আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাশবাবু (১)



কার্তিকের রাতে এখন বেশ হিম পড়ে। নদীর ধারে একটু হাওয়াও থাকে। যদিও হিমে ভারি তবু হাওয়াতে একটা শিরশিরাণি ভাব থাকেই। এখনো রয়েছে। তারাপদ চক্রবর্তী তুষের চাদরটা দিয়ে কান-মাথা ভালো করে জড়িয়ে নিল।

তারাপদ বামুনের ছেলে। কিন্তু এই হাঁসপুকুরে তাকে সবাই লাশবাবু বলেই ডাকে। মহকুমা হাসপাতালের লাশঘরেই তার প্রথম চাকরি। লাশের পায়ে নাম ও নম্বর লেখা টিকিট লাগানো, আত্মীয়দের হাতে কাগজ মিলিয়ে ঠিকঠাক ডেডবডি তুলে দেওয়া--এসব কাজই তাকে করতে হতো। কাজের প্রতি ভালোবাসা ছিল না।

গা-গুলোনো ঘেন্নাই ছিল। মাস গেলে যা মাইনে পেতো তাতে বিধবা মা আর তার কোনোরকমে চলে যেতো। দুনিয়ায় খুঁজলে দু'চারজন আত্মীয় পরিজনের সন্ধান পাওয়া যেতো। কিন্তু মা-বেটার তাতে আগ্রহ ছিল না। আত্মীয় কুটুম মানেই এসো-বসো কর্তব্য-কর্ম।

সীমিত ক্ষমতায় এসব বিলাসিতা করার উপায় ছিল না তাদের। বিঘে খানেক জায়গার ঠিক মাঝখানে তিনঘরের ছাদপেটানো পুরনো বাড়ি। চুন-সুড়কির গাঁথনি দেওয়া মোটা দেওয়ালের ওপর কড়ি-বরগার ছাদ। এখন এসব বাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। দেওয়ালে চুন-বালির প্লাস্টার।

শাবলের ঘা দিলে এখনো টং করে শব্দ ওঠে। কোথায় লাগে ময়দানবের সিমেন্টের কংক্রিট! বাবা অভয়পদ ইটভাঁটার ম্যানেজার ছিলেন। নামেই ম্যানেজার। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব দায়িত্বই সামলাতে হতো তাঁকে। সকালে প্রশান্তবদনে বগলে ছাতি নিয়ে পান চিবুতে চিবুতে দেড়মাইল হেঁটে ভাঁটায় যেতেন।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে যখন ফিরতেন তখন তাঁর বিধ্বস্ত ক্লান্ত চেহারা দেখে কাছে যেতে সাহস হতো না তারাপদ'র। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার আগেই দুম করে অভয়পদ মারা গেলেন। ইটভাঁটার মালিক গজেন সাঁপুই তারাপদকে যে কাজ দিতে চেয়েছিলেন দু'চারদিন সেই কাজে নেমে তারাপদ হার মেনেছিল। ট্রাকে ইট-লোডিং-এর হিসেব রাখতে গিয়ে পদে পদে ভুল! লেবাররা যন্ত্রের মতো চোখের পলকে ইট তুলে দিচ্ছে গাদা গাদা।

গুণতে গিয়ে তারাপদ'র ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। এসব কাজ তার হবার নয়। মায়ের হাতে যা কিছু ছিল দ্রুত ফুরিয়ে এলো। অভাব অনটনের ভয়ঙ্কর চেহারাটা তখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। কিছু একটা না পেলেই নয়।

এইরকম অবস্থায় অভয়পদরই বাল্যবন্ধু হাসপাতালের কম্পাউডারকাকু বিজন ঘোষাল (ওদের একমাত্র হাউজ ফিজিশিয়ানও বটে) লাশবাবুর চাকরিটা জুটিয়ে দিতে সংসারটা কোনোক্রমে বাঁচলো! বাড়ির পশ্চিমে একটা বাঁশঝাড় বানিয়েছিলেন তারাপদ'র ঠাকুর্দা। সময় অসময়ে দু'চার খানা বাঁশ বেচে চালটা-নুনটা হয়ে যেতো! সেই বাঁশঝাড়টা এখনো আছে। ওটা বাদ দিয়ে বাকি জায়গাটা নিত্যদিনের শাক-সব্জি, দু'চার রকমের ফুলের গাছ, তুলসি গাছ দিয়ে ছবির মতো সাজিয়েছিল মা। এখন সে সবের কিছুই নেই। চারদিকে হতশ্রী ভাব।

পুরনো দিনের এইসব কথা প্রতিদিনই মনে পড়ে তারাপদ'র। নদীর ধারে উঁচু ঢিপির ওপর বসে বসে এইসব কথা ভাবে আর তার কর্মচারীদের কাজকর্ম লক্ষ্য করে। বাড়িতে সিগ্রট টানলেও এখানে বিড়িই তার বেশি পছন্দের নেশা। মাঝেমধ্যে গেলাসের নেশাও যে করে না তা নয়, তবে মন মেজাজ তেতে থাকলেই ঠেকে গিয়ে গেলাস নিয়ে বসে পড়ে। ইদানীং অবশ্য মাঝে মাঝেই মন মেজাজ তেতে থাকে।

গুপ্ গাপ্ কোদাল চালিয়ে চারজন লেবার বালির মধ্যে কম করে সাতফুট গর্ত খুঁড়ে চলেছে । একটু দূরেই চারটে মাল প্লাস্টিকে জড়ানো পাশাপাশি পড়ে আছে। চারটের সাইজ প্রায় একই। চোখের সামনে হাতের কব্জিটা তুলে ফস্ ফস্ করে বিড়িতে বেশ জোরে টান দিল তারাপদ। লালচে আলোয় ঘড়ি দেখলো।

দশটা বাজে। এখনো ঘন্টা দুই লেগে যাবে কাজ মিটতে। সামান্য বাতাসেও পচাগন্ধ মিশে যাচ্ছে। এই গন্ধ অবশ্য এখন তারাপদ'র খারাপ লাগে না। অভ্যাস হতে হতে তার অস্তিত্বের সঙ্গেই যেন মিশে গেছে।

মাইলটাক দূরের জনপদ থেকে মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে। কার্তিকের রাত দশটায় শহর ঘেঁষা গ্রামও নিঝুম হয়ে যায়। সিকি মাইল তফাতেই শ্মশান। এ দিগড়ের সকলেই তারাপদকে চেনে। সবাই জানে তারাপদ লাশের ব্যবসা করে।

কঙ্কালের ব্যাপারী বলে কেউ কেউ জানে। সবাই জানে না। কে কার বিশদ বিরণ রাখে এখন! নিজের বিত্তান্ত নিয়েই মানুষ পাগল। পুরনো দিনের কথা মনে হতেই খুব বেশি করে মায়ের কথাই মনে পড়ে তারাপদ'র। মায়ের কোলের কাছে গুটিসুটি বসার সেই অপার শান্তি আর কোনোভাবেই তারাপদ'র জীবনে ফিরে এলো না! জোর করেই মা বিয়ে দিল রাণীর সঙ্গে।

খুবই গরিবের মেয়ে। কিন্তু রূপের জন্যেই মা-বাপ নাম রেখেছিল রাণী। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেও। হাসপাতালের সামান্য চাকরি--তবু সরকারি চাকরি তো বটে। কাজকর্ম দেখাতে পারলে কিছু তো উন্নতি হবে।

মা-বাপ হাতে স্বর্গ পেলেও রাণীর কিন্তু মন ওঠেনি। বিয়ের আগেই সে শুনেছিল তার বর লাশঘরে কাজ করে। ভাবতেই তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.