আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভোট ভারতে

সাংবাদিক

বিকল্পই বাস্তব শান্তনু দে ভোট যত এগোচ্ছে, ভাঙছে ইউ পি এ। নিঃসঙ্গ হচ্ছে কংগ্রেস। হিন্দি বলয়ে ভাঙন স্পষ্ট হয়েছিল আগেই। উত্তর ভারতের পর এবার দক্ষিণেও জোট সমস্যায় কংগ্রেস। বিহারে কংগ্রেসকে অন্ধকারে রেখে জোট করেছে লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও রামবিলাস পাশোয়ানের লোকজনশক্তি পার্টি।

মুলায়ামের সঙ্গে তারা করেছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ জোট’। তামিলনাডুতে, ইউ পি এ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে পি এম কে। কংগ্রেস-ডি এম কে’র সঙ্গ ছেড়ে রামাদোসের পি এম কে এবার হাত মিলিয়েছে জয়ললিতার সঙ্গে। ফলে তামিলনাডুতে এবার আরও জোরদার কংগ্রেস-বিরোধী শক্তি। শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস এখন রাজ্য-রাজ্যে ‘জুনিয়র পার্টনার’।

অন্যদিকে, বি জে পি’র চব্বিশ-দলের জোট এখন নেমে এসেছে সাকুল্যে পাঁচ-এ। লালকৃষ্ণ আদবানি কলকাতায় যখন জাঁক করে ঘোষণা করছেন, ভারতীয় রাজনীতি মানে শুধুই দুই মেরুর আধিপত্য, যার দুই মেরু হলো কংগ্রেস ও বি জে পি, এবং যাদেরকে ঘিরে জোট গড়বে বাকি দলগুলি, ঠিক তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভুবনেশ্বরে বি জে পি’র সঙ্গে ১১ বছরের সম্পর্কের ইতি টানে বিজু জনতা দল। সেইসঙ্গে ঘোষণা করে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তারা লড়বে বামপন্থীদের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে। যথারীতি তৃতীয় বিকল্পের ভূত দেখছে কংগ্রেস। ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’কে কংগ্রেস বলেছে ‘ভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তম মরীচিকা।

’ বি জে পি’র ভাষায়, ‘নৌটাঙ্কি’। বি জে পি’র দুঃশ্চিন্তা বেশি। কারণ, ১৯৯৯ কিংবা ২০০৪-এর মতো ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দলগুলি এখন তার শরিক হতে চাইছে না। অ-কংগ্রেস, অ-বি জে পি শিবিরে তারা খুঁজছে তাদের জায়গা। এদিকে ক’দিন আগেও কংগ্রেসের অবস্থান ছিল, কোয়ালিশন কখনোই না।

‘জাতীয়’ কংগ্রেস বলে কথা ! এখন এহেন কংগ্রেসেরই তৃণমূলের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পন। বি জে পি’র ঘোষিত লক্ষ্য, দ্বিদলীয় ব্যবস্থা। শুধু বি জে পি, কংগ্রেস থাকবে দেশে। দেশের শাসক শ্রেণীও তাই চায়। পছন্দ ঘুরুক-ফিরুক কেবল দুয়ের মধ্যে।

যারা উভয়েই প্রতিনিধিত্ব করে তাদের স্বার্থকে। বাস্তব বলছে অন্য কথা। দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই কংগ্রেস, বি জে পি’র সাংগঠনিক দাপট সেরকম নেই। নড়ে গিয়েছে সমর্থনের ভিতও। শেষ নির্বাচনে কোনও দলই কিন্তু ১৪৫টির বেশি আসন পায়নি, যা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা (২৭২) থেকে অনেক কম।

এমনকি কংগ্রেস-বি জে পি’র আসন যোগ করলে দাঁড়ায় ২৮৩। সোনিয়া গান্ধী, লালকৃষ্ণ আদবানি চান বা না-চান, ভারতের মতো বহু ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির দেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চলতে পারে না। আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্খা রূপায়িত করতেই বহুদলীয় বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এখন দুই মেরুর আধিপত্য ভেঙে তাই বহু মেরুর আধিপত্য। তাকান হিন্দি বলয়ে।

উত্তর প্রদেশ, বিহারের দিকে। উত্তর প্রদেশ, বিহার মানে লোকসভার ১২০ টি আসন। আর যেখান থেকে লোকসভায় কংগ্রেস ও বি জে পি’র মিলিত আসন সংখ্যা তিনভাগের একভাগও নয়। উত্তর প্রদেশের কথাই ধরুন। মোট ৮০ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস, বি জে পি’র মিলিত আসন সংখ্যা সাকুল্যে ১৯ টি।

আর বিহারে ৪০ টির মধ্যে মেরেকেটে ৮ টি। রাজ্যের পর রাজ্যে হয় কংগ্রেস, অথবা বি জে পি এখন সংখ্যালঘু শক্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে অক্ষমতার কারণেই আজ তারা ‘বন্ধু’ খুঁজতে রাস্তায়। যথারীতি কংগ্রেস, বি জে পি-কে বাদ দিয়ে কেন্দ্রে বিকল্প সরকার গঠনের সম্ভাবনা যত উজ্জ্বল হচ্ছে, ততই কংগ্রেস শিবিরে বাড়ছে অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা। সোনিয়া গান্ধী, প্রনব মুখার্জির মতো হেভিওয়েট নেতাদের মন্তব্যেই এই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা স্পষ্ট।

দলীয় দপ্তরে রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক ডেকে তোপ দেগেছেন প্রনব। কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ‘তৃতীয় ফ্রন্ট বলে একটা কথা আজকাল প্রায়ই শুনছি। এদের লক্ষ্যটা কী ? কর্মসূচীই বা কী ?’ প্রনববাবু ভুলেই গিয়েছেন ইউ পি এ তৈরি হয়েছিল, ২০০৪-এ নির্বাচনের পরে। তাছাড়া, ইউ পি এ নিজেও কোনও সাধারণ কর্মসূচী কিংবা ইশ্‌তেহার নিয়ে ভোটে যাচ্ছে না। কংগ্রেস, আর জে ডি, এন সি পি — প্রত্যেকেরই রয়েছে পৃথক ইশ্‌তেহার।

তাহলে ‘তৃতীয় ফ্রন্টের’ দলগুলির সাধারণ কর্মসূচী নিয়ে ওঁর এত চিন্তা কেন ? আনন্দবাজারে সম্পাদকীয়। ‘সোনার পাথরবাটি’। ‘তৃতীয় মোর্চার সকল শরিক মিলিয়া সওয়াশ’র বেশি আসন লাভের সম্ভাবনা কম। আর এই অঙ্কটি লোকসভায় অর্ধেক আসনের চেয়েও অনেক কম। ’ কিন্তু কংগ্রেস কত পেতে পারে ? না, আনন্দবাজার বলেনি।

কংগ্রেস কত পেয়েছিল ? না, তাও বলেনি। যদি বলতো, তাহলে বলতে হতো ১৪৫। আর যে ‘অঙ্কটা লোকসভায় অর্ধেক আসনের চেয়েও অনেক কম। ’ তিনটি প্রবণতা এরমধ্যেই স্পষ্ট। জাতীয়-স্তরে জোট হিসেবে নির্বাচনে যাচ্ছে না ইউ পি এ।

খারিজ করে দিয়েছে এন সি পি, আর জে ডি’র প্রস্তাব। জানুয়ারি মাসে দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক থেকেই কংগ্রেস সাফ জানিয়ে দিয়েছে, জাতীয় স্তরে কোনও জোট নয়। কংগ্রেস নির্বাচনে লড়বে একা। জোট শুধু রাজ্যস্তরে। আসন সমঝোতা হবে রাজ্যস্তরে।

প্রচারে আনবে ‘শক্তিশালী সর্বভারতীয় ভাবমূর্তিকে’। কার্যত ইউ পি এ’র মৌলিক সত্ত্বাকেই অস্বীকার করা হয়েছে এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে। বস্তুত, জোট রাজনীতিতে কংগ্রেস নতুন অতিথি। কংগ্রেস নিজের শক্তিতে শেষ গরিষ্ঠতা পেয়েছিল পঁচিশ বছর আগে। ১৯৮৪তে, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুতে সহানুভূতির ঝড়ে।

তারপর জোটের গুরুত্বে বুঝতে কংগ্রেসের লেগে গিয়েছে কুড়ি বছর। ১৯৯৬তে নরসিমা রাও যখন উত্তর প্রদেশে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বি এস পি’র সঙ্গে জোট করেন, তখন কংগ্রেসের অন্দরমহল থেকেই ওঠে অভিযোগের আঙুল — নেহরু, গান্ধীর ‘কর্মভূমিতে’ জমি ছেড়ে দিচ্ছেন রাও। এই সেদিন রাহুল গান্ধীও বলেছেন, ওই সিদ্ধান্ত ছিল গুরুতর ভ্রান্তি। অন্যদিকে, বি জে পি’র কৌশল, আঠাশটি রাজ্যের জন্য ২৮টি পৃথক নির্বাচন। বিভিন্ন মঞ্চ ও আবেদনকে ব্যবহার করা।

বিদায়ী লোকসভায় কংগ্রেসের রয়েছে ১৪৫টি আসন। যেক’টি রাজ্যে ভালো ফলের জন্য কংগ্রেসের এই ফল করতে পেরেছিল, সেগুলি হলো — অন্ধ্র প্রদেশ (৪২টিতে লড়ে জিতেছিল তিরিশটি), মহারাষ্ট্র (২৮টিতে লড়ে তেরোটি), গুজরাট (২৫টিতে লড়ে বারোটি), হরিয়ানা (৯টায় লড়ে আটটি) এবং আসাম (১৪টিতে লড়ে ন’টি)। দলের নিজস্ব হিসেব হলো অন্ধ্র প্রদেশ, হরিয়ানা, আসামে এবার আর সেই ফল হবে না। তবে, গতবার যে রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস তুলনামূলকভাবে খারাপ ফল করেছিল, এবারে সেখানে ভালো ফলের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। অবশ্য কংগ্রেসের হাইকমান্ডেরই হিসেব, এতে সংখ্যা তেমন বেশি হবে না।

যেমন কেরালা (গতবাব কুড়িটিতে একটিও পায়নি), মধ্য প্রদেশ (২৯টির মধ্যে সাকুল্যে পেয়েছিল পাঁচটি), কর্নাটক (২৮টার মধ্যে মাত্র নয়টি), রাজস্থান (২৫টির মধ্যে চারটি), পাঞ্জাব (১৩টির মধ্যে দু’টি), ওড়িশা (২১টির মধ্যে দু’টি) এবং ছত্তিশগড় (৯টর মধ্যে মাত্র একটি)। কংগ্রেস মনে করছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে আসন বোঝাপড়ায় তাদের আসন কিছু বাড়বে। যদিও, প্রদেশ কংগ্রেসের হিসেব, গতবারের অর্ধেক আসন (তিনটি) ধরে রাখতে পারলেই যথেষ্ট। শুধু কংগ্রেস নয়, গত নির্বাচনে তামিলনাডু, অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, দিল্লি, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো সাফল্য পেয়েছিল ইউ পি এ। ১৫৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছিল ১২৯টিতে।

তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করেছিল মহারাষ্ট্র, গুজরাট, আসাম ও জম্মু-কাশ্মীরে। এবারে সেই ফলই ইউ পি এ ফের করবে বলে বিশ্বাস করা বেশ শক্ত। তামিলনাডুতে, তার প্রধান শরিক, ডি এম কে (২০০৪-এ ছিল ১৬টি আসন) তুমুল প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মুখে। এবারে হাওয়া উলটোমুখে। প্রতিদ্বন্দ্বী এ ডি এম কে ঊর্ধ্বমুখী।

গতবার ডি এম কে’র শরিক হয়ে কংগ্রেস পেয়েছিল ১০টি আসন। এবারে অতি বড় কংগ্রেসীও জানে, সে সম্ভাবনা আদৌ নেই। গতবার ডি এম কে-কংগ্রেস-পি এম কে একসঙ্গে লড়েছিল। এবারে ইউ পি এ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে পি এম কে। দক্ষিণের মানুষের জানেন, পি এম কে তামিলনাডু রাজনীতির ‘হাওয়া-মোরগ’।

এবারে এ ডি এম কে-পি এম কে-বামপন্থীরা একজোট হয়ে ভোটে নেমেছে। কংগ্রেস ভেবেছিল, অভিনেতা বিজয়কান্তের এম ডি এম কে তাদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু তারাও ঘোষণা করে দিয়েছে একা লড়বে, কংগ্রেসকে নিয়ে নয়। অন্ধ্রে, টি ডি পি-বামপন্থী-তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির জোট এবং অভিনেতা চিরঞ্জীবীর নতুন দল — দুইয়েরই চ্যালেঞ্জের মুখে ইউ পি এ। বিহারে, লালু প্রসাদ যাদবের (২০০৪-এ ছিল ২৪টি আসন) বাজার তেমন ভালো না।

খুব সম্ভবত, লালু প্রসাদ জমি হারাতে চলেছেন নীতিশ কুমারের জনতা দল (সংযুক্ত)-এর কাছে। এহেন লালু প্রসাদ কংগ্রেসের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন মাত্র তিনটি আসন। আর এই আসন দেওয়ার আগে কোনওরকম আলোচনা পর্যন্ত করেননি। আর বিহারে ‘তিন’-ই এখন ‘জাতীয়’ কংগ্রেসের কাছে বড় সংখ্যা। বেগতিক দেখে কংগ্রেস বিহারে চল্লিশটির মধ্যে ৩৭ টি আসনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বন্ধু খুঁজতে নেমে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বস্ততম মিত্রকে শত্রু বানিয়েছে কংগ্রেস। গুজরাটে, ছাব্বিশটির মধ্যে বারোটি আসন ধরে রাখাও রীতিমতো কঠিন। অবশ্য, মহারাষ্ট্রে এন সি পি (ছিল ১১টি আসন)-র আসন ধরে রাখার সম্ভাবনা প্রবল। গতবার মহারাষ্ট্রে ৪৮টি আসনের মধ্যে ২৭টিতে প্রার্থী দিয়েছিল কংগ্রেস। ২১টিতে দিয়েছিল এন সি পি।

কিন্তু এবার প্রথমে সমান-সমান আসন ভাগের দাবি তোলে এন সি পি। শারদ পাওয়ারের দলীয় মুখপত্র ‘রাষ্ট্রবাদী’তে সম্পাদকীয়তে দস্তুরমতো কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয় — ‘যদি শারদ পাওয়ার, লালু প্রসাদ যাদব প্রধানমন্ত্রী হতে চান, তবে বলা হয় ক্ষমতালোভী, আর রাহুল গান্ধী হলে বলা হয় দেশের স্বার্থে। ’ শুধু তাই নয়, ওই সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, ‘রাহুল গান্ধীর মতো অনভিজ্ঞ যুবকও এখন আমাদের সিনিয়র নেতাদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ’ কেরালা, ওড়িশার মতো ছোট রাজ্য এবং মধ্য প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর এবং কর্নাটক থেকে এই লোকসান পুষিয়ে নিতে চাইছে ইউ পি এ। তবে এখান থেকে বড় জয় পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

একমাত্র যা দিতে পারত উত্তর প্রদেশ। যেখানে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের রয়েছে দুর্বল, টলোমলো সম্পর্ক। তবে ঘটনা হলো, জোট তেমন কাজ করছে না। দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আসন সমঝোতা ভেস্তে গিয়েছে।

কংগ্রেসকে ১৫টির বেশি আসন দিতে নারাজ ছিলো সমাজবাদী পার্টি। কংগ্রেস চেয়েছিল অন্তত পঁচিশটি আসন। শুরুতে কংগ্রেস চব্বিশটির নাম পর্যন্ত ঘোষণা করে দেয়। মুলায়ামও পালটা ৭৪টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয়। ক্ষুব্ধ কংগ্রেস বলেছে একা লড়বে।

শেষে উত্তর প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আশিটির মধ্যে ৬৫ টি আসনে লড়বেন। এরমধ্যে ৫৬ টি কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম কংগ্রেস ঘোষণা করে দিয়েছে। ‘জয় হো’ বলে যতই প্রচার করতে চাক-না-কেন, জোটের জট কিছুতেই কাটাতে পারছে না কংগ্রেস। এরমধ্যেই সম্পর্ককে আরও বিষিয়ে তুলেছে মুলায়মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা খুচিয়ে তোলা, যার জন্য কংগ্রেসকেই দায়ী করছেন অমর সিংরা। সমাজবাদী পার্টি এরমধ্যেই বাবরি-কান্ডের সময় মুখ্যমন্ত্রী থাকা কল্যান সিংয়ের সঙ্গে জোট করেছে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মারাত্মকভাবে যুক্ত কল্যানের সঙ্গে মাখামাখিতে মুসলিমদের স্বঘোষিত মাসিহা মুলায়ম যথেষ্ট অস্বস্তিতে। সবমিলিয়ে ইউ পি এ’র আসন সংখ্যা ২০০-২৩০ (মাঝামাঝি অবস্থান, ২৭২) পেরনোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট হলেও নয়। এমনকী, তার শরিকরা লোকসান পূরণ করে দিলেও নয়। আর এই সংখ্যা ২০০৪-এর মতো আদৌ সরকার গঠনের পক্ষে যথেষ্ট নয়।

কারণ, তখন সঙ্গে ছিল ৬১ জন বামপন্থী সংসদের সমর্থন। বিপরীতে, এ থেকে ফায়দা তোলার সম্ভাবনা এন ডি এ’র যথেষ্ট কম। বি জে পি একমাত্র গুজরাটে জয়ের প্রশ্নে নিশ্চিত। বি জে পি’র জন্য মধ্য প্রদেশ (২০০৪ সালে ২৯টির মধ্যে পেয়েছিল উনিশটি), ছত্তিশগড় (১১টির মধ্যে আটটি), কর্নাটক (২৮টির মধ্যে ষোলটি) এবং রাজস্থানে (২৫টির মধ্যে উনিশটি) আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বরং এই রাজ্যগুলিতে বি জে পি তার আসন হারাতে চলেছে।

গুজরাটকে ঘিরে থাকা রাজ্যগুলিতে, যেখানে রয়েছে তাদের অতিরিক্ত চল্লিশ জন সাংসদ, সেখানেও অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। বৃহত্তর আবেদন নিয়ে বি জে পি’র কোনও ইতিবাচক কর্মসূচী নেই। বিজে পি’র ‘দেশ বিপদে, সন্ত্রাসবাদ-মুসলিম-পাকিস্তান’ মঞ্চের তেমন কাটতি নেই। নেই তেমন কোনও নীতি, যা দিয়ে শুধু উঁচুজাত, উচ্চবিত্ত, শহরের অভিজাতদের ভোট ব্যাঙ্কের বাইরে তারা বেরতে পারে। এমনিতেই এন ডি এ’র অবস্থা এখন ডুবন্ত নৌকার মতো।

কোন্‌ দল জোটে আছে, কারাই বা নেই, বি জে পি নেতারাও জানেন না। তামিলনাডু, অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশায় বি জে পি’র আর কোনও শরিক নেই। চব্বিশ দলের জোট থেকে এখন নেমে এসেছে সাকুল্যে পাঁচ-এ। জয়ললিতা, চন্দ্রবাবু, ফারুক আবদুল্লা, পর শেষে নবীন পট্টনায়েকও এন ডি এ ছেড়েছেন। বি জে পি বাদে এইমুহূর্তে এন ডি এ মানে বিহারে নীতিশ কুমারের জনতা দল (সংযুক্ত), হরিয়ানায় ওমপ্রকাশ চৌতালার আই এন এল ডি, উত্তর প্রদেশে অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোক দল, পাঞ্জাবে আকালি দল এবং আসামে আসাম গণ পরিষদ এবং মহারাষ্ট্রে শিব সেনা।

যারমধ্যে জনতা দল (সংযুক্ত) এবং আকালি দলের তাও কিছু আসন ও ভোট রয়েছে। বাকিদের শক্তি সামান্যই। যদিও, এই পাঁচের মধ্যেই ভোটের পর নীতিশ কুমার, অসম গণ পরিষদ, শিব সেনা কী করবে, তা নিয়ে চিন্তায় বি জে পি। বরুনকে মদত দেওয়ায় বি জে পি’র প্রতি হতাশ নীতিশ। প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘কোনও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কাউকেই এরকম বলতে দেওয়া উচিত নয়।

’ অযোধ্যা নেই। কারগিলের যুদ্ধ নেই। নেই বড়সড় দাঙ্গাও। বরুনকে দিয়ে চেষ্ঠা করলেও, বাজার তেমন গরম হয়নি। বি জে পি’র বাজারে তাই মন্দা।

আদবানি, রাজনাথরা বিলক্ষণ জানেন, এই সামান্য শক্তি নিয়ে দিল্লির ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যভেদ অসম্ভব। তাছাড়া, দলের মধ্যে কোন্দল তুঙ্গে। অরুন জেটলি সরাসরি বিদ্রোহ করে বসেছেন দলের সভাপতি রাজনাথের বিরুদ্ধে। প্রার্থী চূড়ান্ত করার সময় আদবানিকে ঘেষতে দেননি মোদি। কর্নাটকে দলের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন প্রকট।

একদিকে মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরিআপ্পা। অন্যদিকে এইচ এন অনন্তকুমার। বি জে পি তার নিজের ১৩৮টি আসন ধরে রাখতে পারবে, একথা আদবানি স্বপ্নেও দেখেন না। এদিকে একমাত্র ব্যতিক্রম মায়াবতী। যিনি কোনও দলের সঙ্গেই আসন সমঝোতা করেননি।

যদিও, কংগ্রেস কিংবা বি জে পি’র চেয়ে অনেক বেশি আসনে লড়ছেন। এটা ঠিক, এই লোকসভায় মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি’র আসন সংখ্যা সাকুল্যে ১৯ টি। তবে এই সংখ্যা দেখে তাদের মাপা আদৌ ঠিক হবে না। নিঃসন্দেহে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি এবার অনেক কিছুই ঠিক করবে। উত্তর প্রদেশে তারা ধারাবাহিকভাবে ভোট এবং আসন বাড়িয়ে চলেছে।

১৯৮৯ সালে যেখানে ছিল ৯.৪ শতাংশ এবং ১১টি আসন (সেবার কংগ্রেস পেয়েছিল ২৭.৯ শতাংশ ভোট এবং ৯৪ টি আসন), ১৯৯৩-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১.১ শতাংশ এবং ৬৭টি আসন। ১৯৯৬-এ, তা আরও বেড়ে হয় ১৯.৬ শতাংশ এবং ৬৭টি আসন। এরপর ২০০২-তে একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩.২ শতাংশ এবং ৯৮টি আসন। আর গত বছর ছিল একেবারে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। ৩০.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪০৩টি আসনের মধ্যে ২০৬টি আসনে (কংগ্রেস পায় সাকুল্যে ৮.৮৪ শতাংশ ভোট এবং মাত্র ২২টি আসন) জিতে, সতেরো বছরে এই প্রথম উত্তর প্রদেশে কোনও দলের হাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন।

সহজ করে বললে, কুড়ি বছরে বহুজন সমাজ পার্টি ১৩ থেকে বেড়ে ২০৬। প্রাপ্ত ভোটের হার ৯.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০.৫ শতাংশ। অন্যদিকে, কংগ্রেস একইসময়ে কংগ্রেস ৯৪ থেকে কমে ২২। প্রাপ্ত ভোটের হার ২৭.৯ শতাংশ থেকে কমে ৮.৮৪ শতাংশ। হতবাক করে দেওয়ার মতো এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে আসলে দলিত নয় এমন মানুষের সমর্থন অর্জন, বিশেষত উঁচু-জাতের একাংশের ভোট।

শুধু তাই নয়, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা মানুষের একটা বিরাট অংশের সমর্থন। সঙ্গে মুলায়ামের সমাজবাদী পার্টির চিরায়ত মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙনও। রাজ্য বিধানসভায় এখন মুলায়ামের ২১ জন মুসলিম বিধায়ককে ছাপিয়ে মায়াবতীর ২৬ জন। বহুজন সমাজ পার্টির বিধায়ক এখন বিহার, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, উত্তরাখন্ডে। জাতীয় ক্ষেত্রে ভোটের চতুর্থ বৃহত্তম অংশ (৫.৩ শতাংশ), এমনকী সমাজবাদী পার্টির চেয়েও (৪.৩ শতাংশ) বেশি।

সি পি আই (এম)-এর (৫.৭ শতাংশের) চেয়ে সামান্য কম। মিডিয়ার কাছে এখন মায়াবতী স্টার। একজন দলিত, একা-মহিলা। জাতবিন্যাসের রাজনীতির মধ্যেই মায়াবতী বহুজন সমাজ থেকে সর্বজন সমাজের ধ্বনি তুলেছেন। এদিকে ইউ পি এ, এন ডি এ যখন ভাঙছে, তখন ভিড় বাড়ছে তৃতীয় শক্তিতে।

মার্চের ১২ তারিখ। বেঙ্গালুরুর কাছে টুমকুর। একমঞ্চে চার বামপন্থী দলসহ জনতা দল (এস), এ ডি এম কে, তেলগু দেশম, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, বহুজন সমাজ পার্টি, হরিয়ানা জনহিত পার্টির মতো ১০ দলের নেতৃবৃন্দ। তৃতীয় শক্তির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। লাখো মানুষকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা — কংগ্রেস, বি জে পি-কে পরাস্ত করতে একজোট হয়ে কাজ করে যাবেন তাঁরা।

পাশাপাশি, নতুন বিকল্প গড়ে তুলবেন। তিনদিন বাদে ১৫ই মার্চ। এবার রাজধানী দিল্লি। মিলিত হলেন নয় দলের নেতৃবৃন্দ। এবারে আরও সংহত তৃতীয় শক্তি।

সভা শেষে যৌথ বিবৃতি। একযোগে কংগ্রেস, বি জে পি-কে পরাস্ত করতে লড়াই চালিয়ে যাবেন। ওই রাতেই বহুজন সমাজ পার্টির নির্বাচনী আবেদন প্রকাশ। মায়াবতীর ওই আবেদনে কংগ্রেস, বি জে পি-কে হারানোর পাশাপাশি ওই দুই শক্তিকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রে নতুন সরকার গঠনের উদ্যোগ চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা। শুধু তাই নয়, লালু প্রসাদের মতো আরও অনেকেই এখন নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন তৃতীয় শক্তির সঙ্গে।

মনে রাখুন, শারদ পাওয়ার কংগ্রেস বা বি জে পি-র সুরে গলা না মিলিয়ে বলেছেন, ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’কে মুছে ফেলা যাবে না। পাওয়ার এও জানিয়ে রেখেছেন, তাঁর দল কারও দাস নয়। আবার এন ডি এ শিবিরের কথাই ধরুন। অসম গণ পরিষদ বি জে পি’র সঙ্গে আসন সমঝোতায় গেলেও জানিয়ে দিয়েছে, তারা মোটেই এন ডি এ’র শরিক নয়। অন্যদিকে, তৃতীয় শক্তির বক্তব্য স্পষ্ট।

এর ভিত্তি হবে জনমুখী অর্থনৈতিক নীতি, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে প্রত্যয়ী অবস্থান, শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও মার্কিন প্রভাব মুক্ত স্বাধীন বিদেশ নীতি। আর এই বিকল্পই আজ বাস্তব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।