আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালোবেসে যাই, ভালোবাসি তাই

আমিই হিমু। এই সাধারন বাস্তবের হিমু। দরজার ওপাশে, পারাপার, দ্বিতীয় প্রহর, নীল পদ্ম আর ঝি ঝি পোকার হিমু নই। ভালোবেসে যাই; ভার্সিটির প্রথম দিন। ছোট্ট শহর নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া চোখে ঢাকা’র সব কিছুই নতুন।

পরিপাটি করে আঁচড়ানো আমার চুল, শার্ট ইন করা প্যান্টে। গলায় ঝুলিয়েছি টাই, পায়ে ঝকঝক করা শু। আমার মতো আরো কিছু মফস্বলের মফিজ দেখতে পেলাম কোণাকাঞ্চিতে বেমানান হয়ে বিব্রত বসে আছে। অবাক বিস্ময়ে দেখছি ঢাকাইয়া পোলা’দের। কি কথাবার্তার স্টাইল !! জটিল জটিল বিষয় নিয়ে ইংলিশ বাংলায় তুমুল আড্ডা! কান পেতে শুনতে চাইলাম, কিন্তু উড়ে গেল মাথার উপরের মফস্বলের আকাশ দিয়ে।

এই আজব চিড়ীয়াদের মধ্যে নজর কাড়লো এক ছেলে। রং চটা ছেড়া ফাটা জিন্স, বড় বড় চুল; এলোমেলো, উড়াধুরা। কিছুটা চুপচাপ। রোমেন। আমাদের মধ্যে এই রোমেন আর জুয়েল; দুজনই শুধু প্রেম করতো; আর দুজনের প্রেমিকার নামই এক; বর্ষা! এ নিয়ে প্রেমিকাহীণ আমরা; কত ভয়াবহ আঠারো প্লাস ফাজলামি যে করেছি ইয়ত্তা নেই।

রাশেদ, সাকিব, কমল, রাসেল, ফুয়াদ ; ততদিনে রাজধানী আর মফস্বলের ব্যাবধান ঘুচিয়ে প্রবল বন্ধুত্বের বেড়াজালে আটকে গেছি সবাই। যে মহল্লায় আড্ডা দিতো রোমেন’রা, সেখানে গলির মুখে রাস্তা ছিল ভাঙ্গা। একদিন এক রিকশাওয়ালা নিপুণভাবে ঠিক সেই গর্তে ল্যান্ড করালো তার রিকশা, আর ছিটকে পড়লো আরোহী মা, মেয়ে। সুন্দরী মেয়েটিকে ধরতে সবাই দৌড়ে যেতেই দাড়িয়ে গেল সে, মহিলা তখনো চিৎপটাং। তারপর ডাক্তার, হাসপাতাল, ক্যাব ভাড়া, পূর্ণচোখে তাকানো, পরিচয়, নাম জানা, ঠিকানা ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রতিবেশী মহল্লার প্রতিবেশিনী সে; বর্ষা। এভাবেই ছিল শুরু। খুব সিরিয়াস প্রেম ছিল রোমেন’এর। ক্লাসের ফাঁকে চান্স পেলেই ফোন, একটু পর পর মেসেজ, আর আড্ডা থেকে নিয়মিত গায়েব হয়ে যাওয়া। কত যে গালি দিয়েছি ওকে ডেটিং বঞ্চিত হিংসুটে এই আমরা! কোথায় ডেটিং করিস জানতে চাইলে বলতো না, ছবি দেখতে চাইলেও দেখাতোনা, বলতো, ‘নজর লাগিয়ে দিবি’।

যদি বলতাম, আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে শালা। রোমেন হাসতো, বলতো; ‘তোদের মত বদমাশ’দের সাথে আমার ডার্লিং’এর পরিচয়? অসম্ভব!!’ আমরা আবার গালি দিতাম! ভার্সিটিতে হঠাত করেই পেছনে পড়ে গেল রোমেন। রেজাল্ট খারাপ হতে লাগল, ক্লাসে হোল অনিয়মিত, আরো চুপচাপ, নিজের ভেতর। সেমিস্টার’টাই ব্রেক দিয়ে দিল। বন্ধুরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম।

বুঝতে পারলাম না কিছুই ওর এই অন্তর্মুখীতার কারণ। দেখা হোল না আর অনেকদিন। আমরা এগিয়ে গেলাম। মেজর’এর চাপ এসে পড়লো। আমি মার্কেটিং মেজর নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম।

সাথে হারিয়ে গেল প্রতিদিনের আড্ডাটা। নতুন বন্ধু হোল না আর। ভার্সিটি তখন শেষের দিকে। একদিন রোমেন’কে খুঁজে পেলাম ক্যাফেটেরিয়ায়। আড্ডা মারছে, সবাই একসাথে, আগের মতোই।

হৈহৈ করে উঠলাম অনেকদিন পর। খুনসুটি, পচানো, হাসাহাসি। রোমেনের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডেটিং কেমন চলে দোস্ত?’ হঠাত চা’য়ের কাপে চামচের আওয়াজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। রাশেদ’রা কেউ মোবাইল টিপতে, কেউ এসাইনমেন্টের খাতায় ব্যাস্ত হয়ে গেল। আর রোমেন পুরনো সেই হাসিমাখা মুখে বললো, ‘আবার জিগায়! ডেটিং চলে মানে?...দৌড়ায়।

প্রতি শুক্কুরবার, বাদ জুম্মা, আজিমপুরে। মিস নাই। হাহাহা’ ওর ক্লান্ত স্বর কানে বাজলো না আমার একটুও। মফস্বলের বোকা এই আমি হাসতেই থাকলাম। পরিচিত গালি দিয়ে বলে উঠলাম; ‘মানষে শুক্কুরবার দোয়া কালাম পড়ে, আর তুই যাস ডেটিং’এ?’ সাকিব উঠে এসে আমার কাধে হাত রেখে বলে, ‘চল, বিড়ি টেনে আসি’।

বাইরে এসে মুখোমুখি দাড়ায় সাকিব, ‘তুই জানিস না?’ আমি একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আকাশ থেকে পড়ি, ‘কি জানিনা রে?’ ‘বর্ষা তো নেই। মরে গেছে মেয়েটা গত বছর। ’ চমকে উঠি আমি। ‘লিউকোমিয়া ছিল ওর। রোমেনের সাথে পরিচয়ের আগে থেকেই।

বেশিদিন বাঁচবে না জানতো। আর জানতো রোমেন’ও। ’ আমি তাকিয়ে থাকি বোধশূণ্য হয়ে। সিগারেট জ্বলতে থাকে। ‘সব জেনেই বর্ষা’কে ভালোবাসতো।

দুজনেই জানতো যেকোন দিন শেষ হয়ে যাবে সব। শেষদিকে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল মেয়েটা, ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। ওর পাশে থাকার জন্যই সেমিস্টার ব্রেক দিয়েছিল রোমেন। কিন্তু, শেষ দেখা হয়নি। জানিস, এখনো প্রতি শুক্রবার আজিমপুরে বর্ষার কবরের পাশে যায় রোমেন।

দাড়িয়ে থাকে চুপচাপ...’ আমার চোখে সাকিব আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে, সিগারেট জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেছে কবেই... ভালোবাসি তাই; আমাদের স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে শহীদ হয়েছিল নিশান; বিয়ে করে ফেলেছিল!! অনার্সের মাঝেই। যখন আমরা শুধু ‘বিয়ে’ বানান’টুকুই করতে পারতাম, কল্পনাও করতে পারতাম না! লম্বা, ফর্সা আর সিল্কী চুল; নায়কোচিত চেহারা তার। ক্রিকেটে যখন পেস বোলিং করতো, তখন শুধু মেয়েরা না, আমরাও কাত হয়ে যেতাম; হিংসায়। নিশানের শুধু চেহারা নয়, সাহস’ও যে বাংলা সিনেমার নায়কের মত তা বুঝতে পারলাম, যখন সে ছাত্রাবস্থায় এবং বেকারাবস্থায় পারিবারিকভাবে বিয়ে ম্যানেজ করে ফেললো; এক কঠিন যুদ্ধের পর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিশান আর নায়ক থাকেনি, আমাদের কাছে সে হয়ে উঠেছিল মহানায়ক।

একটি মেয়ে। তানিয়া। তাকে ভালোবাসতো সে। তাদের ভবিষ্যত সুখের স্বপ্ন ধাক্কা খেল, যখন তার এই ভালোবাসার মানুষটির শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়লো। ওভারী’তে।

ব্যায়বহুল আর যন্ত্রণাদায়ক চিকিতসা। এবং কখনো মা হতে না পারার, নাড়ি ছেড়া কষ্ট না পাবার ঝুঁকি। নিশান আর তানিয়া – দুজনে সিদ্ধান্ত নিল, বেঁচে থাকার অধিকার ছিন্ন হবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার; একসাথে। তাদের বিয়েটা ছিল অনিশ্চিত বাকি ক’টা দিন, প্রতিটা দিন; একজনের হাত, আরেকজনের কখনো না ছাড়ার অকৃত্তিম শপথ। সর্বশক্তি দিয়ে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে একসাথে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিল দুটি পরিবার।

এই অমানুষিক যুদ্ধে কখনো মলিন দেখিনি প্রিয় এই বন্ধুর মুখ। দাম্পত্যের আর যুদ্ধের এই বছরগুলোতে কখনো জিতে যাচ্ছিল তারা, কখনো হেরে যাচ্ছিল। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের কথা। এ জগতে যার যার দুঃখ, যার যার যুদ্ধ; শেষ পর্যন্ত তার তারই। এরপর একদিন সকালে সূর্য উঠেছিল বিষন্ন হয়ে।

সেদিন হেরে গিয়েছিল নিশান আর তার ভালবাসার মানুষটি; পুরোপুরি। ভালোবাসা, আদর আর স্নেহের সমস্ত ডাক উপেক্ষা করে সে চলে গিয়েছিল, কে জানে; কিসের টানে? শেষ দেখা হয়নি নিশান আর তানিয়ার’ও। শেষ রাতে শেষ বেলায় বাকরুদ্ধ তানিয়া, তখন ক্লান্ত দুচোখ দিয়ে খুঁজছিল কাকে; ঘিরে থাকা এত মানুষের ভীড়ে? আজীবন তার হাত ধরে থাকার শপথ করা মানুষটিকে? কোথাও ছিলনা সে। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম নিশান’কে; চার বেহারা’র পালকিতে যখন তার বধূ উঠতে যাচ্ছে শেষ বারের মত। কি ভাবছে সে? কিভাবে সহ্য করছে, যখন সে জানে; এই শেষ দেখা! সেই প্রিয় মুখ আর দেখতে পাবে না সে; কোনদিন ইচ্ছা হলেও; সব কিছুর বিনিময়ে হলেও! নিশানের সৌভাগ্য হয়নি কখনো নিজের বউ’কে নিয়ে বেড়াতে যাবার, অন্যেরা যেমন যায়।

ভালোবাসার ওই মুখটাতে হাসি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে খুব কম; দেখতে হয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে থাকার লড়াই। তবু তার আফসোস ছিলনা একবিন্দু। নিশানের সৌভাগ্য তো একটাই; সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েছে; একান্ত নিজের করেই। ক’জনের এই সৌভাগ্য হয় একজীবনে?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.