আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পূঁজির অত্যাচার



২০০৭ সালে যখন বিশ্বব্যপী বার্ড ফ্লু সংক্রামনের আশংকায় আতংকিত সবাই, তখন বৈশ্বিক চাপ ছিলো ইন্দোনেশিয়ার উপরে, তার সংগৃহীত H5N1ভাইরাসের স্যাম্পল অন্য দেশকে দিতে চায় নি, বরং তার আগে ইন্দোনেশিয়া নিশ্চয়তা চেয়েছিলো, যদি ইন্দোনেশিয়াতে কখনও বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন যেনো এই নমুনা আদানপ্রদানের বিনিময়ে তারা এর প্রতিষোধক টিকা পায় স্বল্পমূল্যে। এশিয়ার অধিকাংশ দেশ, যেখানে পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠেছিলো, সবগুলো দেশেই বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছিলো "হু"। তেমন বড় মাপের দুর্ঘটনা ঘটে নি, বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে ধ্বস নেমেছিলো সামরিক বাহিনীর নিজস্ব পোল্ট্রি ফার্ম থেকে আক্রান্ত ফ্লু অন্য সবগুলো পোল্ট্রি ফার্মে ছড়িয়ে পড়বার পরে। সে সময় থেকেই একটা বিষয় নজরে এসেছে আমার। আমাদের ভবিষ্যত, আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটাই পূঁজির দ্বৈরাত্বে সেইসব কর্পোরেটদের উপরেই নির্ভরশীল।

আমরা মানবাধিকারের অনেক কথাই বলছি, কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ মহামারী ছড়িয়ে পড়বার সময়েও আমরা অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে আছি বড় বড় ঔষধ কোম্পানীর অনুগ্রহের উপরে। তারা নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে যতটুকু প্রতিষোধক টিকা উৎপাদন করতে পারবে তার সবটুকুই কিনে নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এই ঔষধকোম্পানীগুলোর কাছে ঠিক কতটাকার ফ্লু ভ্যাকাসিন কিনেছিলো, সে উপাত্ত হয়তো এখনও একটু ঘাঁটলেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অঙ্কটা নেহায়েত কম না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বার্ড ফ্লুর সংক্রামন ঘটে নি। ঘটবার সম্ভবনাও ছিলো কম।

যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে এইসব জীবানুজনিত দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ রাখতে প্রতিটা পোর্টেই ব্যপক নিরাপত্তা গ্রহন করেছে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, রোগ বহন করতে পারে এমন যেকোনো পণ্যই সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। মেক্সিকোর সাথে প্রতিদিন অনেকগুলো দেশের বিমানযোগাযোগ ও সীমান্তযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সদ্য ছড়িয়ে পড়া সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থেকে পুনরায় ব্যস্ত ঔষধ কোম্পানিগুলো। তারা এর প্রতিষোধক নির্মান করছে, প্রায় ২০ মিলিয়ন ইউনিট।

আমি যখন দেখেছিলাম তখন একটা ইউনিটের দাম ছিলো ২০০ ডলার। সুতরাং ঔষধ কোম্পানিগুলোর এমন এক একটা মহামারী ছড়িয়ে পড়লে লাভের অঙ্ক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। একটা সময়ে ঢাকা শহরের প্রায় সমস্ত বাসাই নির্মিত হতো দাহ্য সামগ্রী দিয়ে, খড়, বাঁশের বেড়া, এবং কাঠ, এসের সাংবাৎসরিক চাহিদা ছিলো ঢাকা শহরে, কিন্তু মাঝে মাঝে ব্যবসায় মন্দা গেলে কোনো এক ব্যবসায়ী কোনো একটি বসতির একটা ঘর আগুণে পুড়িয়ে দিতো, দমকল বাহিনী নামক কিছুই ছিলো না বলে সংলগ্ন সকল বাসাই পুড়ে যেতো, ব্যাবসা আবারও সরগরম হয়ে উঠতো নির্মানসামগ্রী ফেরি করা ব্যবসায়ীদের। কোম্পানীগুলো, বিশেষত বহুজাতিক কোম্পানীগুলো রাষ্ট্রের তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠছে প্রতিদিন। এখন এইসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পূঁজির খাই মেটাতে রাষ্ট্রে দাঙ্গা বাধে, অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, কেয়ার্নস কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই ঘোষণা দিলো তাদের গ্যাসের চাপ কমেছে, দেশব্যাপী লোড শেডিং বেড়ে যাবে।

তারা দ্রুত গ্যাসউত্তোলনের জন্য বাড়তি চাপে গ্যাস তুলতে চায়। অবশ্য প্রতিটা খনি নির্দিষ্ট একটা পরিমানে গ্যাস তোলা হলে প্রায় নিরাপদ মাত্রায় গ্যাস তুলে যতটুকু উত্তোলন সম্ভব ততটুকু উত্তোলন করলে আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয় কম, কিন্তু যখন বাড়তি চাপে গ্যাস তোলা হবে তখন ভূপ্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকা রয়ে যায়। কিন্তু কেয়ার্নস যেহেতু এই দেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে, তাই যতদ্রুত সম্ভব তারা গ্যাস নিঃশেষ করে চলে যেতে চায় মুনাফা নিয়ে। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই নিয়ন্ত্রন করছে পরোক্ষ ভাবে এইসব বহুজাতিক সংস্থার কর্তা ও কর্মচারীগন। তাদের খেয়াল ও মর্জির উপরে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নির্ভর করছে।

এইসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকগুলোই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এবং আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি আসলে এইসব যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থাগুলোর পূঁজি ও ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া। রাশিয়ার পতনের পরে আমেরিকা একক ভাবেই সমস্ত বিশ্বকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইছে। এমন কি বারাক ওবামা যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন তখন তার ভাষণ শুনে মনে হলো বিশ্বের শাসনভার তার কাঁধে ন্যস্ত হয়েছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে সাতটি মহাদেশের নিরাপত্তা- অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি ও নিরাপত্তার ভার ওবামার কাঁধে এসেছে। এই মোড়লগিরি চলবে আরও অনেক দিন। বিকল্প একটা জোট তৈরির চেষ্টা চলছে, সেটা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আসলে এই ভারসাম্যবিহীন অবস্থা চলতেই থাকবে।

অনেকগুলো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বাজারে চালু আছে। তার একটি হলো এই সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসিটির জেনেটিক সজ্জ্বা পরিবর্তিত হয়েছে যতটা শুকর মানব সহাবস্থানের কারণে, তারও একটা অংশে কিংবা মূলত বড় বড় ঔষধ কোম্পানীর নিজস্ব ব্যবসার স্বার্থও এখানে উপস্থিত। মিশর ব্যপক হারে শুকর নিধন করেছে। তবে তাদের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তারা বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে নিজস্ব প্রযুক্তি প্রতিষোধক আবিস্কার করেছেন , এই প্রতিষোধকের কার্যকারিতা আমদানিকৃত প্রতিষোধকের তুলনায় অনেক বেশী। এমন ছোটো ছোটো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বহুজাতিক এবং ব্যপকপূঁজিক ঔষধ কোম্পানির প্রভাব কমিয়ে ফেলতে হবে।

ইন্দোনেশিয়ার দাবিটা এখনও পুরণ হয় নি, হবেও না, "হু" কিংবা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানই আসলে পরোক্ষভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় এইস পূঁজির প্রবাহে। পৃথিবীতে একদিন এমন দিন আসে, যখন পৃথিবীতে কারা বসবাস করবে এবং কারা টিকে থাকবে, এটা নির্ধারণ করবে গুটিকয়েক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, তারাই রাষ্ট্রবিহীন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করবে এবং তারা হয়ে উঠবে ইশ্বরের তুলনায় ক্ষমতাবান। তারাই প্রার্থনা এবং নির্বানের নিজস্ব রীতি তৈরি করবে। আমাদের সভ্যতা মনে হয় সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে। আমরা সামনে আরও কৌশলী মহামারীর সম্মুক্ষীণ হবো, এমন সব পোষা ভাইরাস, যা মানুষকে উদ্বিগ্ন করবে এবং বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা তৈরি করবে।

কিন্তু যা ব্যপক হারে মানবঘাতি হবে না। সোয়াইন ফ্লু নিয়ে নতুন ঘোষণায় হু বলেছে, সেটা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বার সম্ভবনা ক্ষীণ। কোনটা সত্য এবং কোনটা মিথ্যা এটাও যাচাই না করে বলা যাচ্ছে না এখন।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.