আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বায়বীয় ভাবমূর্তির দোহাই আর কত?

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম সাভারের ভবনধসের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করার ব্যাপারে গণমাধ্যমকে কার্যত সাবধানতা অবলম্বনেরই পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর প্রশ্নটা খুব সহজ, কেন আমরা বারবার এসব দেখাচ্ছি? বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি এসব ছবি ‘বারবার’ না দেখানোরই পক্ষে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের এসব ছবি ও সচিত্র প্রতিবেদন কেন দেখানো যাবে না, সেটাও মোটেই অস্পষ্ট নয় তাঁর কাছে—‘এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে’। এই বক্তব্যে যে ইতিমধ্যেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেটা নিশ্চয় বিজিএমইএ এবং তার নেতারা জেনেছেন। আমি অবাক হব না যদি অচিরেই এমন কথাও আমরা শুনতে পাই যে তাঁর কথা সঠিকভাবে গণমাধ্যমে আসেনি।

তাঁর নিজের কণ্ঠের এবং সচিত্র প্রমাণ থাকলেই যে তিনি এমন কথা থেকে বিরত থাকবেন, এমন আশা করারও কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে যাঁরা বিভিন্নভাবে ক্ষমতাশালী, সরকারে থাকা, বিরোধী দলের নেতৃত্বে আসীন হওয়া কিংবা বিত্তের জোর, যে কারণেই হোক তাঁদের কথা প্রায়ই যে মিডিয়া ভালোভাবে ‘বুঝতে’ পারে না, সেটা আমরা জানি। পরে তাঁরা আমাদের সবিস্তারে ‘বোঝানো’র চেষ্টা করেন। নির্বোধদের বোধশক্তি দেওয়ার জন্য তাঁদের এই চেষ্টা নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। ভবনধসের কারণ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়েও এ ধরনের কথাবার্তা আমরা শুনেছি।

কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত বিজিএমইএ সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম বলছেন যে আমরা তাঁর কথা ভুল বুঝেছি, আমরা ধরে নিতে পারি এটাই তাঁর কথা যে দেশের ভাবমূর্তির স্বার্থে বারবার এসব ছবি দেখানো উচিত নয়।
দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টা একেবারে নতুন কিছু নয়। প্রায়ই আমরা সরকারের কাছ থেকে এ কথা শুনতে পাই যে বিরোধীরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের কথা অনেকের হয়তো মনে হবে। দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর উত্থানের সময়টাতেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশে ও দেশের বাইরে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলছিলেন যে দেশে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নেই, দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য একধরনের ষড়যন্ত্র চলছে।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী বাংলা ভাইকে গণমাধ্যমের কল্পিত চরিত্র বলেই বর্ণনা করেছিলেন। জঙ্গিদের তৎপরতার মুখে বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরকে এই বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, এগুলো বানানো। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল যে এমনকি এসব খবর পড়াও ভাবমূর্তি নষ্ট করার কাজে নিয়োজিত হওয়ার মতোই। যত দূর মনে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী সাবেক কূটনীতিকদের নিয়ে সভা করে তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন যেন তাঁরা ভাবমূর্তি নষ্টের এই চেষ্টা মোকাবিলায় সক্রিয় হন।
সাভারে ভবন ধসে পড়ার সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের তুলনা হয় না।

কোনো অবস্থাতেই এদের এক কাতারে দাঁড় করার ইচ্ছে আমার নেই। তদুপরি ভাবমূর্তি নিয়ে সরকারি উদ্বেগের সেটাই যে একমাত্র উদাহরণ তাও নয়। কিন্তু প্রসঙ্গটির অবতারণা করলাম বাংলাদেশে বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালীদের মধ্যে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যে একটা বায়বীয় ধারণা রয়েছে, তার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। দেশের ভাবমূর্তি একটা বায়বীয় বিষয় নয়। কোনো দেশের ক্ষমতাশালীরা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই ওই দেশের ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা আর যা-ই হোক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে ধারণার অধিকারী নন।

যেকোনো দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বাস্তবতাই ওই দেশের ভাবমূর্তি তৈরি করে।
গত প্রায় এক দশকে পৃথিবীজুড়ে একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে পরিচিতি তৈরি হয়েছে, যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে তার পেছনে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ভূমিকা অসামান্য। প্রায় ২৫ বছর ধরে একাধিক দেশে জীবনযাপন ও কাজ করার এবং বাংলাদেশ বিষয়ে যৎকিঞ্চিত পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই কথাটি বলতে পারি। এই শিল্পের এবং অন্যান্য শিল্পের উদ্যোক্তাদের ভূমিকাকে ছোট না করেই এ কথা বলা যায় যে এই শ্রমিকগোষ্ঠীর (এবং প্রবাসে কর্মরত স্বল্পমেয়াদি শ্রমিকদের) কারণেই বাংলাদেশ এক মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে। ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ বলে যে ধারণার উদ্ভব হয়েছে, তাঁর মূলকথাই হলো যে দেশে সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও মানুষের অপরিমেয় শক্তির কারণেই বাংলাদেশ সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, সেই অপরিমেয় শক্তির একটি হলো তার শ্রমিকেরা।

পোশাকশিল্পের অধিকাংশ নারীশ্রমিকের শ্রম এবং ঘাম কেবল বাংলাদেশের অর্থনীতি নয়, সমাজকেও বদলে দিয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে বলে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই। এর নেতিবাচক দিক নেই, এমন বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এই প্রপঞ্চকে বাদ দিয়ে, এই শ্রমিকদের জীবনের কথা বাদ দিয়ে যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির কাল্পনিক গল্প ফাঁদার চেষ্টা হচ্ছে, তা দেখে শুধু ক্ষোভ জাগে তা নয়, এই প্রশ্নও জাগে যে তাহলে কি অতীতের মতো এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে আমরা কিছুই শিখব না? এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধুয়েমুছে বা স্যানিটাইজ করে দেখানোর পরামর্শ সাংবাদিকতার মানদণ্ডে হলে সে নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারতাম, সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিজিএমইএ একমত হতো বলে মনে হয় না (কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের, বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার, যে ব্যত্যয় হয়নি আমি তাও অস্বীকার করব না)।
কিন্তু তথাকথিত ভাবমূর্তির দোহাই তুলে কয়েক শ মানুষের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধুয়েমুছে, বেছে বেছে প্রকাশের ফলে জেনেশুনে এই হত্যাকাণ্ডে যাঁরা শরিক হয়েছেন, তাঁদের অপরাধের মাত্রা যে জনসাধারণের, নীতিনির্ধারকদের, এমনকি বিদেশি ক্রেতাদের চোখে হ্রাস পাবে, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

বিজিএমইএর নেতারা আমাদের সে পরামর্শ দিচ্ছেন কি না সেটাও ভেবে দেখার দাবি রাখে।
আমি অনুমান করি যে ভাবমূর্তি বিষয়ে সরকারের মধ্যেও এ ধরনের একটা প্রবণতা রয়েছে। অন্যথায় এ রকম একটা বিপর্যয়ের পর উদ্ধার অভিযানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সাহায্য না চাওয়ার পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে? পৃথিবীর যেকোনো দেশই এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্যদের সাহায্য নিয়ে থাকে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০১০ সালে চিলিতে একটি খনিতে ৩৩ জন শ্রমিক আটকে পড়ার পর তাঁদের উদ্ধার অভিযানে চিলির সরকার কেবল যে অন্যান্য দেশের সরকারি পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং সাহায্যই নিয়েছিল তা নয়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সাহায্যও নিয়েছিল।

কিন্তু সাভার থেকে কয়েক শ মাইল দূরে কলকাতায় কংক্রিট কাটার যন্ত্র ও ধসে পড়া ভবনে কেউ জীবিত আছে কি না তা দূর থেকে নিরূপণ করার যন্ত্র থাকলেও তার জন্য ভারতকে অনুরোধ করতে সরকারের দ্বিধার পেছনে কী কারণ কাজ করতে পারে, তা বোধগম্য নয়।
বিশিষ্ট প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী জানিয়েছেন যে ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘ উদ্ধারকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সার্চ অ্যান্ড রেসকু অ্যাডভাইজরি গ্রুপের (আইএনএসএআরএজি) মাধ্যমে আমাদের পাশের দেশ থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সহায়তা চাইতে পারত। প্রসঙ্গত, ভারতে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিএফ) ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের একটি দল কলকাতায় রয়েছে। ’ দুর্যোগ মোকাবিলায় এশিয়ায় জাপানের একধরনের দক্ষতা রয়েছে বলেই বলা হয়ে থাকে। ভূমিকম্পপ্রবণ বলে দেশের বড় বড় ভবনধস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা জাপানের রয়েছে।

কিন্তু জাপানের কাছে কোনো রকম অনুরোধ করা হয়েছিল বলে আমরা জানি না। এর কারণ হিসেবে সরকারের অনাগ্রহের পেছনে দেশের ভাবমূর্তির ফাঁপা গল্প যদি কাজ করে থাকে, তবে আমি অন্তত অবাক হব না। ক্ষমতাশালীদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি একটা বায়বীয় ব্যাপার, তাঁরা বুঝতে পারেন না যে নাগরিকদের অবদানই এই ভাবমূর্তির ভিত্তি।

ইলিনয়
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।