আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুটি- গল্প (সম্পূর্ণ)



ওরা একসাথে ওরা ছিল বেশ কজন। ছেলে কম, মেয়েরাই বেশী। সবার ত্বকই গোলাপী গোলাপী ধরণের। তবে নানা রঙের, নানা ফ্যাশনের কাপড়। কেউ ফ্রক, কেউ গাউন, কেবল একজন ছিল শাড়ি পরিহিতা।

ছেলেদের ভেতর হালফ্যাশনের টি শার্টের চল বেশী। কেউ কেউ ছিল সুটেড বুটেড। এখানেও কেবল একজনকেই পাঞ্জাবী পড়ানো হয়েছিল। নতুন জায়গায় ধাতস্থ হতে যা সময় লাগে; এরপর শুরু হয়ে গেল খুনসুটি! ছেলের দল আর মেয়ের দলে। মাঝে মাঝেই দু একজন করে বিদায় নিচ্ছিলো; সবাই খুশী মনেই অপেক্ষা করছিল তাদের পালার জন্যে।

বছর শুরুর উৎসবে অনেকেই এক সাথে বিদায় নিল। এর পর, বেশ কিছুদিন বিক্রি বাট্টা বন্ধের কারণে পরিবেশটা বলতে গেলে একটু ঝিমিয়েই পড়েছিল। ঠিক এমন এক সময়ে, তাদের দুজনের ভেতরে, আলাদা করে একটা ভাললাগা- কিভাবে যেন গড়ে উঠল। হ্যাঁ, সেই শাড়ি পরা মেয়ে পুতুল আর পাঞ্জাবী পড়া ছেলে পুতুলটার কথাই বলছি। শিরিন আর রূপককে নিয়ে আমাদের এই গল্পে, তাদের একটা ভূমিকা আছে।

তাই এদের কথাটা ভুলবেন না যেন! হাসিখুশী মেয়েটা লুবনার পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি। বিসিএস দিবে বলে সে অনার্স এ না ঢুকে, পাসকোর্সে বি কম দিচ্ছে। যারা ভাবছেন- 'বিসিএস কি এতোই সোজা, চাইলাম আর হয়ে গেলো?!' তাদের জন্য বলছি, লুবনার বিসিএস এ ফরেন সার্ভিস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। তার মতো মেধাবী একটা মেয়ে, এরকম একটা স্যুভেনির শপে সেলসগার্ল এর চাকরী করতে পারে; সেটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু আমরা যারা ওকে চিনি, তাকে ছোটবেলা থেকে বরাবরই এমন দেখে আসছি।

নিজের পৃথিবীতে সে অনেক কিছুই অনায়সে ঘটিয়ে ফেলতে পারে। সরকারী চাকুরীরত বাবা-মা, তাকে এসব ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। দুবছর হলো সে এই চাররীতে। রাজ্যের পুতুল, খেলনা, শো-পিস, ঘড়ি, আরো কত্তোকি! এসব নিয়েই লুবনার জগত। গুলশানের অভিজাত এলাকার এই দোকানে ক্রেতা যারা আসেন, তাদের সবার ব্যবহার খুবই মার্জিত (কেবল মাঝে মধ্যে দু-চারজন কুঁদোলেপানা চেহারার মহিলা ছাড়া!); তাই তার সারাটাদিন বেশ ভালোই কাটে, পড়ার সময়ও পায় প্রচুর।

তবে দিনের একটা বড় সময়, সে মেতে থাকে পুতুল গুলোকে নিয়ে। আমাদের সেই পুতুল জুটির ভালোবাসার পেছনে তার কোন অবদান থাকলেও থাকতে পারে! কে জানে! এখানে ঢোকার পর থেকেই সে শিরিন আর রূপককে নিয়মিত আসতে দেখছে। রূপক তো শপের মালিকের কেমন যেন আত্মীয়ও হয়। ওদের এনগেজমেন্ট, বিয়ে, সবকিছুই তো- তার চোখের সামনেই হলো বলতে গেলে। অনেক গিফ্‌ট কিনেছে তারা দুজনে মিলে এই দোকান থেকে।

লুবনাই তো কতোবার রূপককে গিফ্‌ট পছন্দ করে দিয়েছে। শিরিন শপে ঢুকলেই আগে লুবনাকে জিজ্ঞেস করে- 'কেমন আছো আপু?'। আচ্ছা এবার তাহলে মূল গল্পে ঢুকি। এরা সুত্রপাত হয়েছে দুদিন আগে থেকেই; আজকে সকালে এসে ঝগড়াটা পুরোপুরি বাঁধলো। ইস্যুটা তেমন বড় কিছুই না।

কিন্তু আধুনিকা বড় মামীর জন্য, শিরিন একটু বেশীই অন্ত প্রাণ। তাই রূপকের চাচীর খোঁটাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারেনি। আজকে সকালে, রূপক চাচাতো বোনের গায়ে হলুদে যাবার কথাটা তুলতেই আবার সেই প্রসঙ্গ চলে আসলো। "তুমি একলাই যাও। আমি নাহয় পরে বিয়েতে যাবো।

" "কেন? এটা কেমন দেখায়?!" কিছুটা অসহায়ই শোনালো রূপকের গলা। ছেলেরা এমনিতেও মেয়েদের এতো জটিলতা বুঝেনা, তাই না, বলুন? "উনি মুরব্বি মানুষ। আমাদের নাঁচ, গান, আনন্দ করাটা ভালো নাও লাগতে পারে। " রূপক বুঝতে পারলো , কথাটা কোন দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে! এক কথা, দুই কথায়, এভাবে বেশ লেগে গেল দুজনের ভেতর। ফলাফল: নাস্তা না করেই রূপকের অফিস গমন; আর সকাল সকালই শিরিনের বাথরুমের দরজা বন্ধ করে পানি ঢালা।

রেগে গেলে, তার নাকি আগে - মাথা ঠান্ডা করতে হয়! অফিসে ঢুকেই কাজের ধাক্কায় রূপক, প্রথমে বেশকিছুক্ষণ ভুলেই ছিল ব্যাপারটা। মনে পড়লো কলিগের অভিনন্দনে। আজ ওদের আ্যাফেয়ার ডে! মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কত সুন্দর একটা দিনের ছবি এঁকে রেখেছিলো সে গত কদিন থেকে। কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার ঘটে গেলো।

মনে মনে সে কিন্তু একটু অনুতপ্তও। দুপুরে এক ফাঁকে ঢু মারলো গিফট শপে। শাড়ি পরা মেয়ে পুতুলটাকে দেখেই তার খুব পছন্দ হয়ে গেলো। শাড়িটার রঙও হলুদ! যেন গায়ে হলুদের সাজে কোন মেয়ে! কেউ যদি ভেবে থাকেন রাগটা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারেনি দেখে, সে ইচ্ছে করেই এই পুতুলটা নিল; খুব একটা ভুল হবে না। র‌্যাপিং করে নিয়ে গাড়ীর ব্যাকসিটে রেখে দিলো সে।

অফিসে ঢুকে যথারীতি ভুলে গেলো গিফ্‌টের কথা। দুপুরে শিরিন যখন গাড়ির জন্য ফোন করলো, গিফট্‌টা না সরিয়েই পাঠিয়ে দিলো। মাথাটা ঠান্ডা করাতেই মনে হয় শিরিন কিছুটা প্রফুল্ল ছিল। সেটা আরো ঝলমলে হলো গাড়ির পেছনের সিটে র‌্যাপিং করা বক্সটা দেখে। 'এইতো আসছো চান্দু লাইনে!' -ভাবলো সে।

ক্লাশমেট ছিল বলেই বোধকরি ইচ্ছে মতো নামে ডাকে তারা দুজন দুজনকে! 'ভালো আছেন আপু?"- লুবনার হাসিটা তার খুব পছন্দের। শিরিন সারা শপ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো নতুন কী এসেছে। এই সুযোগে আমরা চলুন সেই ছেলে পুতুলটির কী খবর, সেটা দেখি। সে খুব মুষড়ে পড়েছে। সবাইকেই যেতে দিতে হবে- এটা জানা কথা, কিন্তু আজকে তার সঙ্গীটা একলা চলে যাবে এটা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিল না।

তাই শিরিন যখন গিফট্‌ খুঁজতে খুঁজতে তার সামনে এসে দাড়ালো, ছেলে পুতুলটির ভাবনা চিন্তা সব যেন হঠাৎ থমকে গেল! যদি এমন হয়?! এমনটা কি হতে পারেনা,যে - শিরিন তাকেই পছন্দ করলো?! প্রাণপণ প্রার্থনা শুরু করলো ছেলে পুতুলটা। প্রার্থনার জোরে হোক কিংবা লুবনার পরামর্শেই হোক, শিরিন ছেলে পুতুলটিকেই নিল! কেন নিল, সেটা সে নিজেও ঠিক বলতে পারবেনা। হয়তো তার অবচেতন মনে, রূপকের যে মায়াময় ছবিটা আঁকা ছিল; সেটাই সে তাকে দেখাতে চায়! কে জানে! তবে লুবনা যে খুব খুশী হয়েছে, সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি। তার পছন্দের পুতুল দুটি অবশেষে স্থায়ী জুটি হতে যাচ্ছে। আপনাদেরও কি তাই মনে হয়? তারপর ফেরার পথে গাড়িতে বসে শিরিন একটা ভুল করে ফেললো।

তেমন মারাত্মক ধরনের কিছু নয়! (আপনাদের আশ্বস্ত করছি; বৌ এর তকমা গায়ে লাগানো সব প্রেমিকারাই এই ভুলটা করে) গাড়িতে ভুল করে রেখে যাওয়া, রূপকের র‌্যাপিং করা গিফট্‌টা দেখে সে প্রথমে তো খুশীই হয়েছিলো। কিন্তু একটু পরে মনে হতে লাগলো- এর পেছনে কোন উদ্দেশ্য আছে! গিফট্‌ তো লুকিয়ে রাখাটাই স্বাভাবিক! এভাবে দেখিয়ে রাখলো কেন?! তার রাগটা আরো বাড়লো, যখন সে কিছুতেই রূপকের ভাবনাটা 'ট্রেস' করতে পারলো না। বাসায় পৌছানোর আগ পর্যন্ত, তার ভেতর দ্বিধা বেশী ছিল, না ক্ষোভ বেশী ছিল; সেটা ঠিক বুঝে উঠা গেল না। গায়ে হলুদে চেহারাটা না দেখিয়ে আসলেই নয়; তাই রূপক বেলাবেলিই চাচীর বাসায় চলে গিয়েছিল। শিরিনের মতো সেও এখানে একটা ভুল করে ফেললো।

ওকে না জানিয়েই সে অফিস থেকে সরাসরি সেখানে যায়। চাচাতো ভাই রিমনের সথে আড্ডা মারতে মারতে তার গাড়িতেই বাসায় ফিরে আসে। সন্ধ্যা তখন প্রায় শেষ, কৃত্রিম আলো ঝলমল করছে চারদিকে। প্রেমের বিয়ের জুটিরা খালি ঝগড়াই করে - এটা বোঝানোর মোটেই আমার কোন উদ্দেশ্য নেই। ওরা ঝগড়া করলোনা।

রূপক একটু ম্রীয়মান হয়েই ফুলের তোড়াটা শিরিনের হাতে দিল। শিরিন ফ্লাওয়ার ভাস সাজাতে সাজাতে জানতে চাইল- "খেয়ে এসেছো? নাকি খাবে?" কেমনটা লাগে?! সাতটার ভেতর- কোন্‌ গায়ে হলুদে আজকাল খাবার দেয়? আর তাছাড়া আজকে ওদের প্রথম কথা দেয়ার বার্ষিকী! রূপক খেয়ে আসতে যাবে কেন?! "ভেবেছিলাম তো বাইরে খাবো। " -ছেলেদের ধৈর্য্য অনেক!!! "আমি রাতে কিছু খাবোনা!" -নির্লিপ্ত উত্তর আসলো, "বাহিরে না গেলে- জেসমিনকে বললে টেবিল লাগিয়ে দিবে"'। কথোপকথন এখানেই শেষ!! রূপক রাগ চেপে রেখে খেতে বসলো। চেহারা দেখেই বোঝা গেছে রান্নাটা শিরিনের।

খাবো না, খাবো না, করতে করতেই আইঢাই অবস্থা তার!! টেবিল থেকে সোজা স্টাডি রুমে; ইন্টারনেট ঘাটতে বসে বেমালুম ডুবে গেলো ভার্চুয়াল জগতে। ওদিকে শিরিন একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলো, আড়চোখে রূপকের ভরপেট ভূড়িভোজন দেখে। কিন্তু চেহারায় তার ছাপ পড়তে দেয়নি একফোটাও। রূপককে উঠতে দেখে সেও রিমোট হাতে বসে গেলো টিভির সামনে! ঘন্টা চারেক পরের কথা, ইন্টারেস্টিং আর্টিক্যালটা শেষ করে রূপক যখন রুমে ঢুকলো, সেসময় লাইট জ্বলছিলো। টিভি সিরিয়ালের দুঃখি মেয়ে আর দজ্জাল শাশুড়ির কথা ভাবতে ভাবতে শিরিন তখন গভীর ঘুমে।

রূপকও চোখের পাতা বুজাতে আর দেরী করলো না। যারা ভাবছেন, এটা কি হলো?! ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছেন লেখকের দিকে, তাদের অবগতির জন্য বলছি; কাল, ভোর হতে না হতেই আমাদের এই দম্পতির আপাতো মানঅভিমান চুকে বুকে যাবে; এমনকি সকালে রূপকের অফিসে হয়তো একটু লেট করেই যাওয়া হবে। কেউ জানলো না, এমনকি লুবনাও হয়তো ভাবতে পারেনি; তার ভালোবাসার সেই পুতুল দুটি কোথায়। রাগের মাথায় শিরিনও গাড়িতেই ফেলে এসেছিলো তার ছেলেপুতুলটা। উপহারের চকচকা রাংতা মোড়া হয়ে পরস্পরের অজান্তে পাশাপাশি শুয়ে থাকলো ছেলেটি আর মেয়েটি।

সমাজ আর সামাজিকতার মোড়ক তাদেরও কিছু সময়ের জন্য হলেও বিচ্ছিন্ন করে রাখলো।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।