আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেমন আছি সৌদি আরবে -চতুর্থ পর্ব

স্বাগতম

আগেই লিখেছিলাম আমি আমেরিকান তেল কোম্পানীর(ARAMCO) আবাসন তৈরীর কাজ দেখতাম। একদিন আমাদের কাজ দেখতে আরামকোর আমেরিকান সুপারভাইজার মিঃরবার্ট সাইটে এলো। আমার সংগে পরিচিত হবার পর ঐ বাড়ীর ল্যান্ডস্কেপটা দেখে তার পছন্দ হলনা। আমাকে বলল তুমি যদি আমার বাড়ীরটা দেখে বানাতে চাও তবে চলো আরামকোর ভেতরে আছে। আমি আরামকোর অফিসে গিয়েছি বটে,তবে কখনো হাউজিং এরিয়াতে(নন সৌদিদের) ঢুকিনি।

ইতিমধ্যে জেনেগিয়েছিলাম ওটা একটা মিনি আমেরিকা। তাই মনে মনে আনন্দে নেচে উঠে বললাম,আমার আইডি্কার্ড আছে কিন্তু গাড়ী নেই। তিনি তার বিশাল গাড়ী জিএমসি সুবারবানে আমাকে বসাল। আমরা যখন SECOND GATE অতিক্রম করলাম আমার তখন অবাক হবার পালা। এই প্রথম আমি সৌদি আরবে এতো বিশাল সবুজ মাঠ (তখনকার সময়ে) দেখতে পেলাম।

তার আশপাশে ছোট ছোট বাড়ীঘর,ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলা ইটের রাস্তা,বাড়ীর সামনে সাদা চামরার ছোট ছেলে মেয়েরা খেলা করছে,আমেরিকান মহিলারা স্কার্ট বা স্পোর্টসওয়ার পরে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে ঘুড়ে বেরাচ্ছে। আমার অবাক করা চাহনি দেখে রবার্ট জিজ্ঞেস করলো প্রথম এলে নাকি?মাথা নাড়লাম হ্যা,তিনি তখন আমাকে আরো ঘুড়িয়ে দেখাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। তিনি আমাকে ওদের থিয়েটার(সিনেমা)হল,হ্যালিপেড,গলফমাঠ,রাগবি খেলার মাঠ,জিম, গির্জা (সৌদির একমাত্র)ইত্যাদি সব ঘুড়িরে ফিরিয়ে দেখাতে লাগলো। এরই মাঝে আমার ল্যান্ডস্কেপও দেখা হয়ে গেল। আমরা ফিরতি পথে গেটে আসতেই সিকিউরিটি গার্ড রবার্টের আইডিকার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স দুটোই নিয়ে নিল।

একটু পর কিছু লিখে রেখে শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্সটা ফেরত দিলেন। মিঃরবার্ট পাশের পার্কিংএ গাড়ী রেখে নিচে নেমে গিয়ে গার্ডকে কিছু একটা অনুরোধ করতে লাগলেন। অনুনয় করায় কাজ হলো,তিনি আইডিকার্ড হাতে করে এসে গাড়ীতে বসলেন। আর আমাকে শুনিয়ে বলতে লাগলো এটা আমারি দোষ, তুমি নুতন তোমাকে আমার বলে দেয়া উচিৎ ছিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কি? তিনি বললেন তোমার সিট বেল্ট বাধা ছিলনা।

তাই আমার নামে বস্কে সে কমপ্লেইন করবে। তাতে আমার প্রমশোন ডিলে হতে পারে! এখানে নুতন এসে এ জাতীয় প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। আরেকদিন সন্ধ্যাবেলায় মার্কেটে গিয়েছি কেনাকেটা করতে। এষা নামাজের আজান দিতেই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। তাদের নিয়ম অনুযায়ী নামাজের পর দোকান খুলবে।

আমরা দুজন মার্কেটের একপাশে বসে গল্প শুরু করলাম। হঠাৎ দেখি লোকজন দ্বিগবিদিগ দৌড়াচ্ছে,আমার হাত ধরে আমার বন্ধুটিও দে দৌড়। অনেক দূরে এক চিপা গলিতে গিয়ে আমরা থামলাম। জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি,দৌড়াচ্ছি কেন?শুনলাম মোতওয়া এসেছে। সেটা আবার কি?সৌদি আরবের খুব পাওয়ারফুল সংস্থার লোক এরা।

বলা যায় ইসলামিক মেজিস্ট্রেট। নামাজের সময়ে বা আগেই এরা গাড়ী করে ঘুড়ে বেরায়। সঠিক সময়ে দোকান বন্ধ হলো কিনা,কেউ নামাজ ফাকি দিচ্ছে কিনা,বালেগ মহিলারা বোরখা পড়েছে কিনা,কেউ মহিলাদের টিজ করছে কিনা ইত্যাদি অনইসলামি কাজ করা থেকে বিরত রাখাই মূলত এদের কাজ। এদের হাতে ছোট্ট বেতও থাকে প্রয়োজনে ইনস্ট্যান্ট ব্যবহারও করে থাকে। অন্যথা হলে এক রাতের জেল বা দোড়রা খাওয়া পাবলিক ঢের দেখেছি।

একদিন সপিংমলে এক আমেরিকান ফ্যামিলিকে তারা ধরলেন কারন টিনএজ মেয়েটি বোরখা না পড়ে এসেছিল। মোতওয়া তার বাবাকে আকামা দিতে বললেন। সেই দেখে বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করলেন। মোতওয়া বেশ ভদ্রতার সঙ্গে বললেন সিস্টার ভয় পাবেননা,ভবিষ্যতে যাতে আর এরকম না করেন তাই নোটিশ লিখে দেব,আকামাটা কাল আমাদের অফিস থেকে নিয়ে যাবেন। আরেকদিন আমার এক বন্ধু একটা ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে যাচ্ছিল,পড়বিতো পর একদম মোতওয়ার সামনে।

ধরে নিয়ে গেল তাদের অফিসে। দু-তিন ঘন্টা বসিয়ে রেখে ভেতরে কি আছে যাচাই করে তবেই ছেরে দিল!নামাজের সময় ঘড়ে বসে জোরে গান বাজানো্র অপরাধে মিউজিক প্লেয়ার জব্দের ঘটনাও আছে। ঘটনা আরো অনেক কিন্তু সময় করে পরে লিখবো। ইতিমধ্যে আমি আকামা পেলাম। এটা এদেশের রেসিডেন্স কার্ড।

দেখতে ছোট আইডি কার্ডের সমান। চার-পাচ পাতার সবুজ রঙ্গের বই(তবে ননমুসলিমদেরটা খয়েরী রং)। ভেতরে নিজের ছবি,নাম(বাপদাদার সহ)ও মেয়াদকাল লেখা থাকে। এটা হারালে বা নস্ট হলে এক হাজার রিয়াল জরিপানাসহ জেলও হতে পারে। এই জন্য আকামাকে সবাই খুব যত্ন করে রাখে।

কেউ কেউ প্লাস্টিক কভারে ভরে মানিব্যাগে রেখে দেয়। এক ঘটনার কথা বলি,এক রাতে দাউদসাহেব তার বাসার ময়লা বলাদিয়ার(মিউনিসিটিপ্যাল্টি)ড্রামে ফেলতে গেলেন। ঠিক সেই সময় পুলিশ এসে তার আকামা চ্যালেঞ্জ করলো। তিনি বললেন এটা আমার বাসা ভেতরে মানিব্যাগে আকামা আছে। পুলিশ কোন কথাই শুনলনা,রাতটা তার শ্রীঘড়েই কাটলো,সংগে হাজার রিয়াল জরিপানা!দাউদ সাহেব কিন্তু স্বপরিবারে থাকতেন।

ধীরে ধীরে আমি রাস্তাঘাট চিনে ফেললাম। কারন আমি খুব ঘুড়ে বেরাতাম। রাতে নাফিজ বা অন্যকোন বন্ধুর সংগে এখানে সেখানে গিয়ে গাড়ী চালানোর সাহস হয়ে গেল। এছারা বরিশালের দেলওয়ার ভাইয়ের কথাও ভুলার নয়। তিনি যদিও এককালে ড্রাইভার ছিলেন কিন্তু আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয় তখন তিনি ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

উনার বাসা ছিল দাম্মামের সিকো মার্কেটে। উনি খুব আড্ডা প্রিয়লোক,তাই তার বাসায় প্রতি উইকএন্ডে(বৃহষ্পতিবার)সারা রাত তাসের আড্ডা, ভিডিওতে হিন্দিছবি,গালগল্প ইত্যাদি চলতো। তিনি আমাকে গাড়ী চালানোতে উৎসাহিত করতেন আর শিখাতেনও। উনার বাসায় শুধু বরিশাল নয় সব জেলারই লোক আসতো। তাই আমি অতিদ্রুত অনেক লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম।

একদিন সেই বাসাতেই দেখা পেয়েছিলাম আমার ক্লাসমেট এমনকি বেসমেট রিয়াজের। দেশে শুনে এসেছিলাম সে ইরাকে গিয়েছে। এখানে তাকে দেখে খুব খুশি হলাম। কারন তখন সৌদি আরবে আমাদের মেলামেশা করার মতো লোক খুজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার ছিল। এখানে তখন সংখ্যা গরিষ্ঠ হিসাবে ড্রাইবাররাই ছিল বাংলাদেশীদের মধ্যে মোটামুটি ভাল পেশার।

অবশ্য তখন প্রচুর ডাক্তার ও মেল-ফিমেল নার্সও ছিল। কিন্তু তাদের বয়স ছিল বেশি তাই তারা একটা নির্দিস্ট গন্ডিতে আবদ্ধ থাকতো। যাইহোক রিয়াজের বিস্তারিত ঠিকানা আমি নিয়ে নিলাম সে আমাকে পরের বৃহষ্পতিবার তার ওখানে দাওয়াত করলো। আমি দেশ থেকে আসার সময় একটা ড্রাইবিং লাইসেন্স নিয়ে এসেছিলাম। ওটা সহ আমার কোম্পানির সম্মতি পেপার,পাসপোর্ট কপি ইত্যাদি নিয়ে সৌদি ড্রাইবিং লাইসেন্সের জন্য দাল্লা অর্থাৎ ড্রাইবিং স্কুলে গেলাম।

কিন্তু অফিসার আমার বাংলাদেশী লাইসেন্স গ্রহন না করে তাদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য লিখে দিলেন। আমি পরদিনই প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে ভর্তি হলাম। মাত্র সাতদিনের কোর্স। সকালে গিয়ে দুপুর অব্দি ট্রেনিং। যেহেতু আমি ড্রাইভিং লাইসেন্স শো করেছিলাম তাই আমাকে শুধুমাত্র পার্কিং করা শেখাচ্ছিল।

সেখানে গিয়ে দেখলাম ৩/৪বার ফেল করা অনেককে। আমার মনেও ভয় ঢুকে গেল,পারবতো!শেষতক সবাইকে অবাক করে প্রথম দফাতেই পাশ করে লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। গত পর্বে আমার দেখা গলাকাটার দৃশ্য নিয়ে লিখে ছিলাম। আমার আরো ইচ্ছে ছিল ব্যভিচারের অপরাধে পাথর ছুরার দৃশ্য দেখা। একবার শুনলাম এক লেবাননের মহিলাকে এই অপরাধে মারা হবে।

আমরা পরপর ছয় সপ্তাহ গিয়ে দাড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ কিংফাহাদ নাকি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। এখানে যে শাস্তিগুলো সাধারনত হয় তা হচ্ছে ছোট খাট মারামারি করলে দোররা বা চাবুকের ঘা,চুরি করলে হাতের কব্জি কেটে ফেলা,বিবাহিতদের অনৈতিক সম্পর্ক থাকলে পাথর নিক্ষেপ এবং নেশা জাতীয় মালামাল বিক্রি ও সাপ্লাই এবং হত্যাকারীকে গলাকাটা হয়। এছারা আর্থিক দন্ডও থাকে। এসব বিচারকার্য সম্পুর্ন ইসলামিক আইন অনুসারে হয়।

কাজেই এখানে অপরাধের সংখ্যা অনেক কম। মহিলাদের উত্যক্ত করার কথা কেউ কল্পনাতেও আনবেনা,কারন মহিলার অভিযোগ করাই এখানে যথেষ্ঠ। তবে উল্টো ঘটনাও যে হয়না তা নয়। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.