আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছেলেবেলা

তাহমিদুর রহমান

বাংলাদেশ মানচিত্রে নিচের দিকের একটি উপজেলা হচ্ছে আলীকদম। বান্দরবান হয়ে চকরিয়া, লামা ইত্যাদি পার হয়ে এই জায়গায় যেতে হয়। আমার ছেলেবেলার অনেকটা সময় এখানে কেটেছে। সম্ভবত পাঁচ বছর ছিলাম সেখানে। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভে উঠি এখানেই।

অনেক স্মৃতি ঘিরে আছে আমার ঐ জায়গায়। সম্ভবত ১৯৯১ সালের দিকে এ জায়গায় আমরা গিয়েছিলাম আমার বাবার চাকুরে সূত্রে। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি উপজেলায় কোন কোয়ার্টার ফাঁকা নাই। অবশেষে আমরা যে বাসায় উঠেছিলাম সে বাসাটা ছিল টিনের। টিনের নিচে বাঁশের ছাউনি যেন টিন না দেখা যায়।

সেই বাসায় উঠার পর যেহেতু কোন আসবাবপত্র ছিল না সেহেতু মাটিতে বসে আমরা খেতাম প্রথম প্রথম। তার আগে আমরা কখনো মাটিতে বসে খাইনি। প্রথম রাতটা কাটিয়েছি সবাই এক বিছানায় শুয়ে। বৃষ্টির দিনে খুব মজা হত। দূরে দেখতাম বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে বৃষ্টি নাই।

শোঁ শোঁ করে বৃষ্টি এগিয়ে আসছে আর মুহূর্তে অসংখ্য জল কনা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেশ মজার ছিল যদিও তারপরেই জ্বর মামা ভাল থাকতে দিত না। আমার বা হাতটা ভেঙ্গে গিয়েছিল ছোটবেলায়। আমার বয়স পাঁচ কি ছয় ঠিক মনে নেই এখন। তখন আমরা আলিকদমে যাওয়া কিছুদিন হয়েছে।

দৃশ্যটা মনে হয় সবার কাছে মজার ছিল। আমি খুব শুটকু টাইপের ছিলাম। সবাই আমাকে কার্টুন বলেই ডাকত। তো আমি বোলিং প্রাকটিশ করতে করতে রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ পায়ে বেঁধে পড়ে গেলাম।

আমার পড়ে যাওয়া নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে। কিন্তু আমি আর উঠছি না দেখে এক আংকেল এগিয়ে আসলেন আমাকে মাটি থেকে উঠাতে। আমার হাতটা হাতে নিয়ে দেখলেন এবং সাথে আমিও দেখলাম আমার বা হাতের নিচের দিকে লম্বা সোজা একটা গর্ত হয়ে গেছে। সাথে সাথে উপজেলা হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। বাঁশের কয়েকটা ছোট লাঠি দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হল।

তাও ব্যান্ডেজ কিনতে হয়েছিল আমার আম্মাকেই। তারপর রাতে সে কি ব্যাথা। আমি ব্যাথায় কঁকাচ্ছি আর আম্মা সারা রাত জেগে আমাকে দেখে রাখছেন এবং কাঁদছেন। সকালবেলা ঠিক হল আমাকে মালুমঘাট নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানে একটা বিদেশী হাসপাতাল আছে শুধু ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগায়।

কিন্তু সমস্যা হল কে আমাকে নিয়ে যাবে। আব্বা কি একটা কাজে বান্দরবান গিয়েছিলেন। আম্মাও বেশি কিছু তখনো চিনত না বা একা কোথাও এর আগে তেমন একটা যাননি। সত্যি কথা বলতে কি উপজেলায় এমন কেউ এগিয়ে আসেনি এ বিপদের দিনে। অবশেষে এক আংকেল নিজ ইচ্ছায় রাজি হলেন যখন আম্মা রেগে গিয়ে সবাইকে বললেন, আপনারা চিন্তা করবেন না।

আমি কোনদিন যাই নাই। তবে ঠিকই চলে যেতে পারব। হাসপাতালে ঢুকতেই আব্বাকে আবিষ্কার করি আমি। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। এক আংকেল আব্বাকে টেলিফোন করেছিলেন।

হাসপাতালে ঢুকে বিছানায় শুয়ে আমার কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আমার হাত নিয়ে ডাক্তার যখন নড়াচড়া করতে করতে চাপ দিলেন আর কড়মড় করে শব্দ হল তখন আমি নাকি এত জোরে চিৎকার দিয়েছিলাম যে, হাসপাতালের সবাই নাকি শুনতে পেয়েছিল। আর আমি নাকি আম্মাকে বলেছিলাম, আমার হাত নাকি আল্লাহর কাছে চলে গেছে। এর একবছর পর, এক ভাই আমার হাত ধরে জোরে টান দিয়েছিল এবং এক দুপুরে আবার রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। যেইকার সেই।

আবার হাত ভাঙ্গল। সেই একই হাত। একটা হাড় ভেঙ্গেছে আর একটা অল্প জোড়া লেগে আছে। এক্সরে রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, দুইটারই হাড় ভেঙ্গে আবার জোড়া লাগাতে হবে। এইভাবে আমার দুইবার হাত ভাঙ্গে।

এই স্মৃতি ভুলার নয়। আমার এক বছরের বড় একটা ছেলে ছিল। আমি তাঁর সাথেই বেশি খেলাধুলা করতাম। এখন শুনেছি সে রাজশাহী মেডিকেলে পড়ে। যাইহোক, তার দেখাদেখি আমিও স্কুলে যাওয়া শিখেছিলাম।

মজার কথা হচ্ছে, প্রথম যেদিন স্কুলে যায় সেদিন গিয়ে আমি তো একেবারে অবাক। বেশিরভাগ ছেলেই লুঙ্গি পড়া। চোখ মুখ গুলো কেমন যেন। চোখগুলো দেখতে চাইনিজদের মত আর নাক নাই বললেই চলে। কোন রকমে দুইটা ফুটা আছে মুখের উপর।

আস্তে আস্তে তাদের সাথেই খেলাধুলা করতাম। অনেকেই আমার ভাল বন্ধু হয়েছিল। ওরা বেশিরভাগই থাকত স্কুলের হোস্টলে। একদিন হয়েছে কি এক মুরং ছেলে কানে কানে আমাকে একটা কথা শিখিয়ে দেয় এবং আরেক চাকমা ছেলেকে বলতে বলে। আমি কিছুটা বোকা ছিলাম ছোটতে।

অতকিছু না ভেবে বলে দিয়েছিলাম ঐ ছেলেকে। আর ছেলেটার কি রাগ! পরে শুনেছি সেটা একটা ওদের ভাষার একটা গালি ছিল। যে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল তাকে ধরার চেষ্টা করলাম। সে খালি দৌঁড়ায় আমাকে দেখলে। আর আমি তার পিছনে দৌঁড়ায়।

পরে চুপ করে সে আমার গালে চুমু দিয়ে দৌঁড় দিয়েছিল, তারপর আমাকে আর দেখে কে। পারলে আকাশ ভেঙ্গে ফেলি অবস্থা আর কি! বাবা পরে শুনে হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিল, ধুর গাধা। এই জন্যে স্কুল মাথায় তুলতে হবে নাকি। তোমার হেডমাস্টারও তো হাসতে হাসতে তোর কথা বলল। আমি কি বলেছিলাম এখন আর মনে নেই।

আমাদের হেডমাস্টার স্যার ছিল মগ। নামটা এতদিনে স্মৃতি খেয়ে ফেলেছে। আজকাল বইয়ের যে সংকট দেখা দিয়েছি। তখনো ছিল। তবে আমি সবসময় নতুন বই পেয়েছি সেই স্যারের কল্যাণে।

আর অনেকেই দেখতাম পুরনো বই পড়ছে। তখন এতকিছু বুঝতাম না। ভাবতাম ওরা গরীব তাই পুরনো বই পড়ে। তবে একটা জিনিস বুঝতাম আমাদের সাথে ওদের তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। আমাদের আরেকটা স্যার ছিল।

মাঝে মাঝে গগলস চোখে দিতেন। উনার নাম মনে আছে। উনার নাম হচ্ছে উথাই প্রু স্যার। উনার সাথে আমার একটা ছবি আজো আছে। স্যার আমাকে খুব ভালবাসতেন।

ক্লাস থ্রিতে মনে হয়, আমাদের ড্রয়িং পরীক্ষা ছিল। আমি ড্রয়িং করতে একদম পারতাম না। বাসা থেকে আম্মার কাছ থেকে এঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম পরীক্ষার হলে। কলা, পেঁপে, বেগুন এ জাতীয় কিছু। তারপর খাতার নিচে সেগুলো রেখে মহাআনন্দে ছবি আঁকছিলাম।

কোন স্যার ধরতে পারে নাই। কিন্তু ঐ স্যার ধরতে পেরেছিলেন এবং অন্য স্যাররা যেন কিছু না বলতে পারেন সেদিকটাও দেখেছিলেন। স্যার বলতেন, সোহেল তুমি গেলেই তো আমাকে ভুলে যাবা। আমি হাসতাম। বলতাম, না স্যার, আপনাকে ভুলব না।

মাঝে মাঝে স্যারের বাসায় গিয়ে বসে থাকতাম স্যারের বিছানায়। বেশ মজা হত। ক্লাস ফাইভে যখন উঠি তখন রেজাল্ট নিতে গিয়েছিলাম স্কুলে। স্যার হেডমাস্টারের রুম থেকে বের হয়ে বললেন, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু তোমাকে ফার্স্ট করা গেল না, সেকেন্ড হয়েছ। তখন হাই স্কুলে পড়ত আমার ভাইয়া(শাহজালাল থেকে সি এস ই তে পাশ করে এখন সে জিপিতে জব করে)।

সবাই আমার চেয়ে ভাইয়ার গুনগানই করত। তাই ছোটবেলা থেকে সব সময় ওকে পছন্দ করলেও হিংসায় বেশি করেছি। তবে ওর স্কুলে বেড়াতে যেতে খুব ভাল লাগত আমার। কারন ভাইয়া প্রতিবছর সেখানে ফার্স্ট হত। ফলে আমি বেড়াতে গেলেই সবাই বলত, ঐ দেখ সুমনের ভাই আসছে।

নিজেকে খুব ইম্পোট্যান্ট মনে হত। একবার দেখি সে কোথা থেকে একটা ব্রুসলির ছবি সংবলিত একটা বই নিয়ে আসছে। সে নাকি ক্যারাটে শিখবে। কিছুদূর পর দেখি বাসায় এক ছেলে ওর কাছেই ক্যারাটে শিখতে আসত। আমি তো হেসে বাঁচিনা।

শিখতেই শিখতেই শিক্ষক হয়ে গেছে। ভাইয়া সবকিছুতেই অলরাউন্ডার ছিল। বেশ সুন্দর গানের গলা ছিল, সুন্দর কবিতাও লিখত। একবার এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নিজে কবিতা লিখে শামসুর রহমানের কবিতা বলে চালিয়ে দিয়েছিল। মানুষ ধরতেই পারে নাই আর সে প্রথম হয়েছিল।

আমিও ওরই লেখা এক ছড়া আবৃত্তি করে একবার দ্বিতীয় হয়েছিলাম। আমাদের ওখানে সাপের উপদ্রপ ছিল খুব বেশি। বেশ কবার আমরা সাপের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। ভাইয়ার ঘরে যে সাপটা ধরা পড়েছিল সেটা ছিল মনে হয় খয়েরি রংগের। শোকেসের পিছনে লুকিয়ে ছিল।

এখনো মনে পড়লে গায়ের লোম খাঁড়া দিয়ে উঠে। বাইরে থেকে মানুষ এসে ঐ সাপটা মারে এবং মেপে দেখে প্রায় সাড়ে আট হাত। এরপরের সাপটা পাওয়া গিয়েছিল আব্বা-আম্মার ঘরে ওয়্যারডবের পিছনে। এটা ছিল আরো বড়। প্রায় সাড়ে এগারো হাত।

আম্মা ঘর গুছাতে গিয়ে সাপটা আবিষ্কার করে। তারপর চিৎকার চেঁচামেচি। ততক্ষনে আমরা কান্না কাটিও শুরু করে দিয়েছি। এবারো বাইর থেকে মানুষ এসে সাপটা মেরে ফেলে। এ সাপটা সবুজ রংগের, ডোরাকাটা।

আরেকটা সাপ দেখেছিলাম। আমাদের বাসার কাছেই একটা বরুই গাছ ছিল। সেখানে ঐ সাপটাকে উড়ে উড়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু প্রতিবারই সাপটা গাছের পাতার সাথে মিশে যেত। সাপের পর জোঁকের কথা অবশ্যি বলতে হয়।

সব জায়গাতে ছিল জোঁকের আখড়া। রাস্তার পাশেই ঘাসে অসংখ্য জোঁক থাকত। কখন যে শরীরে উঠে বসে থাকত বুঝাই যেত না। একবার তো বাইরে থেকে এসে বাসায় ঢুকেছি। আর মনে হল কেমন যেন লাগছে।

তারপর প্যান্টের মধ্যে হাত দিয়ে দেখি জোঁক। আর যাই কোথায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুলেছিলাম। একবার বাসার সবাই মিলে বান্দবানের এক পাহাড়ে উঠেছিলাম। উঠতে পাক্কা এক ঘন্টা লেগেছিল।

পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে উঠছি আর রাস্তার আশে পাশে দেখি বিরাট গর্ত। চারদিকে কোন মানুষজন ছিল নাই। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখি মানুষ। কি আশ্চর্য। ঠিক উপজাতীয়রা যেভাবে বাসা বানায় সেরকম অনেকগুলো বাসা এবং কিছু কিছু দোতলাও ছিল।

সেখানের মানুষের সাথে আমার ছবিও আছে। সেইবারই প্রথম আমি পাহাড়ে উঠি। একদিন দিনে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল আর রেডিওতে দশ নম্বর বিপদ সংকেত দিয়েছিল। রাতে আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি আমি বাসায় না অন্যজায়গায়।

পরে ধরতে পারি আমি চেয়ারম্যানের বাসায়। আমাদের বাসার কাছেই চেয়ারম্যানের সরকারী বাসা ছিল। রাতে নাকি তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। অথচ আমি কিছুই জানি না। আমাকে কোলে করে নিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল আব্বা, তাও বুঝতে পারিনি।

তবে রাতটা খুব ভয়ের ছিল। আমি ছাড়া বাকি সবাই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।