আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৭আনা বইমেলা রঙ্গ - সাড়ে৭আনা মোহভঙ্গ= ৭.১৪%ক্ষতি (বইমেলা-পাটিগণিত)

আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..

গেল মাসে ভোলাভালা বালকখানির ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল_ “ফেসবুককে প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠে, avoid করলে ‘ছায়াসঙ্গী হয়; ফেসবুকের সঙ্গে বানরের প্রকৃতিগত অন্তমিল আছে; ফালতু একটা site’ পক্ষান্তরে, বিগত সপ্তাহ হতে তাহার স্ট্যাটাসখানি হইয়াছে_ “ বইমেলায় যাওয়ার লোক পাচ্ছিনা সঙ্গে। এতগুলো বই হাতে নিয়ে একা হাটতে খুব বিরক্ত লাগে। সণ্ন্যাসব্রত গ্রহণের জন্য জীবনের যে অল্পকিছু সময় অনুতপ্ত হই, বইমেলা তার সর্বাগ্রে”। এইরূপ মানসিক অবস্থা লইয়াই দফায় দফায় বইমেলা প্রাঙ্গনে আনাগোনা জমাইয়া অনাথের ন্যায় স্টলে-স্টলে হাত পাতিবার ছলে গণ্ডায় গণ্ডায় বই সংগ্রহ করিয়াছি, আর কম্মখানি সম্পণ্নপূর্বক hall এ প্রত্যাবর্তন করিয়া নিদারুণ মনোপীড়ায় ভুগিয়াছি। ইতিমধ্যে ভ্রমণসংখ্যা ৫এ উন্নীত হইলেও গতকল্যেরটি ছিল ভিন্নরকম।

আতএব, ইহা লইয়াই কথা চলিবেক। সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্যক্রমে গতকাল স্কুলজীবনের কতিপয় বান্ধবকে পাইয়া যাই ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে, যদিও এই প্রাপ্তিহেতু কিঞ্চিৎ বিড়ম্বনা ঘটিয়াছিল বৈকি, কেননা আসিবামাত্র উহাদের ভুরিভোজন নিমিত্তে আমার ৯২টি নির্দোষ টাকা শাহাদাত বরণ করিয়াছে। এরপরে আমরা রওয়ানা করিলাম। প্রতিবারই মেলার সদর দরজাসহ চারিধারের রাস্তায় লিফলেট বিতরণের আধিক্যে নাখোশ হই_ আরে, লেখকেরা নির্বাচনে দাঁড়াইয়াছে নাকি, এই লিফলেট বিতরণের আবশ্যকতা কি!তথাপি, এইবার কী খেয়াল চাপিল, লিফলেটগুলি সযতনে ব্যাগে পুরিতে থাকিলাম,এবং মেলায় প্রবেশের প্রাক্কালেই ব্যাগখানি ওজনে আমার এক দশমাংশ হইযা গেল। ইহাতে নিরাপত্তা রক্ষীদের নেক নজরে(?) পড়িতে বিলম্ব ঘটিল না; ফলাফল_ ব্যাগজুড়িয়া পুলিশী নিপুণতায়(!) তল্লাশি আর দিস্তায় দিস্তায় লিফলেট পাইয়া আমায় আন্তরিক তিরস্কার।

মেলায় কিছুদূর হাটিয়াই আমার বান্ধবদলের দৃষ্টি একখানি লালকেল্লার দিকে নিবদ্ধ হইল; কেল্লার চারপাশ লোকে-লোকারণ্য, বুঝিতে হিমশিম খাইতেছিলাম ব্যাপারখানি। কেল্লা হইতে তবারক হিসেবে বিনামূল্যে বই বিতরণ হইতেছে বোধহয়। সেই ভীড়ে পিস্ট হইয়া কোনক্রমে কাছাকাছি গিয়া বুঝিলাম আপাত কেল্লা মনে হওয়া এই স্টলখানি “আন্যপ্রকাশের দখলে’, এখান হইতেই সাহিত্যের এক দিকপালের বই পাওয়া যাইতেছে আশীর্বাদরূপে। আশীর্বাদবঞ্চিত অথর্ব ঘোড়ার ন্যায় বিরসবদনে পুনরায় হাটিতে আরম্ভ করিলাম। (অনুদান-ক্ষুদ্রঋণের) সৌজন্যে পকেট মমতা কুলকার্নীর মত পৃথুলা হওয়ায় এইবার পছন্দের বইয়ের অণ্বেষণে মন দিলাম, আর ইহাতেই ঘটিল বিপত্তি : বইয়ের নেশায় বুঁদ হইতে গিয়া আবিষ্কার করিলাম দলছুট হইয়াছি।

চাইলেই উহাদের খুজিয়া পাওয়া যায়, কিন্তু ভাবিলাম আরও কিছু বই যোগাড় হইবার পরে সেদিকে নজর দেয়া যাইবে। হাটিতে হাটিতে অদ্ভুত এক স্টলের সম্মুখে হাজির হইলাম যেখানকার প্রতিটি ব্যক্তির পরনে হলুদ ফতুয়া (অবশ্য হুমায়ুনীয় রসিকতা বা ফাইজলামি অনুসারে ইহাকে “গু” কালার বলা সঙ্গত ছিল)। কিছুতেই বুঝিলাম না, এই “গু’ কালারের ফতুয়া পরিবার মাহাত্ম কী হইতে পারে। জগতে সব বুঝিবার দায়ও আমায় কেউ উইল করেনাই, সুতরাং পুনরায় আপন কর্মে প্রবৃত্ত হইলাম। এইবার আসিলাম অন্য এক স্টলে, এস্থানে সাহিত্যের আরেক দিখফাল (!) ই,হক মিলন উপবিষ্ট, তাহার পার্শ্বের রমণীটির দিকে চোখ পরিবামাত্র দৃষ্টি স্থির হইয়া রহিল কিয়ৎকাল।

সম্বিৎ ফিরিবার পর দেখিলাম জনৈক পাঠকের প্রশ্নবাণে লেখকসাহেব জর্জরিত, আর সেই প্রিয়দর্শিনী অবিরল স্মিত হাসিতেছে। মন চাইছিল সময়কে ধমক মারিয়া সেই হাসির দর্শক হইয়া থাকি, কিন্তু ব্যাগের ভেতর হইতে একখানি তরুণ বই প্রলাপ বকিল- “বৎস হিমালয, শয়তানের কোড ৬৬৬, তোমারটা৭৭৭, সুতরাং শয়তান হইতেও তুমি ভয়ানক, হাসিতে ভুলিলে শয়তান বিজয়ী হইবে। তার চেয়ে চল, আমার কিছু সঙ্গী খুজি”। বইয়ের আজ্ঞাকে স্কন্ধধার্য করিয়া পা চালাইলাম দ্রুতগতিতে। এইবার আসিলাম বটতলায যেস্থলে ফটোসেশন চলিতেছে লেখকদের।

তাহাদের ভড়ং-ধরনকে চিত্রতারকাদের মত ঠেকিতেছিল, শুরুতে তাহাদের প্রতি করুণা , পরবর্তীতে আফসোস হইল খানিকটা। হা ইশ্বর, মাত্র ১০-১৫ হাজার জামানত থাকিলে আজ আমিও গরুর রশি ধরিবার মত করিয়া বই ধরিয়া হাস্যোজ্জ্বল ফটো তুলিতে পারিতাম! অর্থের অনর্থ কিংবা শব্দার্থ এইবার অনুধাবন করিলাম। ইহার পর আসিলাম মেলার "আনন্দ আলো" স্টলে। এইখানেও জটলা_ লোকপ্রিয় অভিনেতা-নির্মাতা আফজাল হোসেন আসিয়াছেন, তাহার সাক্ষাৎকার গ্রহণ চলিতেছে। আমার জননী মাধ্যমিক স্কুলে পড়িবার কালের নায়ক আফজাল, অদ্য আমার নিজের নায়ক হইবার বয়স হইয়া গেছে, অথচ “মামা” এখনো নায়কই হইয়াই বহাল তবিয়তে আছেন; সুবর্ণা-শম্পা রেজাকে পার করিয়া হাল আমলের মোনালিসা-অপিও তাহার নাযিকা, কারণ “মামা”কে দেখিলে এখনো ২৫-২৬ বছরের যুবক বলিযাই ভ্রম হয়, নির্মাতাদের বিষোদগার তাই অনর্থক।

“মামা’কে দূর হইতে স্যালুট জানাইয়া আগাইতে উদ্যত হইতেই নটরডেমের এক বান্ধবের সহিত টোক্কর খাইলাম যেন, সঙ্গে তাহার ‘বিশেষ বান্ধবী’। কিছু বুঝিয়া উঠিবার আগেই সেই ‘বিশেষ বান্ধবী’ আমায় সালাম ঠুকিয়া বসিল, আমি অবাক হইলাম বইকি_ সমবয়সী কারো সহিত প্রথম পরিচয়ে সালাম দেওয়ার রীতিটা ঠিক ধাতস্থ হইলনা। যাহা হউক, উহাদের বিদায় দিতে বাধ্য হইলাম দলছুট বান্ধবদের কল পাইয়া; উহারা মঞ্চের সম্মুখে সমবেত হইয়াছে। সেখানে গিয়া কৌতুক অনুভব করিলাম। মঞ্চে বক্তার সংখ্যা উপস্থিত শ্রোতার তুলনায় বহুলাংশে বেশি, তবুও বক্তারা সাহিত্য উদ্ধার করিয়া যাইতেছেন, যাহার মর্মার্থ তাহারা নিজেরাও উপলব্ধি করিতেছেন বলিয়া মালুম হইল না,।

"বলিতে হয তাই বলা" ; “ইন্টেলেকচুয়াল” হইবার কারণে ‘বলাটা’ তাহাদের গ্রীন পাসপোর্ট পাইবার মত জাতিয় অধিকার হইয়া উঠিতেছে ক্রমাণ্বয়ে। ওখানে সমযক্ষেপণ করিয়া অসুস্থ বোধ হইতে থাকিল, তাই পুনরায় একত্রিত হইয়া মেলায় হাটিতে শুরু করিলাম। অদূরে দেখিলাম স্যাটেলাইট চ্যানেলের জন্য এক তরুণীর মেলাবিষযক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ চলিতেছে, যদিও তরুণীটিকে ‘ময়না পাখি’ বলিতে সাধ হইতেছে, কেননা সে কী বলিবে তাহা চ্যানেলের সাংবাদিক ক্যামেরার পিছন হইতে তাহাকে বলিয়া যাইতেছে যাত্রার প্রপেটরের মতো করিয়া_ আহ!মেলায় আসিয়া সারাদিনের অবসণ্নতা দূরীভূত হইয়া যাইতেছে এইসব গোপাল ভাড়ীয় ভাড়ামি প্রত্যক্ষ করিয়া। পাশ দিয়াই এক খোলাচুলের ক্লিওপেট্রা হাটিয়া যাইতেছিল কুচ্ছিতদর্শন(!) এক যুবকের সহিত, আমার বান্ধবদল ইহা মানিয়া নিতে ব্যর্থ হইয়া নীরবে ক্লিওপেট্রাকে অনুসরণ করিয়া পিছন পিছন হাটা ধরিল। আমি ভালোমানুষি মুখোশ পরিবার দরুন তাহাদের সঙ্গী না হইলেও ক্লিওপেট্রার জন্য দুর্দমনীয় আকর্ষণ অনুভব করিতে থাকিলাম, হৃৎপিণ্ডের অলিন্দ-নিলয়ে রক্তপ্রবাহ বেগবান হইল।

অবশেষে, একপ্রকার মনস্তাপ লইয়াই হাজির হইলাম ১৯২নং স্টলে, সেখানে ব্লগার অরণ্য আনাম-চটপটির সহিত পরিচয় ঘটিল, দু-এক কথায আলাপনের সমাপ্তি টানিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ফরমে স্বাক্ষর করিয়া বিদায নিলাম। জাগৃতি প্রকাশনে ঢু’ মারিলাম, কিন্তু সাজি’পুর দর্শনলাভ হইলনা। বিকাল গড়াইয়া সন্ধ্যা হামাগুড়ি দিতে আরম্ভ করিয়া দিল, দেখিলাম সাড়ে ৬টা বাজিয়া গিয়াছে। আরও দু’ একখানি বই জোগাড় হইল। অতর্কিতে খেয়াল চাপিল প্রতিকৃতি আকাইবার।

আগাইয়া গেলাম কিছুদূর, চিত্রকরের দেখা মিলিল। মানিব্যাগ হাতড়িয়ে আমার দুইহস্তে দুইকাপে চা পানের ছবিখানি বাহির করিয়া তাহাকে দিলাম প্রতিকৃতি অংকনের নিমিত্তে। চিত্রকর মেধাবী মানুষ _ স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুতগতিতে অংকন সম্পণ্ন করিল, অত:পর সম্মানী গ্রহণের সময় সরল হাস্যে কহিল_ ‘আংকেল, আপনার ছেলের চা খাওয়াটা খুবই অদ্ভুত। এর আগে দেখিনি। তাই, আপনার জন্য ৩০টাকা ছাড়”।

এই বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার পরমাণুতে রূপান্তরের দশা হইল বিবমিষায়; এইবার বুঝিলাম কলেজের ঐ বন্ধুর বান্ধবীটির আমায় সালাম দেবার হেতু! আমি ভদ্রতার অবতার হইয়া কহিলাম_ আজ্ঞে ভ্রাতা, বয়সে আমি আপনার ছোটই হইব; অত্যধিক চা’ পান আর খুশকির প্রভাবে মাত্র ২২এই মস্তকে চুলের ভয়াবহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় আমায় ৪৭ বলিয়া ভ্রম হয়। ছবির এই অবোধ বালকখানা আমি স্বয়ং!" চিত্তকরের বিস্ফোরিত চেহারাকে অগ্রাহ্য করিয়া হন হন করিয়া হলের দিকে হাটা ধরিলাম। ক্রোধের আতিশয্যে বান্ধবদের দিকে নজর দেবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না, এমনকি রিক্সা ডাকিতেও প্রবৃত্ত হইলনা। ব্যাগভর্তি বই লইয়া হাটিতেছি তো হাটিতেছিই। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা।

একনাগাড়ে হাটিয়া চলিতেছিলাম ফুলার রোড ধরিয়া। আচমকা এক পাঞ্জাবী পরিহিত বয়:বৃদ্ধের আহ্বানে থামিলাম। কাছাকাছি আসিয়া তিনি খুবই মোলায়েম স্বরে কহিলেন_ বাছা, সেই বইমেলা হইতে তোমায় অনুসরণ করিতেছি। অনেক বই তো কিনিলা। একটু বাহির করিবা, আমার একটা প্রয়োজন আছিল!"- মেজাজ তিরিক্ষি হইলেও বৃদ্ধের সৌজন্যে ব্যাগ খুলিয়া তাহাকে দেখাইলাম।

তিনি সেগুলি উল্টাইয়া দেখিয়া কাগজে দাম লিখিতে থাকিলেন। সমুদয় বইয়ের দাম লিখা সমাপ্ত হইলে ক্যালকুলেটর বাহির করিয়া হিসাব কষিয়া আমার হস্তে ২০০০টাকা গুজিয়া দিয়া কহিলেন, “ বাছা, মোট ৪৭০০ টাকার বই খরিদ করিয়াছো, তাহার ৪০% করিলে ১৮৮০ টাকা হয়, তোমায কিঞ্চিৎ বেশি প্রদান করিলাম; এইবার আপন রাস্তা দেখ”। আমি প্রতিবাদ করিতে যাইবার আগেই আমার পিছনে ৩জন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করিলাম যাহাদের দেখিয়া রেসলার ‘দ্য বিগশো’র” কথা মনে পড়িল! কী আর করা, এই অলাভজনক চুক্তি মানিয়া লইয়াই বইয়ের মালিকানা ত্যাগ করিয়া হলে ফিরিবার ইন্তেজাম করিলাম। তাহার প্রাক্কালে বৃদ্ধকে বলিলাম, “ আংকেল, এইধরনের আইডিয়া ইহার প্রাক্কালে কেউ দিয়াছিলো কিনা জানিনা, তবে আমার ব্যাপক মনে ধরিয়াছে। মানুষ অর্থ ছিনতাই করে, আর আপনি বই করিলেন! আপনাকে সালাম”।

গতরাত হইতে আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস_ “ বইসংগ্রহের অভিনব উপায়ের সন্ধান পেযেছি আজ। সেজন্য সুঠাম দেহের বলিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন। আগ্রহীরা অতিসত্ত্বর যোগাযোগ করুন। .........................................সত্য, ধ্রুবসত্য, এবং আংশিক সত্য ককনই সমাথৃক নয়। এই লেখার ঘটনাগুলোকে আংশিক সত্য হিসেবে বিবেচনা করলেই লেখার সার্থকতা।

.............

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।