আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এইসব আবোল তাবোল-৩ [অর্থময়ভাবেই অর্থহীনতার জীবন , অসীম’দা, জানি না কি বলবো]

সবকিছুতেই নির্মোক থাকছি, সবকিছুই ইদানীং অর্থহীন মনে হয়; নিজের এই নেতিবাচক প্রবণতায় নিজেই লজ্জিত । :(

একটা ক্ষুদ্র ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখি। লেখাটি দীর্ঘ, এলোমেলো এবং পুরোপুরি ব্যাক্তিগত দিনলিপি ধরনের। শনিবার>> জানি এইটাই জীবন। প্রচন্ড ক্লান্তিতে মেঝেতে শুয়ে পড়ি এবং সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ি।

সকাল থেকেই ব্যাপক দৌড়াদৌড়ি, আম্মুর চোখের অপারেশান পরবর্তী ফলোআপ নিয়ে। তাও শান্তি , দুঃশ্চিন্তার যা ছিলো সেটা কেটে গেছে। ক্লান্ত ঘুম কিংবা তন্দ্রার মাঝেই একটা সুর টের পাই। অবচেতন থেকে সচেতনে সেটা যে আমার মুঠোফোনের সংকেতধধনি, সেটা বুঝতে একটু সময় নেয়। লাফ দিয়ে ঊঠি, ছোটকাকার নাম্বার।

ফোনের ওপাশ থেকে শুনি দাদা এখন ল্যাব-এইডে। এমনিতেই অসুস্থ, এখন জটিলতা চরমে। অস্নাত-অভুক্ত অবস্থাতেই রওনা দেই। এক ফাঁকে কিডনী ফাউন্ডেশানেও যেতে হয়; ব্যাচেলর জীবনের ফ্ল্যাটমেট এর মা খুব অসুস্থ, গতকাল এসেছেন সুদূর উখিয়া থেকে। পরবর্তী তিনদিন কাটে ল্যাব-রিপোর্ট-নির্ঘুম-ডাক্তার-অস্থিরতা নিয়ে।

অফিসে যাই লাঞ্চের পর, তিনদিনই সকালের পর এক্কেবারে রাত বারোটায় খাওয়া, কাস্টমার অফিস থেকে রাত এগারোটায় বের হয়ে গাড়িতেই ঘুমের শুরু। তারপরেও খারাপ লাগে না। জানি এইটাই জীবন। সোমবার>>অহেতকু শুন্যতাবোধ, অহেতকু বেদনাবোধ? ইউনিতে থাকতে রানা ছিলো আমার জাস্ট ক্লাসমেট। হলে বা ক্যাম্পাসে আলাদা করে কখনো ওর সাথে খুব বেশী আড্ডা দিয়েছি বলে মনে পড়ে না , ঘুরতে যাওয়া ও হয়নি তেমন একসাথে।

রানা সোজা বাংলায় যাকে বলে মারপ্যাঁচহীন উরাধুরাঘুরা ছেলে। আবার আমাদের ক্লাসটা ছিলো আসলেই একটা একক পরিবারের মত (আমরা বলতাম সিএসই৯৯পরিবার ; বাকী সব ডিপার্টমেন্ট আমাদের দেখে চরম ঈর্ষাম্নিত থাকত)। খেতে গেলে আমরা মোটামুটি চল্লিশজন একসাথে যেতাম (সর্বমোট ৬২), আড্ডা দিতে বসলেও সেই সংখ্যায়। তাই সবাইই মোটামুটি অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ; অন্য অর্থে। এখনো আছে প্রায় সেইরকম; যদিও ছড়িয়ে পরা অপসৃয়মান জীবন সবার।

পাস করার পর আমরা দুজনই এক ‘চৈনিক বহুজাতিক’এ যোগ দেবার পর দুজন বসতে শুরু করলাম দুই ফুট দুরত্বে। তখনই বোঝা গেলো , আমিও মোটামুটি তারফারবিহীন আগপাশতলাবিহীন পাব্লিক। ধুমধাম অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে আউলা বাউলা হাঁটা, হঠাৎ করেই পান্থপথের চিপায় বা মিরপুর দশ বা ইচ্ছে হলো তো প্রস্তুতিবিহীন সিলেটের বা চট্টগ্রামের দিকে বেরিয়ে পড়া আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। গত মাস ছয়েক বেচারা বড় অস্বস্তিতে ছিলো, খালাম্মার পুনঃ পুনঃ তাগাদা আর হুমকিতে, তার স্বাধীন জীবন আর কারো সহ্য হচ্ছে না। কিছুটা উদ্বিগ্ন ও, কারণ ব্রাত্য নারীজাতির কোন নমুনাটি তাকে অধিকার করে বসে এই নিয়ে।

সেই রানাকে আচম্বিত ‘জবাই’ করে দিলেন খালাম্মা, দুই ঘন্টার নোটিশে , চট্টগ্রাম নিয়ে। ‘জবাই’ যে ভালো হয়েছে সেটা বুঝি তার কথায়। অচেনা বালিকাটির জন্য তার নাকি বিস্তর ‘মায়া’ ও জন্মিয়াছে। ( কি প্রবৃদ্ধি !) যাক একটা গতি হয়ে গেলো ভাদাইম্মা ছেলেটার। ভালো লাগে।

আবার মনের মাঝে কেমন জানি একটা শূন্যতা বেদনা চাড়া দেয়। আর কি হবে হুটহাট আড্ডা বেরিয়ে পড়া? নাকি আস্তে আস্তে যার যার জীবন নিয়ে অপসৃয়মানতা? বুধবার>> ছাই ছিটিয়ে দুঃখ খোঁজা? জানি না কি ভূতে পেয়েছিলো। নিজের একমাত্র কেনা সনি এরিকসন সেটটি , যেটা আম্মু ব্যবহার করেন এখন; অনেক দিন পর হাতে নিলাম। কেন জানি না, পুরনো মেসেজগুলো পড়া শুরু করলাম। হঠাৎ এক বড়ভাইয়ের প্রায় বছরখানেক আগের করা বিশাল একটা এসএমএস আবার পড়লাম।

পড়ে অদ্ভুত বিষন্নতায় আক্রান্ত হলাম। নিজের এথিক্স, দায়িত্ববোধ সবকিছুই কেমন জানি অর্থহীন মনে হচ্ছিলো। আমাদের প্রচলিত সব ধারণাকেই, বিশেষত সামাজিক ধারণাগুলোকে একবার ‘পুনঃসংজ্ঞায়িত’ করা দরকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনেক পরিবর্তিত এখন। দুঃখবোধ থেকে অভিমান- সেটা আব্বু আম্মুর উপরে; ক্ষোভ –সেটা নিজের উপরে। সেই বিষন্নতাবোধের অনুরণন চলছেই।

শুক্রবার >> জীবনের প্রাপ্তি ছোট ছোট সম্পর্ক আর স্মৃতিগুলো ? বিষন্নতাবোধের অনুরণন আর নানাকাজের চাপ ক্রমাগত চলছেই। এক মামার বিয়ে, চট্টগ্রাম থেকে বা ঢাকা থেকে কেউ যেতে পারবে না, ফেণীর সবাই এখানে। তাই সাব্যাস্ত করলাম শুক্রবার গিয়ে সেদিনই ফিরে আসবো, সামাজিকতা পালনের নিমিত্ত। বৃহঃস্পতিবার যাওয়া হয়নি,বাউন্ডুলের মত গুলশানপাড়ার অফিসগুলোতে কাটিয়েছি। অনেএএক দিন পর গ্রামের চিরাচরিত বিয়ে খেলাম, কাদামাখা পথে সুবেশ সবার আতঙ্কজড়ানো চলা,হাউ কাউ করে খাওয়া, কুশল জিজ্ঞাসা করতে করতে হাত আর গলা ব্যাথা হয়ে যাওয়া এইসব অনুসঙ্গ নিয়ে।

বিকেলে বৃষ্টির সাথে লুকোচুরি খেলে খেলে ( বৃষ্টি বরাবরই জেতেঃ আমরা বেরোই , সে নামে, আমরা কোথাও ঢুকি, সে চুপ মেরে বসে থাকে)। বিকেলে লীনা আপার বাসায় যাওয়া- আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণ, মিডিয়া, ব্যাংকিং,ইতি-ইত্যাদি, সৌরভকে পচানো আর ব্লগ এইসব নিয়ে কিছু ভালো সময়। ৯৬ এর পাফোসভার পর এই প্রথম দেখা হলো ওনার সাথে। (একটা ভুল হয়ে গ্যাছে, লীনা আপার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ) রাতে পাথার থেকে বয়ে আসা বাতাসের জন্য কালভার্টের আড্ডা, বিয়েবাড়ির হুল্লোড়,বিশাল পুকুরে এপার ওপার দুবার সাঁতার (বাকী দুজন পাড়ে দাঁড়িয়ে পানি ছিটায় শুধু !) সব মিলিয়ে ভাবি – জীবন মানে কিছুই না , জীবনের মানে ছোট ছোট সম্পর্ক আর স্মৃতিগুলো।

শনিবার>> অসীম’দা, জানি না কি বলবো। কারওয়ানবাজারের জ্যাম শেষে পান্থপথের ব্যাচেলরনিবাসে নামি, গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের গলিতে ঢুকতে যাই। বান দিকের আসিয়ানা আর সাইফুরসের সামনে মামীর চা দোকান থেকে হাঁক আসে, ‘... ভাই, চা খাবেন?’ অনেক সময় রাতে ফিরে হাল্কা রাগারাগি। বাজার করার কথা ছিলো অসীমদার, স্বভাবতই ভুল করে ভুলে গিয়েছেন উনি, বুয়া এসে বসে আছে। ছুটির দিনে মহা উৎসাহে ঘর পরিস্কার অভিযান, তারপর মাঝপথেই ক্ষান্তি... জন্মদিনে ছুরি এর অভাবে বটি দিয়ে কেক কাটা, তারপর আমার পরিত্যক্ত বিজনেস কার্ডগুলোকে চামচ হিসাবে ব্যবহার করে আইসক্রীম খাবার প্রতিযোগিতা, অসীমদা বরাবরই ফেলটুস, বিশেষত আরাফাত ভাইয়ের কাছে... রাত দেড়টায় আবাসের সদস্যেদের মাসিক মিটিং, আড্ডা... শেষ হবেনা এই লিষ্ট।

দুটি বছর ভাইয়ের মত আমরা কজন ছিলাম একসাথে, মাত্র দুমাস আগে আমি ছেড়ে এসেছি পান্থপথের ডেরা। আমাদের মাঝে একমাত্র বড়ভাই অসীমদা। কিছুটা শান্ত হয়ে আসা মনে ঢাকা থেকে ফোন পাই, যে ফোন করেছে সে চারমিনিট কোনো কথা বলে না, তারপর গলাকে ছাপিয়ে যাওয়া কান্নায় যা বুঝি – অসীমদা আর নেই। কি অবিশ্বাস্য কথা। আমি অনেকক্ষণ আমার গ্রামের রাস্তায় স্থানু দাঁড়িয়ে থাকি, সব আবছা হয়ে আসে আমার।

কোনো বোধই আসে না আসলে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আম্মুকে ফোন দেই অবশেষে, আম্মুর সাথে অসীমদার দেখা হয়েছিলো একবার , ঢাকায় আসার পর। আম্মু ডুকরে কেঁদে ঊঠেন। পান্থপথের ডেরার কাউকে কল করার সাহস হয় না আমার, আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, এমনকি আমার কান্নাও পায়নি। উনত্রিশ বছর বয়সে হঠাৎ করে কারো চিরপ্রস্থানকে কি দিয়ে বুঝাই।

কক্সবাজারের বাড়িতে অসীমদার দাহকাজে যেতে পারি নাই। আজ পর্যন্ত কাউকে কল করতেও সাহস করতে পারি নাই, জানি না কি বলবো কীভাবে সামলাবো। যন্ত্রের মত তিনটি দিন, অহেতকু দুষ্টামির চেষ্টা, অহেতকু ভুলে থাকার চেষ্টা । আজ সকালে ফেসবুকে হঠাৎ অসীমদার প্রোফাইল দেখে ভরা অফিসে নিজেকে সামলাতে পারিনি। বুক ফেটে আগ্নেয়গিরি, কিচ্ছু আর বাঁধ দিয়ে রাখতে পারছি না।

জীবন আসলে অর্থময়ভাবেই অর্থহীন, একটা গেমের মতই। জানি কিছুই থেমে থাকবে না আবার এটাও জেনে গেলাম - কোন কিচ্ছুরি কোন অর্থ নাই, বয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। [ গতবছর অসীমদার আইডিয়ায় পোষ্টের ছবিটি তোলা, নতুন ক্যামেরায় তখন বিচিত্র সব পরীক্ষার শখ। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।