আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইকোর খেরোখাতা (৩)

Let the wind blow out the candles
আগের পর্ব - ১ ২ চেয়ারে হেলান দিতে দিতে আমি বললাম, আমি রবোট নই! টেবিলের ওপাশে বিষ্ফোরিত চোখজোড়ায় দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় ঘটে গেল। মেয়েটি খপ করে আমার হাত ধরে বলল, কসম বল তুমি এদের কেউ না! আমি মেয়েটির চোখের দিকে তাকালাম। সম্ভাবনার প্রত্যাশার স্বপ্ন ওর চোখে ঝিকমিক করছে। ছেলেটির দিকে তাকালাম, ও মনে হয় কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। আমি ওদের দিকে ঝুকে বললাম, আমি রবোট নই! মেয়েটা অধৈর্য্যের মত আমার হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল, তাহলে? মানুষ? রক্তমাংসের মানুষ? আমাদের মত? আমি হেসে দিয়ে বললাম, এত দ্রুত এত আশা করে ফেল না।

আমি বায়োবট। আধা যন্ত্র- আধা মানুষ। তবে আমার মানবিক অংশ পুরোপুরি অক্ষত একথা জেনে রেখ। ছেলেটি আমার দিকে ফিরে বলল, আপনি এখানে কি করছেন? আমি গলার টাইটা হালকা করতে করত চেয়ারে হেলান দিলাম। যাক, এদের প্রাথমিক ধাক্কাটা সহ্য করাতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।

আরামদায়ক চেয়ারটায় পুরোপুরি নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে বললাম, সে এক বিশাল ইতিহাস। রবোটরা মানুষদের অপসারণ করেছে প্রায় শতক হতে চলল। সেই সময় থেকেই পিঠ ঠেকে যাওয়া কিছু পালিয়ে বেড়ানো মানুষের গোষ্ঠী এই গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এত বছর ধরে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখা খুবই কঠিন- আর এই প্রতিকূল পরিবেশে তো প্রায় অসম্ভব। আমরা যে কয়েকজন টিকে আছি, তারা শেষ পর্যন্ত এক হতে পেরেছি।

এখন আমাদের মূল লক্ষ্য রবোট সভ্যতা ধ্বংস করা। এখানকার ক্লোন ল্যাবরেটরিতে যে বিশাল তথ্যভান্ডার রয়েছে, গ্রহে মানব সভ্যতার নতুন বিকাশের জন্য সেটি যথেষ্ট নয়, কিন্তু তবু আমরা চেষ্টা করব। আর একাজে প্রথমেই আমরা ছাড়িয়ে নেব তোমাদের। কারণ রবোট সভ্যতা ধ্বংসের জন্য আমাদের শক্তি বৃদ্ধি কা দরকার। মেয়েটির দিকে ফিরে আমি বললাম, রবোটের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমরা শরীরে যন্ত্র ধারণ করেছি।

মানব সভ্যতার জন্য এতটুকু স্যাক্রিফাইস করতে আমরা প্রস্তুত। আমি আমার দীর্ঘ লেকচার শেষ করে ওদের দিকে তাকালাম। ওরা এতক্ষণ শুনছিল শুধু। ছেলেটি হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে বলল, কিন্তু রবোট দের কিভাবে অপসারণ করা হবে, সেটা বলুন। এই বিশাল রবোট সভ্যতা গুড়িয়ে দেওয়া তো আর মুখের কথা না! আমি ফ্রিকোয়েন্সি ব্লকারে চোখ বুলাতে বুলাতে বললাম, এদের আস্তানায় বসে এসব আলোচনা করা বিপজ্জনক।

শুধু এটুকু জেনে রাখ আপাতত, কেন্দ্রীয় তথ্যাগারটিই আমাদের মূল লক্ষ্য। ওখানে অবৈধভাবে ঢুকতে পারলেই পুরো রবোট নগরী আমাদের। তোমরা জান কিনা জানি না, প্রতিটি রবোটকে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে অচল করে দেওয়া যায়। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হল, কেন্দ্রীয় তথ্যাগার দখল করা। ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বললাম, আমার সময় শেষ হয়ে আসছে।

আমি তোমাদের সাথে আবার খুব শীঘ্রই দেখা করব। রবোট নগরী ধ্বংসের মাধ্যমে আবার মানব সভ্যতার সূচনা হবে এই গ্রহে! আমি উঠে দাড়ালাম। ছেলেটি আমার সাথে করমর্দন করতে করতে বলল, আমি ইকো। মেয়েটি বলল, আমি ত্রিনি। আমি পকেট থেকে একটা ক্রিস্টাল বের করে ওদের দিকে ছুড়ে দিয়ে বললাম, নেটওয়ার্কে আমার হোমপেইজটা দেখে নিও।

ওখানের একটা এনক্রিপটেড অংশে তোমরা ঢুকতে পারবে। ঐখানে আমার ব্যাক্তিগত তথ্য আছে। আমি দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললাম, ইকো আর ক্রিনি, তোমাদের সাথে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা করব, তোমরা মানসিক প্রস্তুতি নাও... একটু থেমে আমি যোগ করলাম, ঐদিন হবে তোমাদের এই নরকে শেষ দিন! ধৈর্য্যের শেষ সীমায় মনিটরের সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে বুড়ো গোছের লোকটি ভ্রু কুচকে ফেলল। ক্রিভা মাত্র ক্লোন ল্যাবরেটরি থেকে বেড়িয়েছে। বাইভার্বালে চড়ে ক্রিভা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত লোকটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।

টেবিলের ওপর পা দুলিয়ে বসা মধ্যবয়সী-দেখতে লোকটি বলল, রিও, ফ্রিকোয়েন্সী ব্লকারটি বন্ধ করে দাও। মনিটর বন্ধ করে রিও বলল, দিচ্ছি। বলে ভ্রু আবারো কুচকে ফেলল। ___________________________ ইকোর কথা রাত প্রায় দশটার মত বাজে। ক্লোন কলোনীর পার্টিটা সবেমাত্র শেষ হয়েছে, এখোনো সবাই ঘরে ফিরে যায়নি।

পার্টি অডিটোরিয়ামের কোনায় ছোট্ট টেবিলটায় আমি ক্রিনির চোখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। ক্রিনি আমার চোখের দিকে তাকালো। আগামীকাল সেই বিশেষ দিন। ক্রিভা আমাদের নিয়ে যাবে এই নরক থেকে। কিভাবে সে কি করবে সেই জানে, নিরাপত্তার জন্য সে তার প্ল্যানের বিশেষ কিছু আমাদের জানায়নি।

আমাদের সরাসরি কথা বলাও মানা, কারণ সংবেদনশীল ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন পুরো ক্লোন ল্যাবরেটরীর ওপর নজর রাখছে। আমি ক্রিনার চোখে চোখ রাখলাম। ক্রিনা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বুঝলাম ক্রিনা আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছে। কি অপূর্ব একটা অংশ মানুষের এই চোখ! আমি ক্রিনার হাতে আলতো করে একটা চাপ দিয়ে উঠে দাড়ালাম।

কাজের কাজ বাকি আছে অনেক। ঘরে ফিরে আমি ক্রিভার দেওয়া ক্রিস্টালটি হলোগ্রাফিক নেটওয়ার্কে ঢুকিয়ে ওর হোমপেইজ দেখতে বসলাম। ক্রিস্টালে দেওয়া পাসওয়ার্ড আমাকে ওর হোমপেইজের এনক্রিপটেড (গোপনীয়) অংশে ঢুকিয়ে দিল। ওর প্রায় সব ব্যক্তিগত তথ্যে সয়লাব এই অংশটি। ওর গ্র‌্যাজুয়েশন, হাসি খুশি স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বন্ধুবান্ধব সবাই।

দেখতে দেখতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। কি সুন্দর ছিল আগের এই পৃথিবী! আমারো তো ইচ্ছে করে সেই পৃথিবীতে হারিয়ে যেতে! ঘুমোতে যাবার আগে আমি শেষবারের মত আমার ঘরটির দিকে তাকালাম। একটু আগেও উত্তেজনায় আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না কিন্তু এখন হঠাৎ কেন জানি আমার ভেতরে কোন উত্তেজনা কাজ করছে না। ঝকঝকে ক্রোমিয়ামের দেওয়ালে প্রতিফলিত নিজের ছায়া দেখলাম। কোন একটা কিছু খটকা লাগছে, কিন্তু সেটা ধরতে পারছিনা।

নিজের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এর জন্যই। মাঝরাতে ক্রিনা তার রুমের দরজা খুলে আমাকে দেখে চমকে উঠে বলল, তুমি? এত রাতে .... তারপর হঠাৎ আমার চেহারা দেখে আতকে উঠে বলল, কি হয়েছে তোমার? আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ক্রিনা, যেভাবেই হোক, তুমি কাল আমাদের সঙ্গে যাবে না। কিছুতেই না। ক্রিভা দেখা করতে এলে খবর পাঠিয়ে দেবে তুমি অসুস্থ। ক্রিনা বিষ্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

এর বেশি কিছু আমি বলতে পারলাম না, কারণ সংবেদনশীল ক্যামেরাটি ততক্ষণে আমার দিকে ফোকাস করেছে। পরবর্তী পর্বে সমাপ্য
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।