আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আনু মুহাম্মদের ক্ষুদ্র ঋণের ভাওতা নিয়ে প্রবন্ধ ছাপানোয় সাপ্তাহিক ২০০০ সম্পাদককে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনায় বাধ্য করার প্রতিবাদ জানাই, জানাই ধিক্কার

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

সাপ্তাহিক ২০০০ এর ২২ মে ২০০৯ এর সংখ্যায় ‘ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ বাণিজ্য’ শিরোনাম দিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং ঐ সংখ্যাগুলো বাজার থেকে তুলে নেওয়া বা সমস্ত কপি বিভিন্ন স্টল থেকে কিনে নেওয়া হতে পারে এই ভয়ে আমার ব্লগে আমি সেটি পুনঃপ্রকাশ করি।

কিন্তু আমার আশঙ্কার থেকেও খারাপ ঘটনা ঘটেছে। ২০০০ এর সম্পাদক তাদের বর্তমান সংখ্যায় গ্রামীণের কাছে প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। সঙ্গে অবশ্য গ্রামীণ ব্যাংকের তরফে একটি মামুলি প্রতিবাদও ছাপা হয়েছে। বিষ্ময়ের কিছু নাই। এদেশে সম্পাদক/প্রকাশক/ সাংবাদিকদের অনেকেরই মেরুদণ্ড নামক বস্তুটি নানান মধুমেহনে অনেক আগেই গলে গেছে।

তা নিয়ে নতুন দুঃখের কিছু নাই। কিন্তু ব্যাপারটি অন্য দিক থেকে ভয়াবহ। গ্রামীণ তার প্রতিবাদ পাঠাবে, তার সঙ্গে লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি গুলোও ছাপা হবে, এই শিষ্ঠাচারও আমরা আশা করি না। কিন্তু চাপের মুখে একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিকের সম্পাদককে প্রকাশ্যে অন্যায় ভাবে ক্ষমা চাইয়ে তাকেসহ পত্রিকাটিকে খোলাবাজারে ন্যাংটো করার এই দাপট অসহনীয় ঘৃণ্য ও বাংলাদেশের সংবাদজগতের এক কলঙ্কজনক ঘটনা। আমি এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাই এবং আপনাদেরও সামিল হওয়ার আহ্বান জানাই।

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আনু মুহাম্মদের বক্তব্য সঠিক বা বেঠিক সেটি বিচারের জায়গা রাখা হয়নি। আমরাও সেদিকে যাচ্ছি না। আমাদের প্রতিবাদের বিষয়, অতিকায় কর্পোরেটের কাছে মুক্ত সাংবাদিকতার এরকম নগ্ন আত্মসমর্পণ। পুঁজির এরকম আধিপত্য এদেশের মুক্তচিন্তা প্রকাশের পরিবেশের ধ্বংসেরই প্রমাণ। আর এই হলো নোবেল বিজয়ী গরিবের ব্যাংকার, সেনাশাসনের বরপুত্র, কৃষকের মেহনত চোষণকারী, বুশ-রামসফেল্ড-ক্লিন্টনদের পেয়ারের বান্দা ড. ইউনূসের চেহারা।

আনু মুহাম্মদের প্রতিবাদপত্র সাপ্তাহিক ২০০০ এর ২২ মে ২০০৯ এর সংখ্যায় প্রকাশিত আমার লেখা ‘ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ বাণিজ্য’ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের একটি প্রতিবাদ একই পত্রিকার ৫ জুন ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু বাগাড়ম্বর ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এই পত্রে আমার লেখা সংশ্লিষ্ট দুটো বিষয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়। প্রথমত, তাঁরা বলছেন ‘গ্রামীণ’ নামের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কোনভাবেই গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত নয়। বলছেন, ‘১৯৮৩ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রফেসর ইউনুস দেশের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বিভিন্নরকম প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠানের নামকরণে তিনি সবসময় ‘গ্রামীণ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

’ এভাবে সম্পর্কহীনতা দেখানোর চেষ্টা খুব কার্যকর নয়। বাণিজ্য জগত সম্পর্কে যাদের ন্যুনতম ধারণা আছে তাঁরা জানেন, এখানে কোন বাণিজ্যসফল নাম, গুডউইল, যোগাযোগ, ক্রেডিবিলিটি টাকাপয়সার পুঁজির চাইতে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক এধরনের কোন কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে গ্যারান্টি দিয়েছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সুবিধার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক ও ‘দারিদ্রবিমোচন’ সুনাম ব্যবহার করা হয়েছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাজারজাতকরণে ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করে এর গ্রহীতাদের ব্যবহার করা হয়েছে সেসব তথ্য খুব দুর্লভ নয়। স্থানাভাবে এসব বিষয়ে বিস্তারিত এই লেখায় যায়নি। আশা করি শীগগিরই এগুলো নিয়ে আলাদা লেখা প্রকাশ করতে পারবো।

তবে এখানে এতটুকু বলা যায় যে, গ্রামীণ ব্যাংকের সামগ্রিক বিষয়ে ঋণগ্রহীতা লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষ এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের ধারণা স্বচ্ছ করবার সবচাইতে ভাল ও ‘অফিসিয়াল’ উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত সব অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা। আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তথ্য অধিকারের প্রতি সন্মান জানিয়ে জনস্বার্থে এগুলো প্রকাশ করবেন। দ্বিতীয়ত, আপত্তি করা হয়েছে সুদের হার নিয়ে। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন, শুণ্য হারে ভিক্ষুকদের ঋণ দেয়া হয়। বস্তুত আমার প্রবন্ধে সুদের হার নিয়ে বিশেষ কোন আলোচনা করা হয়নি।

শুধু বলা হয়েছে, ‘ক্ষুদ্রঋণের সুদ বিভিন্ন হিসাবে এবং সংস্থা ও ক্ষেত্র ভেদে গড়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ। ’ এটি আমি উল্লেখ করেছি বিভিন্ন গবেষণার বিভিন্ন হিসাব সারসংক্ষেপ করে। আর সুদের হারের উল্লেখ করবার সময় দেয়া হয়েছে গড় হিসাব। স্বভাবতই খুবই ক্ষুদ্রসংখ্যক ঋণগ্রহীতা নিয়ে ভিক্ষুকদের ঋণদানের ‘বিশেষ প্রকল্প’ কোন আলাদা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়নি। আমার এই লেখায় বরং মূল আলোচনা করা হয়েছে কিস্তি আদায়ের নিয়ম ও নিপীড়ন নিয়ে।

এবং কেন কী কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে এই মডেলটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তন বা নারীর ক্ষমতায়নে অকার্যকর হয়ে পড়ে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বিষয়ে অবশ্য গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন আপত্তি প্রকাশ করেননি। আমি আমার লেখায় সামগ্রিকভাবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল এবং নির্দিষ্টভাবে গ্রামীণ ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করেছি। এই পর্যালোচনায় তথ্যসূত্র হিসেবে আমি ব্যবহার করেছি এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রকাশনা এবং গত এক দশকেরও বেশি সময়ে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা। আমার লেখার মূলদিকগুলো ছিল: (১) ক্ষুদ্রঋণ বিশ্বব্যাপী কীভাবে বিস্তৃত হয়েছে তা পরীক্ষা করা, (২) এই বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে তার সম্পর্ক, (৩) এসম্পর্কে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী, (৪) ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিতভাবে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার উদ্ভব ও তার বিস্তার, (৫) ঘোষিত মূল লক্ষ্য দারিদ্র বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে এই কার্যক্রমের ফলাফল পরীক্ষায় বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা, (৬) ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা ও কিস্তি আদায়ের মাঠ পর্যায়ের চিত্র।

উপরের দুটো বিষয় ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই লেখায় সন্নিবেশিত তথ্য, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোন দ্বিমত প্রকাশ করেননি বা প্রতিবাদ জানাননি। এই হিসেবে বিভিন্ন গবেষণা, মাঠকর্ম এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তথ্যাবলী বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, ‘........অতএব বৃহৎ বাণিজ্যের একটি সফল মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল অবশ্যই স্বীকৃতি পেতে পারে। কিন্তু দারিদ্র বিমোচন কিংবা নারীর ক্ষমতায়নে এর সাফল্যের দাবি ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক’ তা তারা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন। একই সংখ্যায় গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এই প্রতিবাদপত্রের নীচে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে সাপ্তাহিক ২০০০ এর সম্পাদকের যে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ মুদ্রিত হয়েছে তা খুবই করুণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, লেখার প্রতিবাদ মুদ্রণের পর লেখক হিসেবে আমার বক্তব্য ছাপার কথা।

কিন্ত তার আগেই সম্পাদক যেভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তাতে ক্ষমতার দাপটের কাছে তাঁর পরাজয় ও আত্মসমর্পণই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আনু মুহাম্মদ অর্থনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৭ জুন ২০০৯

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।