তবে হতাশ নন। সময় বুঝে এ বিষয়ে তার পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন বলেও সমকালকে বলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার পর খবর আগে থেকে না পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, \'৭৪ সালের পর থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই) আর তার হাতে ছিল না। ডিজিএফআই সরাসরি রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে চলে যাওয়ায় আগে থেকে কোনো তথ্য পাননি তিনি।

তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমি অন্ধ এবং বধির হয়ে যাই। মাঝে মাঝে কিছু তথ্য হয়তো অন্য সূত্রে পেতাম। তা দিয়ে আর যা-ই হোক রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু তখন সামরিক বাহিনীরও সর্বাধিনায়ক ছিলেন। সে হিসেবে নিজ বাহিনীর প্রধানকে রক্ষা না করতে পারায় তার কোনো অনুশোচনা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, খারাপ লেগেছে।

কিন্তু এখানে আমার কোনো ব্যর্থতা নেই। আমি আমার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তাছাড়া রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও আমার ওপর ছিল না। সেনাবাহিনীর বিশেষ একটি অংশের ওপর এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার পর টেলিফোন করে বঙ্গবন্ধুর সাহায্য চাওয়ার পরও তার এগিয়ে না আসার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে টেলিফোন করেছিলেন কথাটা ঠিক নয়।

বরং আমিই অনেক চেষ্টার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। \'টেলিফোন তুলেই বঙ্গবন্ধু বললেন, শফিউল্লাহ্ তোমার ফোর্স বোধ হয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভব কামালকে মেরে ফেলেছে। দ্রুত ফোর্স পাঠাও। উত্তরে আমি বলি, স্যার আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি।

আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন? তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ পেলাম। তারপর বেশ কয়েক মিনিট আমি হ্যালো হ্যালো করেছি। কিছুক্ষণ পর বেশকিছু গুলির শব্দ শুনলাম। ধারণা করলাম তিনি হয়তো আর নেই।

\' বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সকাল ৮টার দিকে আমার এডিসি হুমায়ুন কবীর আমাকে প্রথমবার নিশ্চিত করে জানাল, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। এর আগে সেনাপ্রধান হয়েও তিনি কোনো খবর পাননি। তবে খবর পাওয়ার সময় তিনি তার কার্যালয়ে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়া এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালাতে তিনি ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে সেখানকার সৈনদের মধ্যে আনন্দের আভা দেখতে পান। তিনি বলেন, ততক্ষণে ওই সৈন্যরাও খুনিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।

নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বেতারে দেওয়া তার বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, সকাল ৮টার পর আমি যখন ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দিকে ছুটে যাই তখনও কিছু একটা করা যায় কি-না সেই চেষ্টা চালাই। কিন্তু মেজর রশীদ এবং মেজর হাফিজ আমাকে বেতারে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাপাপি করে। বেতারে গিয়ে দেখি সেখানে আগে থেকেই খোন্দকার মোশতাক অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানান এবং কাজ শেষ হওয়ায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু তার অভিনন্দনে বিরক্ত হয়ে বেতার থেকে বেরোতে চাইলে মেজর ডালিম আমার পথরোধ করে।

ওখানে উপস্থিত থাকা তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের লিখিত বক্তব্য আমাকে পাঠ করতে হয় এবং তা রেকর্ড করা হয়। বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হওয়ার প্রথম খবর পাওয়া সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের একটি ফোর্সের এই কমান্ডার বলেন, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে তিনি পরিচালক মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (ডিএমআই) কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে প্রথম খবর পান। খবর পেয়েই সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ পাঠালেও তারা সৈন্য মুভ করেনি। বরং জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে শাফায়াত জামিল আলোচনা করেছে বলেও জানান তিনি। এমনকি টেলিফোনেও তিনি শাফায়াত জামিলকে পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল আহমেদের সঙ্গে কথা বলে তাকে নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরপর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলে তারাও তার নির্দেশ পালন করেননি বলে দাবি করেন কেএম শফিউল্লাহ্। তিনি স্বীকার করেন, নিজ বাড়িতে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা লোক দেখে বঙ্গবন্ধু হয়তো তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সব সময় আত্মবিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল বলে দাবি তার। নিহত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর আশপাশে তিনিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন_ এ কথা বারবার জোর দিয়ে বলেন তিনি।

তিনি ছাড়া অন্য কোনো বাহিনীর প্রধান হিসেবে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে রাখা হয়নি। চক্রান্তের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সুযোগ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীতে থেকে অবসর নেওয়ার পরও মেজর ডালিম সামরিক পোশাক পরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ করেছিলেন এবং তার দফতরে গিয়ে দরজায় লাথিও মারেন_ এসবকে তিনি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মনে করেন। মেজর ডালিমকে গ্রেফতার করার সুযোগ পেয়েও তা না করা সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিস্থিতি কখনওই সে রকম ছিল না। তারা আমার সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে কথা বলেছে।

\'৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেওয়ার আগের সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা মনে করেছিলাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) তার ওপর আক্রমণ চালাতে পারে, তবে নির্দিষ্ট কোনো খবর আমাদের কাছে ছিল না। তবে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার নুরুল ইসলামও বলেছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া তখন মাসে দু\'বার বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতে সেনানিবাসের মধ্যে সৈন্যরা নাইট ট্রেনিং করত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। এই সুযোগও চক্রান্তকারীরা নিয়েছিল। তাতে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রদূত হয়ে দেশ ত্যাগ করা সম্পর্কে শফিউল্লাহ্ বলেন, পরিস্থিতির কারণে একরকম বাধ্য হয়েই তাকে দেশ ত্যাগ করতে হয়। তিনি বলেন, ১৯ আগস্ট বাধ্যতামূলকভাবে অবসর দেওয়ার পর থেকেই আমার ওপর বিদেশে যাওয়ার জন্য চাপ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীও তাকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেন। কিন্তু বারবার এমন চাপ উপেক্ষা করলেও ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতা জেলখানায় নিহত হওয়ার পর তার পক্ষে আর দেশে থাকা সম্ভব ছিল না। সে কারণেই রাষ্ট্রদূত হতে রাজি হন বলে জানান তিনি।

সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে কারা লাভবান হয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেন, তৎক্ষণাৎ কয়েকটি পদোন্নতি হয়। এর মধ্যে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। এইচএম এরশাদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। তাছাড়া জেনারেল ওসমানী তখন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন।

আগে কখনও সেনাবাহিনীতে না থাকলেও তিনিই প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদ তৈরি করেন এবং বিডিআর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালিলুর রহমানকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি দিয়ে এই দায়িত্ব দেন। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দস্তগীরকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে বিডিআরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেন। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সময় তিনি নানাভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেন। কখনও তাকে বেশ বিব্রত বলে মনে হয়।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।