আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাকুহাচি বাঁশীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আমরা বলি কৃষ্ণের বাঁশী; অনুষঙ্গটা প্রেমের। আবার আধ্যাত্মিকতারও-ঐ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের ব্যাপার আর কী ... আসলে বাঁশী জিনিসটার অনুষঙ্গটা তেমনই-নিখাদ স্পিরিচুয়ালিটির ...জাপানের জেনসাধুদের শাকুহাচি বাঁশীর টানা-টানা কাঁপা- কাঁপা অলীক সুর আরও একধাপ এগিয়ে ...কেন? বলছি। সেই ২৫৬ খ্রিস্টপূর্বেই প্রাচীন ভারতের মৌর্য সম্রাট অশোকের আন্তরিক উদ্যোগে বৌদ্ধধর্ম পৌঁছে গিয়েছিল চিনে ।

বৌদ্ধধর্ম তারপর জাপানে পৌঁছল; ঐতিহাসিকগনের মতে, খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে। এরপর আজ অবধি ধর্মটি জাপানে সসম্মানেই টিকে রয়েছে। তবে, ধর্মটির রুপ অনেকখানি বদলে গেছে। জাপানে বৌদ্ধধর্ম কে বলা হয়- জেন বুডইজম। জেন কেন? জেন শব্দটা চৈনিক শব্দ চেন-এর জাপানি প্রতিশব্দ।

‘চেন’ আবার সংস্কৃত ধ্যান শব্দের চৈনিক প্রতিশব্দ। ধ্যান>চেন>জেন। তার মানে জেন মানেও ধ্যান। তা হলে জেন বুডইজম = ধ্যানী বৌদ্ধদর্শন। যা হোক।

জেন বুডইজম -এর ব্যাখ্যা বৌদ্ধধর্মের মূলধারা থেকে ঈষৎ ভিন্ন এবং যা হয়-কালে কালে জাপানে জেন বুডইজম -এর অনেক ক'টা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় । এর মধ্যে অন্যতম ছিল ফুকে জেন স¤প্রদায়; ছিল বলছি-তার কারণ জেন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব এখন আর নেই। তার কারণ? তার কারণ, মেইজি রেস্টরেশন বলে জাপানের ইতিহাসে একটি অধ্যায় আছে। মেইজি রেস্টরেশন আসলে তৎকালীন জাপানের সেনাসমর্থিত রাজবংশের বিরুদ্ধে বিপ্লব; যা সংগঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। (১৮৬২/১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে) বিপ্লবের ফলে সেনাসমর্থিত রাজবংশের পতন ঘটে।

শুধু তাই নয়-নতুন সরকার কর্তৃক ফুকে জেন স¤প্রদায়ও নিষিদ্ধ হয়। কেন? সে সব প্রসঙ্গে পরে আসছি। জাপানে ফুকে জেন স¤প্রদায়ের উদ্ভবের কাল খ্রিস্টীয় ১৩ শতক । ফুকে জেন স¤প্রদায়ের সাধুদের বলা হয়: কোমুসো। বাংলায় কোমুসো-এর অর্থ: শূন্যতার পুরোহিত।

আসলে বৌদ্ধদর্শনের মূলেই রয়েছে এক ধরনের শূন্যতার ধারনা। কোমুসোদের ধরণধারনও ছিল অদ্ভূত। বিশেষ করে মাথার টুপিখানি; চারকোনা, বাক্সের মতন-যা সমস্ত মাথাই ঢেকে দেয়। কোমুসো। বাংলায় কোমুসো-এর অর্থ: শূন্যতার পুরোহিত।

এই ছবিই আজও জাপানের প্রতীক হয়ে আছে। তা সমস্ত মাথা ঢাকার কি কারণ? জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা। আমরা একটু পরেই দেখব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এই সাদাসিধে সাধুদের কি বিপাকে ফেলেছিল জাপানের সৈন্যবাহিনী। জেন বুডইজম এর অর্ন্তগত স¤প্রদায় বলেই ফুকে জেন স¤প্রদায়ের শূন্যতার পুরোহিতগন অনিবার্যভাবেই ধ্যান করতেন। সেই ধ্যানের নাম ছিল সুইজেন (ইংরেজিতে ব্লোয়িং মেডিটেশন)।

ব্লোয়িং কেন? ফুঁ দেওয়ার অর্থেই ব্লোয়িং। শূন্যতার পুরোহিতগন এক ধরনের বাঁশী বাজিয়েই ধ্যান করতেন । সেই বাঁশীর নাম: শাকুহাচি। শাকুহাচি। পাঁচটি ফুটো।

কেন? শাকুহাচি তৈরি হয় কেবলমাত্র পেনটাটনিক স্কেল বাজানোর জন্য। পেনটাটনিক স্কেল কি? পেন্টা শব্দটি গ্রিক; পেন্টা মানে পাঁচ। (আমরা পেন্টাগনের নাম শুনেছি) জাপানে তৎকালে পাঁচ স্বরের পেনটাটনিক স্কেল প্রচলিত ছিল । (আজও আছে) শাকুহাচি বাঁশী তে মাইনর পেন্টাটনিক বাজানো হত। মেজর পেন্টাটনিক হচ্ছে- সা রে গা পা ধা সা।

নিয়মানুযায়ী ‘গা’ আর ‘ধা’ স্বর দুটি কোমল (বা ফ্ল্যাট) হলেই স্কেলটি মাইনর হয়ে যাবে। সা রে জ্ঞা পা দা সা। বিশ্বজুড়েই মাইনর পেন্টাটনিক স্কেলটি ভীষন জনপ্রিয়। মনে থাকার কথা: বৌদ্ধধর্ম জাপানে পেীঁছেছিল খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে। শাকুহাচি বাঁশীও তেমনি চিন থেকেই জাপানে এসেছিল।

জাপানে এসে শাকুহাচি বাঁশীর অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। এখন জাপানি শাকুহাচি আর চৈনিক হাকুহাচির মধ্যে অনেক তফাত। দেখলেই বোঝা যায় -শাকুহাচির শরীরটি নিখাদ বাঁশের। (আজকাল নাকি প্লাসটিকেরও হয়! কাঁচেরও হয়!) মজার কথা হল; শাকুহাচি বাঁশীর নামের মানেটা এসেছে বাঁশীটির আকার থেকে। ‘শাক’ু অনেকটা ফুটের মত; আর, ‘হাচি’ মানে আট।

১.৮ শাকু; প্রায় ৫৫ সেন্টিমিটার দীর্ঘ। যা হোক। সেকালে, অর্থাৎ, মধ্যযুগের জাাপানে ফুকে জেন স¤প্রদায়ের শূন্যতার পুরোহিতরা শাকুহাচি বাজিয়ে কেবল ধ্যানই করতেন না-নগরে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষেও করতেন; আর, যেতেন তীর্থে । তারা গানও করতেন। ওঁদের গানকে বলা হত: হোনকিওকু।

এক্ষুনি বললাম যে, শাকুহাচি বাজিয়ে ভিক্ষে করতেন শূন্যতার পুরোহিতরা । এ নিয়ে বিখ্যাত একটা গানও নাকি আছে - ১ ২ ৩ ভিক্ষের পাত্র যায় ... যাহোক। মধ্যযুগের জাপানের রাজবংশ ছিল সেনাসমর্থিত। তো সেই স্বৈরাচারী সেনাপতিকে-আমরা কমবেশি জানি- বলা হত শোগুন; আর শোগুনের দপ্তরকে বলা হত শোগুনেট। তো, জাপানি জনগনের ওপর নানান নিষেধাজ্ঞা জারি করত শোগুনেট ।

এর মধ্যে অন্যতম হল, আর্ন্তরাষ্ট্রীয় চলা লের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এতে করে ফুকে জেন সম্প্রদায়ের শূন্যতার পুরোহিতরা পড়লেন বিপাকে। কেননা, সারা জাপানজুড়েই ফুকে জেন সম্প্রদায়ের তীর্থ ছড়িয়ে, আর্ন্তরাষ্ট্রীয় চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে তো আর তীর্থে যাওয়া যাবে না। এখন কি করা? অনেক ভেবেচিন্তে জেনসাধুগন শোগুনেট-এ তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। শোগুনেট-এ গিয়ে তাঁরা বললেন, মহাত্মন, সারা জাপানজুড়েই ফুকে জেন সম্প্রদায়ের তীর্থ ছড়িয়ে আছে।

আর্ন্তরাষ্ট্রীয় চলা লের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা তীর্থে যেতে পারছি না। আমরা হলাম কোমুসো। নিছক শূন্যতার পুরোহিত। আমাদের ওপর থেকে আর্ন্তরাষ্ট্রীয় চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক মহাত্মন । শোগুনেট-এর তৎকালীন প্রধান আধিকারিক কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল।

সে ছিল ভারি কুটিল লোক। ক্ষাণিক ভেবে সে বলল, ঠিকাছে। ঠিকাছে। অত ভাবনা কি। আপনারা সাধুসন্ত আছেন।

আপনাদের ওপর থেকে আর্ন্তরাষ্ট্রীয় চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। আপনাকে আমাদের সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। প্রতিনিধি দলের এক সাধু বললেন। তবে একটা শর্ত আছে। শোগুনেট-এর তৎকালীন প্রধান আধিকারিক বলল।

আজ্ঞে, হ্যাঁ বলুন, কি শর্ত? প্রধান আধিকারিক, আমাদের হয়ে ফুকে জেন স¤প্রদায়ের সাধুদের গুপ্তচর গিরি করতে হবে। এই কথা শুনে নিশ্চয়ই ফুকে জেন সম্প্রদায়ের সাধুদের শরীর ঘৃনায় রি রি করে উঠেছিল। তারা সব জগৎবিচ্ছিন্ন মানুষ-মাথা ঢেকে রাখে। যাই হোক। জেন সাধুরা সেনাসমর্থিত সরকারের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করেছিল কি না তা বলতে পারছি না।

তবে একমাত্র ফুকে জেন সম্প্রদায়ের ওপর থেকেই আর্ন্তরাষ্ট্রীয় চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল শোগুনেট। শুধু তাই নয়, সমস্ত জাপানজুড়ে ফুকে জেন স¤প্রদায়ের সাধুদের ছদ্মবেশ পড়িয়ে সরকারি স্পাই মাঠে নামিয়েছিল শোগুনেট ! একটা যুদ্ধ চলছে সব সময়। সে কারণেই সৎ সাধুরা সরকারি ফাপড় থেকে বাঁচবার জন্য দারুন এক বুদ্ধি আঁটলেন। তাঁরা শাকুহাচি বাঁশীতে কঠিন কঠিন কিছু সুর তৈরি করলেন। কেন? কারণ।

যদি তুমি সুরটা বাজাতে পার তো তুমি শূন্যতার পুরোহিত; নৈলে তুমি হতচ্ছাড়া শোগুনের বলদ- মানে গুপ্তচর! একটা যুদ্ধ চলছে সব সময়। যা হোক। তখন আমি বলছিলাম যে মেইজি রেস্টরেশন বলে জাপানের ইতিহাসে একটি অধ্যায় আছে। মেইজি রেস্টরেশন আসলে সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব; যা সংগঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। (১৮৬২/১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে) বিপ্লবের ফলে সেনাসমর্থিত রাজবংশের পতন ঘটে।

শুধু তাই নয়-নতুন সরকার কর্তৃক ফুকে জেন সম্প্রদায়ও নিষিদ্ধ হয়। এর কারণ নতুন সরকার চাইছিল শোগুনের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করতে। কে শোগুন আর কে ফুকে জেন সম্প্রদায় -তখন ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। শাকুহাচি বাজানোও সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হয়। পরে অবশ্য আবার শাকুহাচি বাজানোর অনুমতি দেওয়া হয়।

আজকাল কোটোর (জাপানি তারযন্ত্র) সঙ্গে শাকুহাচি বাজানো হয়। এতে আর কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। যে শাকুহাচির এমন বিস্ময়কর ইতিহাস- সেই বাঁশীটিকে কি সারা বিশ্বের লোকে জানবে না? হ্যাঁ, কুড়ি শতকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে শাকুহাচি । একজন শ্রেষ্ট অ-জাপানি শাকুহাচি বাদক হলেন আমেরিকান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লুট প্লেয়ার রিলে লি; এ বিষয়ে তাঁর প্রতিভা ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তিনি ২০০৮ এর জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে “বিশ্ব শাকুহাচি উৎসব” -এর আযোজন করেন।

রিলে লি কেবল একজন গুণী বংশীবাদকই নন- তিনি মহামতি বুদ্ধদেবের বাণী হৃদয়ের গভীরে গভীরভাবে উপলব্দি করেছেন যেমন জাপানের মধ্যযুগের ফুকে জেন সম্প্রদায়ের শূন্যতার পুরোহিতগন মহামতি বুদ্ধদেবের বাণী হৃদয়ের গভীরে গভীরভাবে উপলব্দি করেছিলেন। রিলে লি শাকুহাচি বাজিয়ে কম্পোজ করেছেন ‘বুদ্ধের স্বপ্ন। ’ বুদ্ধের স্বপ্ন। বুদ্ধের স্বপ্ন -এর নয়টি পর্ব আছে। ভালো লাগলে ডাউনলোড করে নিন।

রিলে লি; বাঁয়ে। ডানে গিটারিস্ট জেফ পিটারসন। ইউরোপেও সেই আশির দশক থেকেই শাকুহাচি ভীষনই পপুলার। এনিগমার ‘স্যাডনেস’ নিশ্চয় শুনেছেন? ঐ বিস্ময়কর কম্পোজিশনটায় যে বাঁশীটি বেজেছে সেটিই শাকুহাচি । অবাক হলেন? স্যাডনেস এক রুমানিও কম্পোজারের মাধ্যমে মহাকাল আমাদের সময়ে পবিত্র শাকুহাচি কে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

আসলে এই কথাটি বলতেই আমি এত কথা বললাম! গত ১৮/১৯ বছর ধরে এনিগমার সুরটি আমরা শুনছি। অথচ আমরা কি জানি বাঁশিটির নাম শাকুহাচি?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.