আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রিভিউ-লিটল ম্যাগাজিন : ১। ছোট কাগজ কারুজ : দীর্ঘকবিতা বিষয়ক সংখ্যা

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

শিমুল মাহমুদ সম্পাদিত 'কারুজ' সাহিত্য-শিল্প বিষয়ক পত্রিকাটি সমকালে বাংলাদেশে প্রকাশিত অসংখ্য সাহিত্য-পত্রিকার ভীড়ে স্বাতন্ত্র্যের দাবীদার। সম্পাদকের মননশীল বিষয় নির্বাচন এবং ধৈর্য সহকারে প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোর সম্পাদনা 'কারুজে'র প্রতিনিয়ত মান বেড়েছে। সম্পাদক ‘কারুজ’ পত্রিকার ক্ষেত্রে তথাকথিত গবেষণাধর্মী লেখার পরিবর্তে সৃষ্টিশীল মননধর্মী লেখার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। ফলে ‘কারুজ’ কালের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ত্রয়োদশ বর্ষের সপ্তম সংখ্যা স্বীয় ঔজ্জ্বল্যে-স্বাতন্ত্র্যে সাহিত্যরসিক পাঠকমহলে সাড়া জাগিয়েছে। তথাপি ‌'কারুজে'র বন্ধুর চলার পথ ভবিষ্যৎ কৃতিত্বের ওপর নির্ভরশীল।

তারপরও বর্তমানে 'কারুজ' সাহিত্যবোদ্ধাদের নিকট সমাদৃত রুচিশীল সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকা হিসেবে স্বীয় বিষয়-বৈচিত্র্যে স্থান করে নিয়েছে। 'কারুজে'র ত্রয়োদশ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যায় ‘দীঘকবিতা’ বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন-- শফিক আশরাফ, শিমুল মাহমুদ, রহমান হেনরী, মোস্তফা তারিকুল আহসান, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর, তৈমুর খান, ফাল্গুনী ভট্টাচার্য এবং সৈকত এম আরেফিন। এ-সংখ্যার প্রাবন্ধিকগণ তাঁদের প্রবন্ধে 'দীর্ঘকবিতা' বিষয়ে সাহিত্যতত্ত্বের একটি সরলরৈখিক সমীকরণ নির্মাণের সচেতন প্রয়াস চালিয়েছেন। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের দৈন্যের কারণে সাহিত্যের নতুন আঙ্গিক ও নিরীা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা-গবেষণা খুব একটা হয় না। বাংলা সাহিত্যে 'দীর্ঘকবিতা' বিষয়ক কাব্যচিন্তা সাম্প্রতিক সময়ের ধারণা।

পূর্বজ কবি-সাহিত্যিক ও সমালোচকগণ সচেতনভাবে কেউ-ই 'দীর্ঘকবিতা' রচনা কিংবা এর তত্ত্ব নিয়ে ভাবেননি। তবে এ কালের গবেষণালব্ধ জ্ঞান দ্বারা প্রতীয়মান হয়-- পূর্বজ কোন কোন কবির রচনায় সমকালীন অর্থে 'দীর্ঘকবিতা'র বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে বর্তমানে যে-অর্থে 'দীর্ঘকবিতা' নামক স্বতন্ত্র কবিতার কথা বলা হচ্ছে তা অবশ্যই বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন। তিরিশি কালের পর বাংলা কাব্যেতিহাসে নব্বই দশকের কবিদের প্রতিনিয়ত নতুনত্বের অন্বেষণ প্রবণতা এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে দণ্ডায়মান হওয়ার ছটফটানি পরিলতি হয়। অদূর ভবিষ্যতে তিরিশের কবিদের মতো হয়তো নব্বইয়ের কবিরাও বাংলা সাহিত্যকে নতুন মোড়ে পৌঁছে দিতে সম হবেন।

তিরিশের দশকের পরে নব্বইয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা কবিতায় অনুবর্তন-বিবর্তনের সুর ছাড়া ভিন্ন কিছু পাওয়া যায় না। তবে নব্বই দশকের বাংলা সাহিত্যের কবিতা-ছোটগল্প-উপন্যাসের বিষয়-বৈচিত্র্য এবং প্রকরণগত অভিনবত্বের অভাব নেই। বাংলা সাহিত্যের উত্তর-প্রজন্মের সামনে হয়তো নব্বইয়ের কবি-সাহিত্যিকগণ মাইলফলক হবেন। 'কারুজে'র ত্রয়োদশ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যায় বাংলা সাহিত্যের নতুন আঙ্গিক 'দীর্ঘকবিতা' নিয়ে সাহিত্যতত্ত্ব উপস্থাপন করেছে। প্রকাশিত প্রবন্ধে-নিবন্ধে তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রয়োগিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।

অর্থাৎ সাহিত্যের নতুন আঙ্গিকের তত্ত্ব এবং তার বাস্তব প্রয়োগ 'কারুজে'র এ-সংখ্যায় ঘটেছে। এ-সংখ্যায় প্রকাশিত তেরোটি কবিতা 'দীর্ঘকবিতা' কিনা তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক হবে; কেননা 'দীর্ঘকবিতা'র স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন এ পর্যন্ত সাহিত্যতত্ত্বে সুনির্দিষ্ট হয়নি। তবে তত্ত্বকে প্রতিষ্টিত করার এই ব্যবহারিক উদ্যোগ প্রশংসার্হ্য। শফিক আশরাফ 'দীর্ঘকবিতা মহাকালের এক অনিবার্য উত্থান' প্রবন্ধে নিজে পাণ্ডিত্যে-বৈদগ্ধ্যে উজ্জ্বল; কিন্তু তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু 'দীর্ঘকবিতা' ঝাপসা এবং অস্পষ্ট। তিনি ‘কবিতার রূপকল্প', 'ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রে কাব্য', 'ভারতবর্ষ কবিতার আদি উৎসভূমি', 'আধুনিক দীর্ঘকবিতার উত্থান' প্রভৃতি উপশিরোনামে প্রবন্ধটিকে বিভক্ত করে নিয়েছেন; যা গবেষণামূলক প্রবন্ধ-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক।

কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি প্রবন্ধের মূল বিষয় থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছেন। তিনি 'দীর্ঘকবিতা'র সংজ্ঞা সুদীর্ঘ প্রবন্ধেও স্পষ্ট করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে প্রাবন্ধিকের বিনম্র মা যাচ্ঞা শেষ পর্যন্ত পাঠকের প্রবল আক্রোশের মুখে তাঁকে রেহাই দিয়েছে। সম্পাদক শিমুল মাহমুদ মন্ময়ধর্মী 'দীর্ঘকবিতার বিষয়শৈলী অনুসন্ধান এবং জীবনানন্দ দাশ' প্রবন্ধে দীর্ঘকবিতা বিষয়ে যে সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করেছেন, শেষ পর্যন্ত তা সাহিত্যতাত্ত্বি ও সাহিত্য-সমালোচকগণের নিকট কতটা গ্রহণযোগ্য হবে-- তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। কেননা 'দীর্ঘকবিতা' প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিকের এই ব্যক্তিগত ধারণা কতটা যৌক্তিক, তা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।

তিনি প্রবন্ধে বলেছেন, 'দীর্ঘকবিতা' শুধু আকারে দীর্ঘ হলেই হবে না; বরং নাতিদীর্ঘ কবিতাও 'দীর্ঘকবিতা'র বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে। অথচ 'লিরিক' বা গীতিকবিতা কোনমতেই 'দীর্ঘকবিতা' নয়। তিনি মনে করেন, 'দীর্ঘকবিতা নিছক কবির আবেগ সৌন্দর্য মাত্র নয় বরং দীর্ঘকবিতা সমাজ প্রণোদিত সত্যভাষ্যের প্রতিরূপও বটে। যা পাঠককে একই সাথে উপন্যাস এবং কবিতা পাঠের আনন্দ দিতে সক্ষম। --[শিমুল মাহমুদ, পৃ. ২২] প্রাবন্ধিকের এই ব্যক্তিগত মতামতের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐক্যমত পোষণ করা যায় না।

কেননা গীতিকবিতায় সামাজিক প্রতিভাস নেই এরকম মনে করা যায় না। তাহলে প্রশ্ন হয়, কোন গীতিকবিই কি সামাজিক জীবনযাপনের 'সত্যভাষ্য' রচনা করেন নি? অন্যদিকে আবেগহীন বস্তুনিষ্ঠ লেখাই যদি 'দীর্ঘকবিতা' হয়-- সেক্ষেত্রে 'মহাকাব্য'কে 'দীর্ঘকবিতা' বলতে অসুবিধা কোথায়? এ ধরনের অসংখ্য তাত্ত্বিক জটিল প্রশ্নের জন্ম দিয়েও শিমুল মাহমুদের সৃজনশীল প্রবন্ধটি ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তাঁর প্রকল্পিত ‘দীর্ঘকবিতা’ বিষয়ক ধারণার সাথে যুক্তির দুর্জ্ঞেয় জটিলতা সৃষ্টি হলেও প্রাবন্ধিকের ব্যক্তি-প্রতিভাকে উপোর অবকাশ নেই। শিমুল মাহমুদের যুক্তিতে 'দীর্ঘকবিতা'র যে স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে-- তা অস্তিত্ববাদী এক্সিজটেনশিয়ালিস্ট সাহিত্যের সমান্তরাল হিসেবে প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ যে-কবিতায় অস্তিত্ববাদের স্ফূরণ ঘটেছে প্রাবন্ধিক তাকেই 'দীর্ঘকবিতা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

শিমুলের এই মতামতও সর্বার্থে গ্রহণীয় নয়। কেননা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘অস্তিত্ববাদে’র চর্চা নতুন নয়; পূর্বে হয়েছে। বরং এ সময়কালের সঙ্কট অস্তিত্ববাদকে ছাপিয়ে আনবিক-পারমাণবিক এবং সামাষ্টিক। অতএব 'দীর্ঘকবিতা' যদি অস্তিত্ববাদী সাহিত্যের মুখপাত্র হয়-- তাহলে তা পরিত্যাজ্য। একালে ব্যক্তির চেয়ে দৈশিক-জাতিক-সামষ্টিক সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে; যা অস্তিত্ববাদী সাহিত্য প্রকাশে অম।

রহমান হেনরী 'দীর্ঘকবিতা নিয়ে পুনরায় নাতিদীর্ঘ কথা' শীর্ষক প্রবন্ধে ব্যক্তি মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। রহমান হেনরীও অস্তিত্ববাদী সাহিত্য ঘরণায় 'দীর্ঘকবিতা'কে টেনে নিয়ে অস্পষ্টতার আবর্তে সংজ্ঞা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছেন। 'দীর্ঘকবিতা'র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, আয়তনে দীর্ঘ যে কোনো কবিতাই দীর্ঘকবিতা নয়; দীর্ঘ আয়তন অবশ্যই দীর্ঘকবিতা হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত, কিন্তু একমাত্র শর্ত নয়। যে-কবিতায় আমাদের বিপন্ন অস্তিত্বের আর্তি, প্রশ্ন ও বিস্ময় আবর্তিত এবং আপাত অশুভের পাথরমুখ সরিয়ে শুশ্র“ষার আলোক উৎসব দেখতে পাই, সে কবিতাকে দীর্ঘকবিতা বলতে উৎসাহী হয়ে উঠি। [রহমান হেনরী, পৃ. ৪৯] রহমান হেনরীর এই মতামত শিমুল মাহমুদের প্রবন্ধে গৃহীত হয় না, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত।

অর্থাৎ উভয় প্রাবন্ধিকের মতামতের বৈপরীত্য ‘দীর্ঘকবিতা’র সংজ্ঞাকে আরো অস্পষ্ট করে তুলেছে। উল্লেখ্য, কোন বিষয়ের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা থাকলে সে বিষয় সম্বন্ধে বাগাড়াম্বর করা যায়; তবে সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তি উপস্থাপন করা যায় না। সুতরাং সর্বপ্রথমে ‘দীর্ঘকবিতা’র সংজ্ঞা স্পষ্ট হওয়া অধিক জরুরী। ‘কারুজে’র এ-সংখ্যার প্রাবন্ধিকদের কেউ বলেন ‘দীর্ঘকবিতা’র আকৃতি ছোট-বড় ব্যাপার নয়, আবার কেউ বলেন ‘দীর্ঘকবিতা’র আয়তন অবশ্যই দীর্ঘ হতে হবে। সেেেত্র পাঠক গ্রহণ করবে কোনটি? একই বিষয়ে একাধিক বক্তব্য এবং তাত্ত্বিক বিভ্রাট ‘দীর্ঘকবিতা’র আলোচনাকে জটিলতার পঙ্কে নিমজ্জিত করেছে।

হেনরীর মতে, রবীন্দ্রনাথের ‘মানসসুন্দরী’ দীর্ঘকবিতা। তাহলে প্রশ্ন করা যায়, ‘মানসসুন্দরী’র মতো রোমান্টিক ভাববাদী (ওফবধষরংঃরপ) কবিতা যদি ‘দীর্ঘকবিতা’ হতে পারে, তাহলে ‘লিরিক’ এবং ‘দীর্ঘকবিতা’য় তফাৎ কোথায়? বরং যে সকল কবিতায় কবি বিস্তৃত পটভূমিতে নিজেকে উপস্থাপন করেন, তাই ‘দীর্ঘকবিতা’। এখানে অস্তিত্ববাদ এবং জৈবনিক সমষ্টি-ব্যষ্টির উল্লেখ বাতুলতা মাত্র। কেননা ‘মানসসুন্দরী’ রবীন্দ্রনাথের নিতান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি-রঞ্জিত; এখানে সামষ্টিক জীবনের লেশমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে প্রাবন্ধিক রহমান হেনরীর আলোচনা অনেক বেশি তথ্যবহুল এবং যুক্তিনির্ভর।

তিনি শিমুল মাহমুদের ন্যায় আবেগের প্রবল টানে ভেসে যাননি। মোস্তফা তারিকুল আহসান এ-সংখ্যার ‘কারুজে’ গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে ‘দীর্ঘকবিতা ও তনুমধ্য’ প্রবন্ধটি লিখেছেন। প্রাবন্ধিক তীè দৃষ্টি দিয়ে দীর্ঘকবিতা’র শেকড় সন্ধানে প্রয়াসী। অর্থাৎ মোস্তফা তারিকুল আহসান ‘দীর্ঘকবিতা’ রচনার সূত্রানুসন্ধান পর্বটি অত্যন্ত দতার সঙ্গে করেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলা কাব্যসাহিত্যে স¤প্রতি দীর্ঘকবিতা বিষয়ক চিন্তাচেতনা-ধারণার যে বিকাশ তা পাশ্চাত্য থেকে নিছক ধার করা বিষয়।

প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’, ‘কচ ও দেবযানী’ ও ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের সব কবিতাকে ‘দীর্ঘকবিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও একালে প্রচলিত ধারণার সাথে বিরোধের কথাও উল্লেখ করেছেন। একালে টি.এস. এলিয়টের বিখ্যাত ‘ঞযব ডধংঃব খধহফ’, ‘ঞযব খড়াব ঝড়হম ড়ভ ঔ. অষভৎবফ চৎঁভৎড়পশ’, ‘অংয ডবফহবংফধু’ ইত্যাদি কবিতা দ্বারা বাংলা কবিতা প্রভাবিত হয়েছে। বিশেষত ‘ঞযব ডধংঃবষধহফ’-র প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে ‘দীর্ঘকবিতা’ বিষয়ক অভিনব চিন্তাকে উসকে দিয়েছে। মোস্তফা তারিকুলের মননশীল এই বক্তব্য অত্যন্ত যুক্তিনির্ভর। ‘ঞযব ডধংঃব খধহফ’-র প্রভাবজনিত কারণে বাংলা সাহিত্যে বিকশিত ‘দীর্ঘকবিতা’র দীর্ঘত্বকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই।

সুতরাং ‘দীর্ঘকবিতা’র বিষয়বস্তুর েেত্র মতামতের ভিন্নতা থাকলেও আঙ্গিকগত ‘দীর্ঘ’ পরিসরের ব্যাপারে দ্বি-মত থাকার কথা নয়। কেননা এ-সংখ্যার ‘কারুজে’ প্রকাশিত অনেকের লেখায় ‘দীর্ঘকবিতা’র বিষয়বস্তু হিসেবে অস্তিত্ববাদকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এ কথার সাথে তারিকুল আহসানও ঐক্যমত পোষণ করেন। কিন্তু অস্তিত্ববাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক বিচারে ‘ঞযব ডধংঃব খধহফ’-কে ‘দীর্ঘকবিতা’ বলা সঙ্গত নয়। কেননা ‘ঞযব ডধংঃব খধহফ’-র বিষয় আধুনিক কালে মানবজীবনে ঘনায়মান সঙ্কটের মুখে অধ্যত্মবাদে আত্মসমর্পণ।

অর্থাৎ এলিয়ট অধ্যত্মবাদে সমর্পিত আধুনিক মানুষ। অর্থাৎ এলিয়ট অস্তিত্ববাদী না হয়েও ‘দীর্ঘকবিতা’র রচয়িতা। এই অর্থে ‘দীর্ঘকবিতা’র অস্তিত্ববাদে নির্ভরতার বিষয়টি অবান্তর হয়ে ওঠে। তবে ‘দীর্ঘকবিতা’র পরিসর দীর্ঘ হতে হবে এই যুক্তি প্রবল। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘তনুমধ্যা’ কাব্যের ‘দীর্ঘকবিতা’ নিয়ে মননধর্মী প্রাজ্ঞ বিচার-বিশ্লেষণ শেষে মোস্তফা তারিকুল আহসান বাংলা ‘দীর্ঘকবিতা’ সম্বন্ধে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশের কবিতার যে চর্বিত চর্বনের পালা, কষ্টকল্পনার যে হিড়িক তা থেকে দীর্ঘকবিতা আমাদের মুক্তি দিতে পারে।

তবে, ব্যক্তিজীবন, পরিবেশ, শৈশব, সামাজিক সংস্কার, জীবন প্রণালী এসব নিয়ে ঘনপিনদ্ধ আকারে দীর্ঘকবিতা লিখলে আমাদের সম্ভাবনা আরো বাড়বে। [মোস্তফা তারিকুল আহসান, পৃ. ৭৮] প্রাবন্ধিকের প্রত্যাশার সঙ্গে পাশ্চাত্য নির্ভরতা পরিত্যাগের বিষয়টি প্রযুক্ত হলে তা আরো যুক্তিযুক্ত হবে। এ দেশীয় আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে যদি কবিতার এই নতুন আঙ্গিককে মেলানো সম্ভব হয় তবেই ‘দীর্ঘকবিতা’র সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে। এ দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিহীন পাশ্চাত্যনির্ভর কাব্যচর্চা পরিত্যাগ করাই উত্তম। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ‘আসুন আমরা মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’গুলো চিহ্নিত করি’ প্রবন্ধটির নামকরণের ধরন নতুন এবং বক্তৃতাধর্মী।

প্রবন্ধের নামকরণ আমাদের ভাবনার বিষয় নয়। বিষয়ের অন্তর্গত বিচার-বিশ্লেশণে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর আত্মপ্রত্যয়ী বলিষ্ঠ এবং যুক্তিনির্ভর। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’কে ‘দীর্ঘকবিতা’ হিসেবে ছাড়পত্র দিয়েছেন। কবিতার বিষয়গত অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ দীর্ঘকবিতা হিসেবে গ্রহণ করতে পাঠকের আপত্তির অবসর হয়নি। তৈমুর খান ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞানের বাকচিত্রই দীর্ঘকবিতা’ বিষয়ক প্রবন্ধে আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসে এতটাই উচ্ছ্বসিত যে, তিনি ‘দীর্ঘকবিতা’কে এদেশীয় হকারদের মতো সকল রোগের নিরাময়কারী ঔষধের ন্যায় উপস্থাপন করেছেন।

তাঁর ভাষায় ‘দীর্ঘকবিতা’ ছোটগল্প-উপন্যাস-নাটক সবই। যদি তাই হয়, তাহলে আর ছোটকবিতা (লিরিক) চর্চা কেন? তাঁর বক্তব্যে যুক্তির ধারের চেয়ে আবেগের উচ্ছ্বাস বেশি। তিনি ‘দীর্ঘকবিতা’কে সাহিত্যের সবকিছু হিসেবে চিহ্নিত করায় ছোটগল্প, উপন্যাস কিংবা লিরিক রচনার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত তৈমুর খানের বক্তব্য সাহিত্যতত্ত্বে অগ্রহণীয়। কেননা ‘দীর্ঘকবিতা’ ছাড়াও সাহিত্যের নানান ঋড়ৎস আছে এবং থাকবে; ভবিষ্যতে ‘দীর্ঘকবিতা’র মতো নতুন আঙ্গিক প্রযুক্ত হবে।

ফাল্গুনী ভট্টাচার্যের ‘প্রসঙ্গ : দীর্ঘকবিতার ঘর গেরস্থালি’ বিষয়ক প্রবন্ধটির বক্তব্যও বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তিনিও ‘দীর্ঘকবিতা’র আকারগত বিষয়ক বিতর্কের অবতারণা করেছেন, কিন্তু যুক্তি দ্বারা তা স্পষ্ট করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা ‘দীর্ঘ’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ব্যাপ্তি বিষয়ক, বিষয়গত নয়। প্রবন্ধে এই অস্বচ্ছতা ফাল্গুনী ভট্টাচার্য অতিক্রম করতে পারেননি। তবে প্রবন্ধে তিনি বেশকিছু কবিতাকে ‘দীর্ঘকবিতা’ হিসেবে দতার সাথে চিহ্নিত করেছেন।

প্রাবন্ধিক ‘দীর্ঘকবিতা’কে সামাগ্রিক জীবনের পরিচায়ক মনে করেন। ফাল্গুনীর প্রাবন্ধিক যুক্তি বিনম্র, তিনি প্রবন্ধে নীচুস্বরে বক্তব্য বিষয়কে সহজতর করার প্রয়াসী। চিত্তরঞ্জন হীরা ‘যা দীর্ঘ নীরবতার অনুভব : বিষয় দীর্ঘকবিতা’ প্রবন্ধে শুরুতেই শব্দের ব্যাপ্তি বিষয়ক চিন্তাসূত্র থেকে পাঠককে আলাদা করে নিয়ে এর বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। তিনি ‘দীর্ঘকবিতা’র পরিসর নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন; তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ‘দীর্ঘকবিতা’র বিষয়ভাবনা। তিনি মনে করেনে, ‘দীর্ঘকবিতা’য় ভাবনার বা চিন্তাসূত্রের পরিসর দীর্ঘ হতে হবে।

অবশ্য, প্রাবন্ধিক নিজেই ‘দীর্ঘকবিতা’র সংজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছেন, এখন পর্যন্ত ‘দীর্ঘকবিতা’র সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রাবন্ধিকের সুরেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, ‘দীর্ঘকবিতা’ নামকরণটিই যথার্থ হয়েছে? সমকালকে কবি জীকনানন্দ দাশ ‘মহাকবিতা’র যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ বিষয়টিও ভেবে দেখা যেতে পারে; তাহলে ‘দীর্ঘকবিতা’র অন্য নাম ‘মহাকবিতা’ হতে পারে। বরং ‘দীর্ঘকবিতা’র বদলে ‘মহাকবিতা’ শব্দটিই অধিক প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক মনে হয়। সৈকত এম আরেফিন ‘আমাদের কালোয়াকাশে শাদাপায়রা : বিষ্ণু বিশ্বাসী পাখনায় কতিপয় পালক’ শীর্ষক জ্যামিতিক-পাদার্থিক-গাণিতিক যে সমীকরণ এবং ব্যাকারণিক প্রয়োগ অভিধা দেখিয়ে, ‘দীর্ঘকবিতা’কে মধ্যপদ লোপী কর্মধারয় সমাস অথবা যোগরূঢ় শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তা সর্বাংশে গ্রহণীয় নয়।

তবে লেখক গাণিতিক যুক্তিতে ‘ব্যঞ্জনা’কে ‘দীর্ঘকবিতা’ শব্দের ফাঁকা স্থান পূরণের নিমিত্তে ব্যবহারের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, সেই যুক্তি অর্থময় এবং চমৎকার। প্রাবন্ধিকের এই যুক্তি গৃহীত হলে ‘দীর্ঘকবিতা’র দীর্ঘত্বের প্রশ্নটি আর থাকে না। অতঃপর প্রাবন্ধিক ‘দীর্ঘকবিতা’র সংজ্ঞার তাত্ত্বিক জটাজাল থেকে বেরিয়ে বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতায় মহাজাগতিক দীর্ঘ পরিভ্রমণ করেছেন। বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার বিষয় এবং ভাবের দীর্ঘত্ব উন্মোচন লেখকের বাক্চাতুর্য নিঁখুত ও সঙ্গতিপূর্ণ। কবিতার আভ্যন্তর বিয়য়ালোচনায় সৈকত এম আরেফিনের একাত্মতা কবি-হৃদয়ের ছোঁয়া আছে।

ফলে তিনি কবিতার সঠিক বিষয়টিই প্রবন্ধের ভাষায় কাব্য-তারল্যে উপস্থাপন করেন। সৈকত এম আরেফিন ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় প্রাবন্ধিক। 'কারুজ' পত্রিকার ত্রয়োদশ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, 'প্রসঙ্গ দীর্ঘকবিতা' বিষয়ক। 'কারুজে'র ত্রয়োদশ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যাটি 'দীর্ঘকবিতা' বিষয়ক নয়টি সৃজনশীল এবং গবেষণাধর্মী সমৃদ্ধ প্রবন্ধ ছাড়াও তেরো জন কবির রচিত 'দীর্ঘকবিতা' দিয়ে পত্রিকার কলেবর নির্মিত। এ-সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ও কবিতাগুলোর মান সংরণে সম্পাদকের সযত্ন প্রয়াসের ছাপ রয়েছে।

তারপরও 'কারুজে'র লেখকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা-প্রাতিস্বিকতা অবাধ ও অক্ষুণ্ন। আশাকরি 'কারুজে'র দীর্ঘকবিতা বিষয়ক সংখ্যাটি পাঠকমহলে সমাদৃত হবে। ........................................................ বিদ্র. এ লেখাটির মাঝে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ও বাক্য আছে যেগুলো ইউনিকোড কনভার্টের সময় বাংলা হয়ে গেছে। তা সংশোধন করা গেল না, পরবর্তীতে কোন এক সময়ে তা করা হবে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।