আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“পৌষ এর কুয়াশা-মাঘের কুয়াশা”



পৌষ এর শেষ দিক প্রায় । শীতের আমেজ উপভোগ করার মতই। অনেক ভোরে, যখন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে সকাল খুঁজতে বেড়োয় গাছিরা, তখন এই শহরটাতেও গ্রামের ভেঁজা মাটির গন্ধ মেলে ! নাগরিক কোলাহল শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক আপন মনে হয় এই ভোরের শহরটাকে; ভিতরে কোথায় যেন আঁচর কেটে যায় এই ভেঁজা ভোরের শহর । ঠাঁয় উপরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মনির । দু’ একটা কথোপকথন চলে মাঝে মাঝে ।

কিন্তু দেখতেই বেশি ভালো লাগে তার । এক সময় তার মনে হত সে এরকম এক জন গাছি হবে । তর তর করে সুদক্ষ কৌশলে খেজুর গাছের চূড়ায় উঠে বসবে । তারপর ধাঁরালো দা দিয়ে খুব মোলায়েম করে গাছ থেকে একেকটা পরত খুলবে; যখন প্রথম রসের ফোঁটাটা চুঁইয়ে পরবে, সেটার গন্তব্য হবে অবশ্যই তার জিহ্বা । আহ ।

কিন্তু না । তার সেই স্বপ্ন কখনই পূরণ হবে না । তার গাছে উঠা নিষেধ । তার আরও অনেক কিছুই নিষেধ। পানিতে নামা নিষেধ; আগুনের কাছে যাওয়া নিষেধ; এইটা নিষেধ; সেইটা নিষেধ ।

সেই ছোট কাল থেকেই মৃগী রোগী হওয়ায় এই বাঁধা-নিষেধগুলো তার উপর চেপে বসেছে ! এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। “কাকু, কাইলকা আইনযে, কতা কমু নে, অহন যাইগা । মামানি যাইবার কইছলো । দেরী অইয়া যাইব গা । ’’ গাছি কালু মিয়াকে চেঁচিয়ে বলে মনির।

-“ইট্টু রস খায়া যা......। ’’ -“ কাইলকা, আইজ না । ’’ হন হন করে হাঁটা দেয় মনির । ফজল মামার বাড়ির পথে । ফজল মামার বউ ভাল মহিলা ।

তাকে অনেক স্নেহ করেন । গত শীতে তাকে একটা লাল চাদর দিয়েছিলো । মনির কোথাও বেড়াতে গেলে সেটা পড়ে । আর অন্য সময় ট্রাঙ্কে তুলে রাখে ; কাউকে সে এটা পরতে দেয় না । ফজল মামার বাড়ি বিল্ডিং ঘর ।

তার ছাদে ছোট্ট হারিচায় লাউ গাছ লাগানো আছে । মনিরকে দিয়েই লাগিয়েছিলেন মামি । আর এখন লাউ পাড়ার জন্যই মামি তাকে ডেকেছেন । মনির বেছে বেছে লাউ পেরে নীচে জমা করবে । তারপর কিছু রেখে বাকীগুলো বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাবে ।

এমনিতেই তাকে বাজারে যেতেই হয় । এক কাজে দুই কাজ হয়ে গেল । প্রতিদিনের রুটিনটা ঠিক এমনটি হয় না মনিরের । ৭ টা বাজে চরপাড়ার বাজারে যায় সে । হাতে দু’তিনটে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে সারা বাজার ঘুরে বেড়ায় ।

বড় বড় সবজি দোকান থেকে শুরু করে ছোট ছোট খুচরা বিক্রেতার সবজির ডালার নীচে তার নজর থাকে । টুকটাক কুড়িয়ে নেয় ডালার পাশে পড়ে থাকা একটা কাঁচা মরিচ, একটা পিঁয়াজ, একটা আলু , কিংবা একটু ধনে পাতা । দোকানীরা তাতে বাধা দেয় না । তাদের অত সময় নেই । এইভাবে চলে দুপুর পর্যন্ত ।

ফাঁকে কয়েক জনের বাজার করে দিয়ে আসে। আয়তন খালা, আঙ্গুরি বু’ অথবা সেলিম কাকার বাসায় । এরা সবাই তাকে অনেক স্নেহ করেন । অনেক । এইভাবে কুঁড়ানো সবজি, আনাজপাতিগুলো তখন সে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে ।

মনির অনেক গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন ছেলে বলে গৃহিনীরা ওগুলো নির্দ্ধিধায় কিনে নেয় । কিনে নেয়ার আরও একটা কারণ, অনেক সস্তায় পাওয়া যায় সবজিপাতিগুলো । মনিরকে এক দুই টাকা যাই দেয়া যায় সে হাসিমুখে রেখে দেয় । তার আর খরচ কী । দুপুরে ফজল মামার বাড়ি আর রাতে কমিশনারের বাড়িতে খায় ।

রাতে থাকে কমিশনারের গোয়ালঘরের পাশের ছোট্ট একটা ঘরে ; ঐ ঘরে খড়ির বোঝাই রাখা; তার একটা কোনা তার জন্য বরাদ্ধ । সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই, বাপ-মা ট্রাকের চাপায় মারা যাবার পর থেকে সে এখানেই আছে । বেশ ভালোই আছে । বাইশটি বসন্ত তো এভাবেই কাটলো । তার বাবা মা যখন মারা যায় তখন পাড়ার মুরুব্বিরা বলতো, এই অবুঝ বাচ্চাটাকে একা ফেলে না গিয়ে হতভাগারা বাচ্চাটাকে নিয়েই মরত ।

তারা তো মরে গিয়ে বেঁচে গেল; বাচ্চাটার কী হবে । মনির সেটা মনে করে না । সে বেঁচে থাকতে চায় । সবার মত করে । শুধু যখন মৃগী রোগটা শুরু হয়; তখন ভীষণ খারাপ লাগে তাঁর ।

হুটহাট রাস্তায় পড়ে খিচুনী শুরু হয়ে যায় । তার গলায় তাবিজের মত করে চামড়ার এক টুকরা বাঁধা । যখন তার খিচুনী চলতে থাকে তখন কেউ একজন এসে সেটা তার নাকে ধরলে আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসে শরীর । বিধ্বস্ত অবস্থায় উঠে আসে একসময় । কষ্ট ।

ভীষণ কষ্ট হয় সে সময় । পশ্চিম পাড়ায়; বাজারের উত্তর দিকটায়, ফজল মামার বিশাল পুকুরে মাছের চাষ আছে । কার্প মাছের চাষ করেন তিনি । মাছের চাষ করে কম সময়ে আর্থিক সচ্ছ্বলতার মুখ দেখেছেন তিনি । এ জন্য এলাকায় যেমন তার সুনাম আছে, তেমনি রয়েছে অযাচিত শত্রু ; সুযোগ পেলেই তারা তার ক্ষতি করতে ছাড়ে না ।

এই যেমন গত মৌসুমে তার ভরা পুকুরটায় কে যেন বিষ ছেড়ে দিল । পরদিন সকালে পুকুরে ভেসে উঠলো হাজার হাজার মরা মাছ । চিৎকার করে কেঁদেছিল সেদিন ফজল মিয়া । পরে যখন জানতে পারল কাজটা কে করেছে , বিচার নিয়ে গিয়েছিল কমিশনারের বাড়ি । বিচার হয় নি।

হওয়ার কথাও না । দায়ী ব্যাক্তি যে স্বয়ং কমিশনারের চাচাত ভাই । কমিশনার ভাল লোক ; কিন্তু সমাজ সংসার এর বাইরে কেউ তো না । ফজল মিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল । তাই সবাই যখন তাকে পুলিশে নালিশ করতে বলেছিল সে যায়নি ।

উপর ওয়ালা সব দেখুক; ঊনিই যা করার করবেন । তাই বলে এই মৌসুমে তিনি হাত পা গুটিয়ে বসে নেই । দিনে রাতে টহলের ব্যবস্থা করেছেন । তার পরও বাড়তি নিরাপত্তার জন্য রাতে পুকুর পাহারার জন্য তিনি মনিরকে বেছে নিয়েছেন । তার মত বিশ্বস্ত সাহসী ছেলে পাওয়া ভার।

তবে তিনি মনিরকে বলে দিয়েছেন সে যেন পুকুরের পানির কাছাকাছি না যায় । মনির কখনও যায় না। দূর থেকে সারা রাত পাহারা দেয় । ব্যপারটা প্রথম চোখে পড়ে গাছি কালু মিয়ার । দেখে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় ফজল মামার বাড়ি।

ধীরে ধীরে পুরো এলাকায় খবরটা ছড়িয়ে পড়ে । কালু মিয়া কান্নার দমক থামিয়ে থামিয়ে মাঝে মাঝে বর্ণনা করতে থাকে কীভাবে সে পুকুরপাড়ের খেঁজুর গাছে ওঠার সময় লাশটা প্রথম দেখতে পায় । পাড়ের দিকের পানিতে উপুর হয়ে ফুলে থাকা মনিরের লাশটা দেখে যেন মনে হচ্ছিল সে ঘুমিয়ে আছে- সে এটাও বলে । খেজুরের রসের প্রতি মনিরের যে প্রবল আগ্রহ ছিল-কাঁদতে কাঁদতে সেটাও সে বার বার সবাইকে জানিয়ে দেয় । সবার চোখের কোনায় অশ্রু চিক চিক করে ।

লাশ নিয়ে প্রথমে একটু কলরব উঠে । কেউ বলে, যারা আগেরবার পুকুরে বিষ দিয়েছিলো তারাই এবার পথের কাঁটা দূর করেছে । অনেকেই কথায় সায় দেয়; হুল্লোড় ওঠে । আবার এক সময় শান্ত হয়ে যায় সব । কেউ বলে হঠাৎ মৃগী রোগ ওঠায় পানিতে পড়ে মরেছে মনির ।

‘আহারে’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় চারিদিক । এক সময় সেটাও থেমে যায় । মাঘ মাসে যেই রকম শীত পড়ার কথা, সেই রকম শীত পড়েনি । কিন্তু ভেঁজা শহরটা ঠিকই গ্রামের চাদর গাঁয়ে দিয়ে একটা একটা করে ভোর উপহার দিয়ে যায় । কালু মিয়া খেঁজুর গাছে উঠে; রস নামিয়ে নতুন হাঁড়ি বসায় ।

মাঝে মাঝে তার হঠাৎ মনে হয় নীচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে । আচমকা পিছন ফিরে তাকায় সে । না কেউ নেই । একটা কুয়াশাসিক্ত ভোর কেবল পেছনে । কুয়াশায় অনেক সময় কাছের জিনিস দেখা যায় না ।

আবার অনেক সময় দূরের, অনেক দূরের কাউকে দেখা যায়..। । - মিশা । মে,২০০৯....


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।