কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
void(1);
আমি তখন বন্ শহরে বাস করতাম। আমার সাথে পরিচয় হয় মারীয়া নামের একটি ছোট্ট মেয়ের । ওর কাহিনী শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে এর অনেকটাই মিলে যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর ভবঘুরে রচণার সাথে। পার্থক্য সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন যুদ্ধে বাবা মা হারানো এক বাচ্চার কথা আর আমি লিখেছি এই সময়ের এক বাচ্চার কথা যার বাবা মা তার কাছে থাকে না।
তাদের দুই জনের অন্তরের বেদনা অনেকটাই এক কিন্তু বোধ ভিন্ন। কারন প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
আমি সম্পূর্ন লেখাটি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা থেকেই তুলে দিলাম। তার কাহিনীতে আছে অনেক অনেক বর্ননা। অনেক অনেক ঘটনা।
আমি তার কিছুই আনিনি এনেছি শুধু মেয়েটির কথা। তার লেখার মাঝে আমি আমার ঘটনাটা বসিয়ে দিলাম শুধু। আমার মনে হয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখাটা ছাড়া আমি মারিয়ার কথা প্রকাশ করতে পারবো না। যদি অপরাধ করে থাকি তবে সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
void(1);
আমি তখন রাইন নদীর পারে বন্ শহরে বাস করি! রাইনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য পৃথিবীর লোক সেখানে বেড়াতে যায়।
আমারও মনে হল যে কয়েকদিন আছি রাইনতো দেখবই ঐ অঞ্চলটাও ঘুরে ঘুরে ঐ এলাকার পাহাড়-পর্বত, উপত্যকার ক্ষেত খামার, গ্রামাঞ্চলের ঘর বাড়ি, গ্রামের মানুষের জীবন সব কিছুই দেখব।
গ্রামের রাস্তা অনেকটা আমাদের দেশের মতই। শীতকালে অনেক সময় এত বরফ জমে উঠে যে চলাফেরাও কয়েকদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়-- আমাদের দেশের বর্ষাকালে যে রকম হয়। শুধু বাচ্চাদেরই দেখতে পাওয়া যায় তারই উপর লাফালাফি করছে, পেঁজা বরফের গুঁড়ো দিয়ে বল বানিয়ে একে অন্যকে ছুড়ে মারছে।
গ্রামের রাস্তায় একটি বার তের বছরের মেয়ের সাথে পরিচয় হল।
মেয়েটি বেশ হাসি খুশি চঞ্চল--- নাম মারিয়া। সে একটি ছোট্ট ঠেলা গাড়ি ভর্তী করে আপেল নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে আরও তিন চারটে ছেলে মেয়ে। তারা আপেলগুলো নিয়ে যাচ্ছে আজ জ্যাম বানাবে তাই। কিন্তু তাদের আপেল তুলতে তুলতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে।
আমি ওদের সাথে গল্প করতে করতে ওদের সাথে চলছি।
সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে মারিয়ানা মেয়েটির পরিচয় হয় সম্পুর্ন ভিন্ন ভাবে। পাঠক তার ভবঘুরে বইটি পড়ে দেখবেন।
অল্প বয়স্করা কল্পনা দিয়েই সব- কিছু পুষিয়ে নেয়। আমাদের দেশের মত এরা নয়।
এদের প্রানশক্তি অফুরন্ত হ্যা এই প্রানশক্তি আমাদের দেশের বাচ্চাদের মধ্যেও দেখা যায়। তদুপরি এরা পেট ভরে খেতে পায়। জামা-জুতা এদের মধ্যেও কিছু কিছু দামী সস্তা আছে বটে তবে ছেঁড়া বা নগ্ন পদ কেউ নয়। আট বছর হতে না হতে এরা ক্ষেত-খামারের কাজে ঢোকে না। কোথায় এদের বাচ্চা কাচ্চা আর কোথায় আমাদের।
তুমি একটি ফুলের মত মনি
এমনই মিষ্টি এমনই সুন্দর
মুখের পানে তাকাই যখনি
ব্যাথায় কেন কাঁদায় আন্তর!
শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি
পড়ি এই আশিস মন্তর,
বিধি তোরে রাখুন চিরকাল
এমনই মিষ্টি এমনই সুন্দর!
কবিতাটি লিখেছেন -----হাইন্রিষ হাইনে “বুক দ্যার লীডার” থেকে নেয়া।
অনুবাদ করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই গির্জার ঘড়িতে ঢং করে একটার ঘন্টা বাজলো। বাচ্চারা তাদের জ্যাম বানানোর কাজ রেখে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।
মারিয়া আমাকে বলল "তুমিতো এদিক দিয়ে যাবে চল হাটতে হাটতে যাই এক সাথে।
"
আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম "তোমার বাবা - মা?"
অত্যন্ত সহজ কন্ঠে উত্তর দিল "বাবা ? আছে তবে আমার সাথে থাকে না, আর মা? তাকে আমি দেখিনি? দেখেছি নিশ্চই, কিন্তু মনে নাই। সে গেল যখন আমার বয়স এক মাস। " আমি তাড়াতাড়ি বললাম "দুঃখিত ! কি হয়েছিল? তোমাদের দেশেও মা মারা যায়? "
বড় জোর তের বছরের মেয়ে। কিন্তু যা উত্তর দিল তাতে আমি বুঝলাম আহাম্মুকের মত এক প্রশ্ন জিজ্ঞাস করে বিপদ এড়াবার জন্য অন্য প্রশ্ন করতে নাই।
"আমার বয়স যখন একমাস তখন আমার মা এসে আমার বাবার কাছে আমাকে রেখে চলে গেছে।
বাবা পাবে যেত মদ খেতে, তখন মার সাথে পরিচয় হয়। মা ছিল পাব গার্ল। আমাকে মা চায়নি, বাবাই নাকি আমাকে মেরে ফেলতে দেয়নি তাই মা আমি জন্মের সাথে সাথে বাবার কাছে আমাকে দিয়ে চলে গেছে। বাবা আর কি করে! মাকে খুব ভালবাসত। ভেবেছিল আমি হলে মা বাবাকে ফেলে নাও যেতে পারে।
কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ন উলটো। আর আমাকে একা একা বড় করা তো বাবার পক্ষে সম্ভব না তাই তো দাদির কাছে আমাকে রেখে গেছে।
------------------ পাঠক এটা সম্পুর্নই আমার মারিয়ার কথা ।
জিজ্ঞাস করলাম "দাদি খুব ভালবাসে, তাই না! ওর কি বেশি বয়স হয়ে গেছে। তোমাকে কোথাও বেড়াতে নেয় না।
"
মারিয়া বলল "রোববার দিন গির্জায়। অন্য দিন হলে পাদ্রী-র বাড়ি। আর মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে বাবার কাছে যায়। বাবা আমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। পরদিন বাবাসহ আবার বাড়ি আসি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মাকে যদি একবার দেখতে পেতাম, আমি নাকি ওর মত দেখতে!!!!! তাকে তো চিনিও না-----------।
ওর বলার ধরনটা এমনই সরল আর স্বাভাবিক যে আমার চোখে জল এসে গেছে। পাছে মারিয়া সেটা দেখে ফেলে তাই অন্য দিকে তাকিয়ে তাকে বললাম আমার দেশের একটা কবিতা শুনবে?
উৎসাহের সঙ্গে সে বলল নিশ্চই!
“ মনে পরা মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে;
মা গিয়েছে যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে
শোবার ঘরের কোণে,
জানালা থেকে তাকাই দূরে
নীল আকাশের দিকে
মনে হয়, মা আমার পানে
চাইছে অনিমেখে।
কোলের ‘পরে ধরে কবে
দেখতো আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে
সারা আকাশ ছেয়ে!!”
মারিয়া বলল "তোমার কবির তো মা মারা গেছে। " আমি বললাম "হ্যা। আমাদের দেশের কোন মা বাচ্চাদের কাছ ছাড়া করতে পারে না।
তাই তোমার জন্য কোন কবিতা আমার দেশের কোন কবি লেখেনি। "
এ কবিতাটা মারিয়াকে শোনানো আমার উচিত হয় নি, কিন্তু ইউরোপীয় সাহিত্যে মাকে নিয়ে কোন কবিতা আছে কিনা আমি জানিনা। আর আমার দেশের এত সুন্দর একটা কবিতা --- আমি আবৃত্তি করার লোভ সামলাতে পারিনি।
মারিয়া আমাকে বলল নাকি নিজেকেই বলল "আমি তোমার দেশের মা'দের মত হব। আমি আমার বাচ্চাকে কখনই ফেলে দিব না।
আমি অনেক বাচ্চার মা হব”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।