আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পূণর্জন্ম - ছোটগল্প



সে পাতকুয়াটা চোখে পড়ার সাথে সাথে, বিদ্যুত চমকের মতো কিছু দৃশ্য যেন ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেলো! ছায়াছবিতে যেভাবে রিওয়াইন্ড করা মুহুর্তগুলি দেখানো হয়; ঠিক সেরকম। আমি দাড়িয়েছিলাম জামাল খান রোড আর আন্দরকিল্লার সংযোগ সড়কের মোড়টার একটু আগে। লুৎফর (কোম্পানীর ইন্টারপ্রেটর) জানালো, লোকজন জায়গাটাকে মতিঝর্ণা নামেই চিনে। আমি কি এই নামেই চিনতাম?! অন্ধের মতো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। নাহ্‌, আর কিছু মনে করতে পারছি না।

কেমন যেন অস্থির লাগতে শুরু করলো। কদিন ধরেই এমন হচ্ছে! এই টিলা ঘেরা শহরটার অনেক জায়গাই চেনা চেনা লাগছে। অথচ জীবনে এই প্রথম আমার চট্টগ্রাম আসা! শুধু তাই নয়, বাংলাদেশেই আমার এই প্রথম আসা! আমি 'খ্য চী মিন'; জাতিতে হান্‌, অর্থাৎ সাধারণ চাইনিজ যাকে বলে। চট্টগ্রামে যে নতুন ব্রীজটা হচ্ছে সেই প্রজেক্টের একজন ছাপোষা ইন্জিনিয়ার। মাতৃভূমি উরুমছি ছেড়ে এই প্রথম পা ফেলেছি ভীন কোন দেশে।

এদেশের ভাষা, লোকজন, খাওয়া, আচার আচরণ সব অদ্ভুৎ লাগাই স্বাভাবিক ছিল। লাগছিলও! কিন্তু সেদিনের ঘটনাটার পর হঠাৎ করে যেন বদলে গেলো সব কিছু। সাধারণতঃ সেফটি হেলমেট ছাড়া আমি কখনো সাইটে যাই না। অথচ এদেশে কেউ সেইফটি কি জিনিষ সেটা মনে হয় জানেও না! ওদের সাথে থেকে থেকে আমিও একটু ঢিল দিয়েছিলাম নিরাপত্তার ব্যাপারে। তাই স্টিলের বীমটা যখন কানের পেছনটায় আঘাত করলো; তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছিল এই বুঝি শেষ! 'আই রেন" এর মুখটা মনে হয় আর দেখা হলোনা!হসপিটালে জ্ঞান ফিরে পেয়ে যখন জানতে পেলাম, ডাক্‌তার কোনো মেডিকেশন ছাড়াই রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে; খুব অবাক হয়েছিলাম।

তবে লুৎফর মোটেই নাকি অবাক হয়নি!! চীনাদের জান্‌ নাকি খুব শক্ত, 'কই" ( এদেশীয় একটা কাঁটাওয়ালা মাছ) মাছের মতো!! উপমাটা খুব একটা পছন্দ না হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। পরদিন সাইটে আসার সময় থেকেই সেই 'চেনা চেনা' অনুভুতির অস্বস্তিটুকু খচ্‌ খচ্‌ করতে শুরু করলো। পুরো সপ্তাহ জুড়ে এই অস্বস্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। তখনই ঠিক করে রেখে ছিলাম, এ সপ্তাহের ছুটির দিনটাতে শহরটা ঘুরতে হবে; জানতে হবে কেন এমন অনুভুতি হচ্ছে! লুৎফর কি বুঝেছে জানিনা; কিন্তু সে আমাকে নিয়ে পাতকুয়াটার দিকে এগিয়ে গেলো। আমাকে হাতে ইশারা করে একটা পাথরের দিকে তাকাতে বললো।

ঝর্ণার এক পাশ ঘেষে একটু উঁচু মতো জায়গায় পাথরটা। নিরেট, কালো, প্রাচীণ! একটাই; আর কোন পাথর নেই আশে পাশে। "এই হাজার বছরের পুরানো পাথর। লোকেরা এটাকে পূজা করতো। এই যে এইখানে দেখেন! এখানে মানুষকে কেটে বলি দেওয়া হতো!" বেশ কিছুক্ষণ সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ম্যান্ডারিনে 'বলী দেয়া' ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা করলো।

জানিনা, তার কথার কারণেই কিনা; কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে স্মৃতিতে ঝলসে উঠলো কিছু শ্যাঁওলাগন্ধি, প্রাচীন দৃশ্যাবলী ! আমি দুর্ধর্ষ মগ জলদস্যু হিসাবেই আমাদের পরিচিতি এই রাঢ়ি - বঙ্গ দেশে। অথচ সেদিন নেড়ি কুকুরের মতো তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিলাম বাদশাহী সিপাহীদের তাড়া খেয়ে! দলের সবার মতো আমারও কপালে ফাঁসির দড়ি ঝুলছিল। সাতদিন ধরে এই লুকিয়ে আছি এই চেরাগী পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে। এই সাধু ফকিরের আশ্রয় না পেলে হয়তো এখানেই ধুঁকে ধুঁকে পঁচে মরতাম। কিন্তু মঙ্গোল রক্ত বইছে আমার শরীরে।

আমরা কাউকে বিশ্বাস করি না। কেন যেন ভয় হয়, এই সাধু বেটা না আবার সিপাহীদের হাতে আমাকে তুলে দেয়। সব সময় লুকিয়েই থাকি আড়ালে। তেষ্টা পেলে পাতকুয়া থেকে পানি তুলে আনি। কালে ভদ্রে এখানে কেউ আসে।

একবার এলো এক বন্দিকে টেনে হিচঁড়ে, ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে। আড়াল থেকে দেখলেও চিনতে কষ্ট হয়নি! আমার ভাই ' তাং লি বাই '!! ওহ!! কি নির্মম নৃশংযতায় ওরা তাকে হত্যা করলো! ধারালো দা এর এক কোঁপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে গেলো আমার ভাইটার! আহ! কি রক্তের স্রোত!! হায়! তাং লি!! তার পর দুদিন ফকিরের সাথেও দেখা করিনি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাকে। ক্ষিদের জ্বালায় আবার তার কাছেই যেতে হলো। ইশারা ইঙ্গিতেই সে জানালো ভয়ের কিছু নেই।

কিন্তু আমি কাউকে বিশ্বাস করিনা। কখনোই না। আজকেও সে বাইরে যেতেই আমি জায়গা বদল করে আড়ালে থেকে লক্ষ্য রাখছিলাম। ঠিক যেমনটা সন্দেহ করেছিলাম! কয়েকজন লোককে পথ দেখিয়ে সে নিয়ে আসলো আস্তানার দিকে। তারা কিছুক্ষণ চারদিকে খোঁজাখুঁজিও করলো।

ফকিরকে খুব অবাক দেখাচ্ছিল। কিন্তু ঘৃণা আর প্রতিহিংসার আগুণে আমি তখন দাউ দাউ করে জ্বলছি। লোকগুলি চলে যাবার পর, ফকির এগিয়ে গেলো পাতকুয়ার দিকে। সে ঠিকই জানে, পানির প্রয়োজনে আমাকে সেখানে আসতেই হবে। আমিও শ্বাপদ ছন্দে গা ঢাকা দিয়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

পেছন থেকে গলা প্যাঁচিয়ে ধরে এক পোঁচে তার কন্ঠনালীটা যখন চিড়ে দিয়েছি; তার আগ পর্যন্ত সে টের পায়নি মৃত্যু তার কতো কাছে এসে দাড়িয়েছিল! তাং লি! ভাই আমার! তোর হত্যার প্রতিশোধ নিলাম! অসহায় আক্ষেপে ফকিরের হাত দুটি আঁকড়ে ধরতে চাইলো আমাকে। ঘুরে গিয়ে তার চোখের দিকে তাকতেই কেঁপে উঠলাম। জলভরা সেই চোখে বেদনার ছাঁপ স্পষ্ট। যেন জানতে চাইছে- "কেন, কেন কেন?!!" তার এই চাউনির কারণটুকু বুঝতে পারলাম অল্প কিছুক্ষণ পরেই। যখন তার ঝোলা থেকে বের হলো কাপড়ের উপর হাতে আঁকা একটুকরো ম্যাপ, যেখানে নির্দেশ করা আছে আমাদের সঙ্গীদের অবস্থান! কিছু শুকনা খাবার।

কালকে সে এরকম কিছুই আমাকে ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিল। যাতে আমি ফিরে যেতে পারি দলের বাকিদের কাছে। ৪০ বছরের দস্যু জীবনে কখনো এমন অপরাধবোধের অনুভুতির মুখোমুখি হইনি আর। আমরা রক্তস্রোতের ভেতর স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকা সুদূর প্রাচীন সেই পূর্বপুরুষকে আমি এখনও যেন দেখতে পাচ্ছি। এই সেই পাথর! হাত বাড়িয়ে পাথরটা ছুঁতে চাইলাম।

পারলাম না। আবার হাত বাড়ালাম! তীব্র আতংকের সাথে আবিষ্কার করলাম, হাত নাড়াতে পারছি না! শুধু হাত নয়, শরীরের উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই যেন। আমার? আমি কে?! আমি কি একবিংশ শতাব্দীর 'খ্য চী মিন' ? নাকি সু্প্রাচীন সেই নির্মম জলদস্যু! অন্ধের মতো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ভেসে উঠলো শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করে আসে অসংখ্য সব স্মৃতি। কখনো পরিশ্রমী কৃষক; কখনো আলো ঝকমকে বাজারের গণিকা; কখনো দূর সমুদ্রের জেলে, কখনো পাহাড়ী শিকারী। জীনের কোষে কোষে যে সব স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রবাহিত হয়ে গেছে; আজকে তারা সবাই এসে ভিড় করেছে 'খ্য চী মিন' এর স্মৃতি কোষে; অসহায় অনুভুতি হয়ে।

আমরা একে অপরের স্মৃতিতে উঁকি মারতে থাকলাম। আমি ও আমরা এক বিচিত্র আক্রোশে যেন পরস্পরের দিকে ছুটে যাচ্ছি ক্রোধোম্মাদ হয়ে! পরিশিষ্ঠ কোম্পানীর ডাক্তাররা কোন কারণই বের করতে পারলেন না। মাসখানেক সাইক্রিয়াটিস্টের পর্যবেক্ষণে থাকার পর, 'খ্য চী মিন' কে চাকরীচ্যুত করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। কেউ বুঝতে পারলো না কি কারণে সে হঠাৎ বোধশূন্য, অনুভুতিহীন জড় পদার্থে পরিনত হয়েছে। অশিক্ষিত শ্রমিকরা কানাকানি করছিলো মতি ঝর্ণার জ্বীনের বাতাস লেগেছে।

কোম্পানীর বড়কর্তারা অবশ্য মাথায় আঘাত পাওয়ার দূর্ঘটনার কথাটা বেমালুম চেপে গেছে। তবে খুব কম লোকই লক্ষ্য করেছিল, তার চোখের মণি কখনও স্থির থাকেনা। স্বপ্ন গ্রস্থ মানুষের মতো তীব্র গতিতে নড়তে থাকে সবসময়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।