আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মনিপেক্ষতা বিষয়ে তালাল আসাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নার্মিন শেখ

যথা বিবিধ রকম, একরৈখিক না; তথা প্লুরালিস্টিকও না

পূর্বের পরে ধর্মনিরপেক্ষতা দীর্ঘদিন থেকে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক বিবেচনা হিশেবে আলোচিত হয়ে আসছে। এই প্রেক্ষিতে ধর্ম এবং ধর্মনিপেক্ষতার সম্পর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন? ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা- গ্রন্থে আমি মানুষের সংবেদনশীলতা, অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিক নানা ধারনা (concepts) সমূহ মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয়ে বিষয় (subjects) হিশেবে অভিযোজন করবার প্রসঙ্গটিতে দৃষ্টি দিয়েছি; যাকিনা মানুষের সত্য বুঝবার পথ নিয়ন্ত্রন করে। পাশাপাশি রাজনৈতিক মতবাদ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুঝতে চেয়েছি। আধুনিক রাষ্ট্রে আইনের ধর্মনিরপেক্ষকরণ এবং নৈতিকতার প্রসঙ্গ সমূহও এক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়েছে। ফলে, এটি একটি জটিল প্রশ্ন হিশেবেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।

এছাড়া অন্য কোন ভাবে আমরা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ নিত্য রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তার সার্বিক গূঢ়ার্থসহ বুঝতে অসমর্থ হব। আমার মনে হয় এসকল বিষয়ে মানব বিজ্ঞান সমূহে আরো অধিক ভাবনা ও মনযোগিতা প্রয়োজন, এবং অতঃপর এগুনো যাবে আরো। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অন্য’ হিশেবে চিহ্নিত, আর তাই রাজনৈতিক মতবাদ হিশেবে এটি ধর্মের গড়ে ওঠার সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত হয়। ধরে নেয়া হয়, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট ভাবে ধর্ম হতে সম্পূর্ণতঃই আলাদা হবে। ফলে রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়তই তার আইনী নীতি-প্রক্রিয়া‘র নির্ধারণ/পূণঃনির্ধারণ জরুরী হয়ে পড়ে; কোনটি প্রকৃতই ধর্মীয় আচরণ এবং কতটুকুইবা এর পরিধি তা নির্ধারণ করা বা আইনী সংজ্ঞা প্রণয়ন করা রাষ্ট্রের একটি নৈমিত্তিক কাজ হয়ে পড়ে।

অন্য ভাবে বললে, রাষ্ট্রকে এর থেকে কোন ভাবেই আলাদা করা যায়না। আত্মবিরোধী সত্য হিশেবে (Paradoxically) আধুনিক রাজনীতি কোন ভাবেই ধর্ম থেকে আলাদা বা স্বাধীন আবস্থান নিতে পারেনা; যেমনি করে ধর্মনিরপেক্ষতার একধরনের মামুলি মতবাদ দাবী করে থাকে। তারা মনে করে, ধর্ম ও রাজনীতির নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা পরিসর তৈরী করে নেবে। একটি রাজনৈতিক স্বত্তা বা বাস্তবতা হিশেবে রাষ্ট্র‘র কাজ হচ্ছে কেবল ধর্মের জন-গ্রহণযোগ্য কোন গড়ন দাঁড় করা। ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা- গ্রন্থে আপনি লিখেছেন ‘যুদ্ধ এবং শান্তির মতবাদ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমীয় (এবং অপশ্চিমাদের জন্য অপরিচিত এমন) নয়।

বরং ধনতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার সাথে এটি নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত, পাশাপাশি ক্ষমতা ও সাফল্যের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়ের মধ্যে এটি প্রশ্ন-সাপেক্ষ ও অসম সম্পর্কের সৃষ্টি করে; যা মূলতঃ বিবিধ সমঝোতার ভিত্তিতে, গ্রহণযোগ্যতায় এবং হুমকি নিয়ে একটি সমবেত-ব্যক্তিত্ব অধিগ্রহণ করে’। ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্ব রাজনীতি বিবেচনায় আপনি কিভাবে এই অসামঞ্জস্যতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করবেন? তৃত্বীয় বিশ্বে আরবদেশ সমূহে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি সাধারণ সমলোচনা হচ্ছে- এটি মতবাদ হিশেবে বাইরের বা আরবদেশ গুলোর জন্য অপরিচিত এবং মুসলিম সমাজের জন্য অগ্রহণযোগ্য। আমার কাছে এটি এমন কোন বাঙ্ময় বিতর্ক বলে মনে হয়নি। পূর্ব থেকেই আরব সমাজ ও এর জনগোষ্ঠি বাইরের বিভিন্ন ধারনা ও চর্চা সমূহকে নিজেদের মধ্যে অভিযোজন করে নিয়েছে। এমন কি আমরা এও জানি, মুসলিম দুনিয়া পূর্বের অনেক ধ্যান-ধারনা ও জীবন-যাপন রীতির-ই সমন্বিত ও উন্নত রূপ; এবং এভাবেই তাদের বর্তমান সময়ের চিন্তা-ভাবনা, জীবন-যাপন ইত্যাদি তৈরী হয়েছে।

এছাড়া সবসময়ই তারা চিন্তা ও চর্চার ক্ষেত্রে উদারতার সাথে ঋণী হয়েছে। এখন তাই প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এমন কোন্ সমস্যা তৈরী করে যার সমাধান হওয়া প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হচ্ছে? আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের বিবিধ সমস্যাবলীই ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে জটিলতার সূত্রপাত করে। আধুনিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত শাসন প্রক্রিয়া, সহিংসতায় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার, একমাত্র রাষ্ট্র‘র-ই আছে অভ্যন্তরীন ভাবে ক্ষমতা-চর্চা বা শক্তি প্রয়োগের বৈধ নিশ্চিদ্র অধিকার (স্বত্তাধিকার)- এমনসব পূর্বধারণা এবং বহির বিশ্বের সাথে একমাত্র রাষ্ট্রই যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে ও একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিকে সমরূপ শৃংখলায় আগলে রাখতে পারে- মূলতঃ এ সমস্ত কিছুই একটি প্রকল্প হিশেবে কাজ করছে যার মধ্যদিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্রমবিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠেছে। আমরা জানি, পশ্চিম ইউরোপে শুধুমাত্র একটি একক ধর্মকেই কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র সমূহের আত্মপরিচয়ে একমাত্র বিবেচ্য বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল একসময়। বিফলে চেষ্ঠা করা হয়েছিল মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিশেবে গন্য করবার।

এটি ছিল মূলতঃ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রচল-আলাপচারিতার (discourse) ভিত্তিতে রাষ্ট্রের মাধ্যকার বিভিন্ন গড়ন গুলো তৈরী করে নেয়ার-ই একটি প্রক্রিয়া। অন্যদিকে একটি রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্রিয়াশীলতাকে (এ্যাকটর হিশেবে ব্যক্তির ঝোঁক বা প্রবনতাকে) অবিবেচ্য রেখে রাষ্ট্রের মধ্যকার সামাজিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব‘র পূণব্যবস্থাপনাকে তারা তাদের প্রধান সমস্যা হিশেবে মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এসমস্ত কিছুই তাদের নিজেদের মধ্যকার (আত্ম‘র) অন্তর্ভূক্ত বিষয় হিশেবে আসেনি; বরং বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রবণতা হিশেবেই ছিল। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তুকেরা অন্য কোন রাষ্ট্রে রাজনৈতিকদের সাথে নানান সমঝোতা ও মিথষ্ক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতো- এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা করতো নিজেদের অভ্যনত্মরীণ সমস্যাবলী নিয়ে। এবং প্রিন্সরা নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে একধরনের ঐক্য গড়ে তুলতো; আবার ঝগড়া করতো একে অন্যের সাথে।

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকে তারা নিজেদের স্বরাজ টিকিয়ে রাখতে সমস্ত বৈদেশিক কার্যক্রমকেই প্রতিহত করতো। ইউরোপের জাতিরাষ্ট্র গুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও টানাপোড়নের ভিত্তিতেই উদ্ভব হয়েছিল আন্তর্জাতিক আইন (international law)| কিন্তু পরে বিশ্বব্যাপী, বিশেষতঃ উপনিবেশিক চর্চা ও বানিজ্যিক সাম্রাজ্য গঠিত হওয়ার সময়ে আমেরিকা ও এশিয়ার দেশ সমূহের জন্যও এটি সম্পর্কিত হয়ে উঠে। (এ পরিসরে আফ্রিকার ইউরোপিয়ান উপনিবেশ অন্তর্ভূক্ত হয় আরো পরে। ) আন্তঃর্জাতিক বাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বৈধতা বিষয়ে একটি বিখ্যাত বিতর্কে একসময় বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন আন্তঃর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠাতা হুগো গ্রোজিয়াস (Hugo Grotius); যেখানে ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীদের মধ্যে গঠিত বানিজ্যিক চুক্তি সমূহ ছিল এ বিতর্কের মৌলিক/ সমস্যাসঙ্কুল জিজ্ঞাসা। আর তাই ধর্মনিরপেক্ষতা- যে পদ্ধতি বা উদ্দেশ্যেই ক্রিয়াশীল হোকনা কেন- রাষ্ট্রের ক্ষমতা চক্র কি কোন ভাবেই ধর্মীয় বৈসাদৃশ্যকে এড়িয়ে যেতে পারে? উনিশ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে উপনিবেশ সরকারের বিবর্তনে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় ‘স্থানীয়’দের ধর্ম এবং খ্রীষ্টান মিশনারীর ধর্ম প্রচারের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বর্তমান সময়ে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে তৃত্বীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীতিমালা (ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মুক্ত) প্রয়োগে আগ্রহী; এবং সেটি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে ধর্মনিরপেক্ষতা গনতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা গ্রন্থে আমি বলেছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকান ইন্টারনেশন্যাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এ্যাক্ট ২০০৮- এর কিছু প্রয়োগ লক্ষণীয় এবং এটি রাজনৈতিক পূণরুদ্ধার প্রচেষ্ঠারই একটি অংশ যা ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে মৌলিক ভাবে সম্পর্কিত। যদিও আধুনিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে যৌথভাবে কখনো কখনো গঠনমূলক মনে হয়; কোন একটি জায়গায় আপনি এমনটি উলে¬খ করেছেন যে, আধুনিকতার জন্য ধর্মের প্রাতিস্বিকীকরণ (privatization of religion) ধর্মনিরপেক্ষতার নিজস্ব পরিসরেও (যাকে ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়া বলি) গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বরং, ধর্ম কি করে জনপরিসরে বারবার ফিরে আসে এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এটি অনেক জরুরী বিষয়। এক্ষেত্রে উপনিবেশিকতার ভূমিকাকে আপনি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

আপনি কি বিষয়টি আরো একটু খোলাসা করে বলবেন? আমার মনে হয়, জোস কসানোভা (Jose Casanova) বিতর্কে আমার যে মন্তব্য ছিল সে সম্পর্কেই আপনি ইংগিত করছেন এখানে; যেখানে বলা হয়েছিল- আধুনিকতার জন্য ধর্মকে ব্যক্তি পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত করবার কোন প্রয়োজন নেই; যেভাবে মতবাদ হিশেবে ধ্রুপদি ধর্মনিরপেক্ষতা ভাবতে আগ্রহী হয়। কসানোভার বক্তব্য ছিল- কিছু কিছু ক্সেত্রে ধর্মকে গনতন্ত্র ও আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় সহায়ক হিশেবে দেখা যেতে পারে, যেমন কমিউনিষ্ট শাসিত পোলান্ডে ক্যাথলিক চার্চের নীতি প্রচলিত থাকা; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে চার্চ কখনো কখনো ‘অগ্রবর্তী’ রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে। উনার ইতিবাচক উদাহরণ ও বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনায় আমার আলাপ ছিল- উলে¬খিত গুলো ধর্মের এমন কিছু নির্দিষ্ট গড়ন যেগুলো ছিল উদারীকৃত, ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মীয় আন্দোলন; এবং যা মোটেও ‘সমস্যাসঙ্কুল’ ছিলনা। ভিন্ন ভাবে, আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় ধর্ম প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সমস্ত মূল্যবোধ গুলোকে এটি অনেকাংশে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এ বিষয়ে ধর্ম সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও গড়ন তৈরী করে দিতে সহায়তা করে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা যেটি দেখি, ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ফ্রান্সের সামপ্রতিক যে মূল্যায়ন এটি তেমনও নয়।

প্রকৃত অর্থে বিষয়টি কি এভাবে হাজির নয় যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নিজস্ব একটি অনুধাবনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের ইতিহাসে প্রক্রিয়াটি কখনোই সেভাবে উপস্থিত ছিলনা? ধর্মনিরপেক্ষকরণের সময়কালে ‘ইহুদি-প্রশ্ন’, বিশেষ করে ইউরোপে এসময় ব্যপক ভাবে ইহুদিদের খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের বিষয়টিও এক্ষেত্রে নির্বন্ধ উদাহরন হতে পারে। এছাড়া উপনিবেশকালে, বিশেষতঃ যখন ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়াটিও শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেই সময়ে পশ্চিমারা সারাবিশ্ব জুড়ে খ্রীষ্টান মিশনারী প্রেরণের কাজটি শুরু করেছিল; এবং এখনো কাজটি চলছে সভ্যতা ও সভ্যতা-প্রকল্পের সমার্থক হয়ে। ভিন্ন ভাবে বলা হলে বিষয়টি কি এমনও নয় যে, ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রকল্পে ধর্মীয় বিষয়াবলী ম্রীয়মান হয়ে যাওয়া দূরে থাক, খ্রীষ্টান ধর্ম এবং ধর্মতত্ত্বের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এবং এটি মূলতঃ নাটকীয় ভাবেই আধুনিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও বানায়? না, আপনার এমন প্রারম্ভিক মন্তব্য‘র আমি দ্বিমত পোষন করছি। মনে রাখতে হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মূলতঃ একটি প্রক্রিয়া; সম্পূর্ণভাবে পরিসমাপ্ত কোন অবস্থা নয়। এবং নিশ্চিত ভাবে এটি পশ্চিমের ’স্ব-বোধগম্যতা’ থেকে উদ্ভুত।

কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন গড়ন নিয়েছে, এবং সর্বোপরি এটি তৈরী করেছে নানান বৈপরীত্ব ও টানাপোড়ন। সমপ্রতি ফান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে আমার লেখা একটি প্রবন্ধে আমি বিশদ ভাবে এই বিষয়টিই উপস্থাপন করেছি যে, প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার এমন একটি উদাহরণও খোঁজে পাওয়া যাবেনা যাকে আদর্শ (ideal) বলা যায়। তবে আপনার শেষ প্রশ্নে‘র প্রতিউত্তরে আমি বলতে চাই- হ্যাঁ, অবশ্যই ইউরোপে খ্রীষ্টান ধর্ম এখনো সজীব (এবং ভূমিকা রাখছে দেশের অভ্যন্তরে আর বাইরেও) এবং অবশ্যই এটাও স্বীকার্য যে, আধুনিক সময়ে খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্বে অনেক নিবিড় সংস্কার এসেছে। কিন্তু তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন প্রকরণ ইউরোপে নেই বলে প্রমানিত হয়না। আমার বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, ইউরোপে প্রকৃতই ধর্মনিরপেক্ষ কোন রাষ্ট্র নেই- এমন প্রচল ধারনাকে বাতিল করা।

আমি মনে করিনা এখানে ‘প্রকৃত’ কোন ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় বর্তমান আছে। বরং আছে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহাসিকতাপূর্ণ কিছু গড়ন যাকে ইতিহাসে আধুনিক সমাজে ক্ষমতা-সম্পর্কের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও প্রগতি‘র ক্ষেত্রে জনধর্মের হুমকি স্বরূপ। আপনি বলেছেন, ‘কোন বিপ্লব নিতান্ত বিশ্বাস থেকে চালিত হয়না অথবা ইউরোপে জনপরিসরের অযৌক্তিক আলাপচারিতা কোন ভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পর্কে নিরপেক্ষ নয়’। এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কেন বলা হয় যে, ইসলামপন্থিরা ধর্মের ‘রাজনীতিকীকরণ’ ঘটাচ্ছে? সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে, ইসলামপন্থিরা কোন ভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতার উর্দ্ধে কিছু নয়, তারা চাননা জিহাদ কেবল ব্যক্তিবিশ্বাসের (mere personal belief) তলানি হিশেবে থাক। আপনি আরো বলেছেন, ‘(প্রত্যাশানুযায়ি) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সার্বিক সহিষ্ণুতার দায়ভার গ্রহণ করেনা; বরং যাবতীয় উচ্চাকাংখা ও উদ্বেগ নিয়েই এটি সচেষ্ট/সচেতন থাকে’।

এমন ভাবনা দিয়ে- ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ যেকোন ধর্মভিত্তিক সমাজের চেয়ে কম সহিংস ও কম দ্বন্ধ মূখর- এই পূর্বধারনাকে কি করে অমীমাংসিত অবস্থায় উপস্থাপন করতে পারে? ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ন্ত্রন, লালন ও এড়ানোর ক্ষেত্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা-ইবা কি? অন্যান্য‘র মতন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নিজেও এধরনের কিছু দায়ভার নিয়ে থাকে, তবে অন্যের দায় থেকে সে মুক্তই থাকে। এটি যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধতকা ও গোপনীয়তা ব্যতিরেখে রাষ্ট্রের জনমানুষের ধর্ম ও বিশ্বাস চর্চার অধিকারকে নিশ্চয়তা প্রদান করে। এবং রাষ্ট্র এই-নিশ্চয়তা ততক্ষণ পর্যনত্মই দিতে থাকে যতক্ষণ না এটি রাষ্ট্রের অখন্ডতায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ‘হুমকি’কে কোন সুনির্দিষ্ট অর্থে ধরা যায়না এখনে। দ্বন্ধ ও সহিংসতায় সত্যিই কি একটি ধর্মনিরপেড়্গ সমাজ কম পড়্গপাত পোষন করে? সহিংসতা আর দমন প্রক্রিয়ার কিছু প্রসিদ্ধ গড়ন আপনি হয়তো পাবেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কম-সহিংসতা-ব্রতকে ব্যাখ্যা করবার জন্য; যে গড়ন গুলোকে খোদ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই সংঙ্গায়িত করে থাকে, যেমন রাষ্ট্রে অভ্যন্তরে- রেস, জেন্ডার, ক্লাস ইত্যাদি এইসব; এবং বহির্বিশ্বে নব্য-সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব, বিদ্রোহ দমন ইত্যাদি।

দেশের অভ্যনত্মরে এবং বাইরের সহিংসতা, দমন, দ্বন্ধ-এসকল বিষয়ে উদার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহ রাজনৈতিক ভাবে বরং এখন অনেক সচেতন। মূল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।