আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন ও ভারতীয় হিন্দির তান্ডব

I want to make me as a blog writter. বিশ্বায়ন শব্দটি সবার কাছেই পরিচিত। যদিও বিশ্বায়ন মুক্তবাজার ব্যবস্থাকে বেশি উৎসাহিত করেছে। কিন্তু সংস্কৃতির বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও বিশ্বের দেশগুলো এখন অনেক এগিয়ে। বিশ্বায়নের মাধ্যমে এক দেশ অন্য দেশের সংস্কৃতি, ভাষা সহজেই গ্রহন করতে পারছে। বিশ্বায়নের গুনে বাংলা ভাষারও বিশ্ব-বিস্তৃতি ঘটেছে।

বিশ্বের প্রায় তিন হাজারেরও বেশি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা ৬ষ্ট স্থানে রয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলা বইপত্র, সংবাদপত্র বের হচ্ছে। টিভি চলছে। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে বাংলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটলেও বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা কতটুকু বেড়েছে তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ? অথচ বাংলা ভাষা অর্জনের রয়েছে এক সুদীর্ঘ গৌরবজ্জল ইতিহাস।

১৯০১ সালে রংপুরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়ার আহব্বান জানিয়েছিলেন। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশদের পর শুরু হয় পাকিস্তানি শোষণ, নীপিড়ন। উর্দূ ভাষা না জানার কারণে এবং বাংলা ভাষাভাষী হওয়ার কারণে শিক্ষা, চাকরি, অফিস, আদালত সবক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অবহেলিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। তাই পূর্ব বাংলার মানুষ সমতা টুকু পাওয়ার জন্য ১৯৪৭ বাংলা ভাষাকে আইন, অফিস, আদালতে ও শিক্ষার বাহন হিসেবে চালু করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহন করে।

কিন্তু ১৯৪৮ সালে গণপরিষদে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দূ ভাষায় অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয় এবং বাংলা ভাষা কে বাদ দেয়া হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ স্বৈরাচারী শাসকের ন্যায় ঘোষণা করে ‘উর্দূ এবং উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ’ ফলে গণমনে অসন্তোষ শুরু হয় এবং তা রুপ নেয় ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষনের ফলে রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় ঢাকার রাজপথ। আর এর মাধ্যমেই ইতিহাসে জায়গা করে নেয় বাংলা ভাষা আন্দোলন।

এর পথ ধরেই বাঙ্গালীরা পায় বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলনের মূল কথা ছিল, জাতীয় জীবনে মুখের ভাষা ও মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা দান ও অন্য ভাষার উচ্ছেদ নয়। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে আমরা বাংলা ভাষাকে যতটা না অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি তার চেয়ে বেশি অন্য ভাষাকে গ্রহন করে যাচ্ছি। এর ফলে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক এবং চূড়ান্ত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আজো আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন হয়নি।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এখনো বাংলাতে হচ্ছে না আইনশাস্ত্রের পুস্তকসমূহ বাংলা ভাষায় অনূদিত না হওয়ার কারণে। অপরপক্ষে এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা আজো প্রবর্তিত হয়নি বা তা প্রবর্তনের পথে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হতেও আজতক দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বাংলা মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে ব্যবহারোপযোগি কারে তোলার কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষা সারা বিশ্বে একটি সমৃদ্ধশালী ভাষা।

বিশ্বায়নের ফলে এ ভাষার আধিপত্য আরো বেড়ে গেছে। ইংরেজি ভাষা না জানা থাকলে বহির্জগতের সাথে আমাদের সম্পর্কের জানালা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশের আনাচে- কানাচে শুরু হয়ে গেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজের দৌরাতœ। আমাদের অভিভাবকরা এসব স্কুলে ছেলে মেয়েদের পড়ানোর জন্য যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। গ্রামে- শহরে সবখানেই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে।

এখানে আরবি ভাষাকেই বেশি গুরত্ব দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার র্দুবলতার কারণে এসব শিক্ষার্থী না পারছে আরবি বা ইংরেজি ভাষা শিখতে। অন্যদিকে বাংলা ভাষারও যথাযথ প্রায়োগিক দিকটি শিখতে পারছে না। ফলে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা অতি সহজেই নানা সার্ভেস, অর্থাৎ প্রশাসনিক সহ অন্যান্য বিশ্লেষায়িত সার্ভিসে সহসা নিয়োগ পাচ্ছেন এবং তাদেরকে অগ্রাধিকারও দেয়া হচ্ছে। ফলে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা অনেকক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছে।

এছাড়াও আন্তর্জাতিক শিক্ষাঙ্গনে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্যে আমরা ভারত,পাকিস্তান ও শ্রীলংকা থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণে ইংরেজিকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছি যে, বাংলা ভাষা নামে মাত্র রাষ্ট্রভাষা থেকে যাচ্ছে। আর শুরু হয়ে গেছে সরকারি কাজকর্মে, বহু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যবসা বাণিজ্যেও একটি অনুন্নত ইংরেজি ভাষার ব্যবহার। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের শিক্ষিত বাঙ্গালীর মুখেও বাংলা ও ইংরেজি মিশ্রিত একটি অদ্ভুত ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে। হাস্যরস করে যার নাম দেয়া হয়েছে বাংলিশ। ফলে সাহিত্যে, নাটকে, চলচিত্রে, সাংবাদিকতায় এমনকি এফএম রেডিও গুলোতেও এই বাংলিশ এর প্রাধান্য প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে।

তবে কি এই ছিল বাংলা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য? লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে এই বাংলা ভাষার বিকৃত রুপ বাংলিশের পাশাপাশি বিশ্বায়নের খোলা দরজার সুযোগে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর শুরু হয়ে গেছে ভারতের হিন্দি ও তামিল ভাষার আগ্রাসন। অবাধ ইলিকট্রনিক মিডিয়ার যুগে এই আগ্রাসন বাঙ্গালী তরুন সমাজের শিকড় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দি টিভি সিরিয়ালের ব্যাপক প্রচলনে জনজীবনের একেবারে নীচের স্তর পর্যন্ত ভাষায়, চলনে, কথনে ও আচরনে তার ব্যাপক কু-প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষের মনে পশ্চিমা ও ভারতীয় সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। ফলে ভাষা দিবস বা বাংলা নববর্ষ ছাড়া শাড়ী পরিহীতা নারী ঢাকা শহরে দেখা যায় খুব কম।

শুধু তাই নয় বাংলাদেশে বড় শপিংমল, মার্কেট ও খেলাধুলার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানেও ভারতীয় শিল্পেদের কদর বেড়ে গেছে। যেন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি বা ভাষা বলতে কিছু নেই। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলা ভাষাকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা যে চক্রান্ত শুরু করেছিল তাতে বাঙ্গালীরা জয়ী হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ বিজয় লাভের পর স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও তার হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি কি আবারো হিন্দির আধিপত্যবাদী গ্রাসে অস্তিত্বেও সংকটে পড়বে? আমাদের যুবক ও তরুন-তরুনীদের মাঝে যেভাবে হিন্দি ও তামিল ভাষা এবং বাংলাদেশের ধনীক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ইংরেজির আধিপত্য যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তাতে করে ভাষা আন্দোলন তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে বলা যায়। কেননা সংস্কৃতি বিনিময় ও সমন্বয় মিলনের কোন শুভ উদ্যোগ নেই।

কেবল একতরফা ভাবে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন বেড়েই চলছে। এটা চলতে থাকলে পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যতটা বিপন্ন হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি বিপন্ন হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। যদি ভারতের অনুগ্রহপুষ্ট হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির মিত্রবেশী আগ্রাসন আমরা ঠেকাতে না পারি তাহলে দিল্লির অর্থনৈতিক প্রভুত্বের সঙ্গে সাংস্কৃতির প্রভুত্বের কাছেও আমাদের মাথা নত করতে হবে। তাই দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়নের আশীর্বাদে বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হলেও বাংলাদেশে বাংলা ভাষার দেশায়ন হচ্ছে না। অথচ জাপানিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জাপানি ভাষার চর্চা করে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতির দেশ ও উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে।

বলাই বাহুল্য, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের তাত্ত্বিকরা ‘উন্নয়ন তত্ত’ প্রচার করেন। আর এই তত্তের মূল কথা ছিল যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যদি নিজেদের উন্নয়ন করতে চায় তবে তাদেরকে কৃষি ব্যবস্থা থেকে বের হতে হবে এবং প্রযুক্তির দিজে অগ্রসর হতে হবে। তাই ্এসব দেশ যখন কৃষি ছেড়ে এই তত্তের মাধ্যমে অগ্রসর হলো তখনই তারা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ভাষার ক্ষেত্রেও এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা কম নয়। কারণ যখনই বিশ্বায়নের সুবাদে আমরা অন্যের ভাষাকে বেশি করে চর্চা শুরু করবো, তখনই বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।

অন্যের ভাষার উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে। যে লক্ষ্য নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল তার স্বকীয়তা হারিয়ে যাবে। তাই এখনই সময় বাংলাকে ব্যবহারিক ও উন্নত ভাষা গুলোর সমকক্ষ করে তোলার পদক্ষেপ নেয়া। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.