আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অশ্লীল সাহিত্য থেকে নীলছবি: পর্নোগ্রাফির বিবর্তন, পর্ব ১

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম, বিশেষত ইন্টারনেটের কারণে, পর্নোগ্রাফি সবচেয়ে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। পর্নোগ্রাফি এখন আর 'অপরাধী-মনোভাবে-দেখা/পড়া ব্যক্তির বা বন্ধুগোষ্ঠীর গোপন অথচ উত্তেজিত; অভিযানের বিষয় নয়। বরং ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা, বা সিডি-ডিভিডি আকারে পর্নোগ্রাফি সংগ্রহ করা এতটা সহজ হয়ে গিয়েছে যে, তা সমাজে এখন গোপন অথচ বহুদৃষ্ট প্রপঞ্চে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেটে এখন এমনকি ইন্টারঅ্যাক্টিভ পর্নেরও দেখা মেলে। একসময় পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে দেখা বা পাড়ার ভিডিও ক্লাব থেকে ভাড়া করার কারণে সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টির বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল।

কিন্তু এখন তা চারদেয়ালের গৃহে নিরাপদে ও অনায়াসে উপভোগ করা যায়। তাই পর্নোগ্রাফিকে বোঝা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ব্যক্তিক-সামাজিক প্রভাব ও নৈতিক বিপর্যয়ের দিকটি যেমন বোঝার দরকার আছে, পাশাপাশি একটি 'মতাদর্শিক যন্ত্র' হিসেবে পর্নোগ্রাফি কী বার্তা বহন করে, তা উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আজ যেমন আমরা চলচ্চিত্রকেই ব্যাপক অর্থে পর্নোগ্রাফিক মাধ্যম হিসেবে মনে করছি, এর অস্তিত্ব পেইন্টিং, আলোকচিত্র ও বিশেষত সাহিত্যে অনেক আগেই দেখা গিয়েছে। এই প্রবন্ধে সাহিত্যের বিশেষত পশ্চিম সাহিত্যের অশ্লীলতা ও চলচ্চিত্রের পর্নোগ্রাফির ইতিহাস, বিবর্তন এবং এর লক্ষ্য বা শিকার কে বা কারা তা বিচারের পাশাপাশি বিশেষভাবে আলোকপাত করা হবে এসবের জেন্ডারপ্রসঙ্গের দিকে।

আন্দ্রিয়া দোরকিন (দোরকিন, ২০০৩: ৩৮৭) বলছেন, 'পর্নোগ্রাফি' (pornography) শব্দটি এসেছে গ্রিক 'পর্ন' (porne) ও 'গ্রাফোস' (graphos) শব্দদ্বয় থেকে যার অর্থ 'বেশ্যাদের (whores) নিয়ে লেখালেখি'। পর্ন অর্থ বেশ্যা, বিশেষত অতি নিচু স্তরের বেশ্যা, যাদের প্রাচীন গ্রিসের বেশ্যালয়গুলোতে পাওয়া যেত এবং সব পুরুষ নাগরিকের জন্য সহজপ্রাপ্য ছিল। সুজান হেওয়ার্ড-এর মতে, [চলচ্চিত্রে] পর্নোগ্রাফি হলো একপ্রস্থ ইমেজসারি যা যৌনকামনা চাগিয়ে তোলার জন্য হাজির করা হয় এবং যাতে নগ্নতা ও যৌনকর্ম সরাসরি চিত্রায়িত হয় (হেওয়ার্ড, ২০০৬: ২৮৯)। পর্নোগ্রাফির অস্তিত্ব অনেক আগে থেকে পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকলেও, কেবলমাত্র ভিক্টোরীয় যুগে একে ঘিরে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়, বিশেষত একে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশে। ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়া পৃথিবীব্যাপী শাসন করেন ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত যেসময়ে প্রধানত ভারতশোষণের মাধ্যমে ব্রিটেনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রশাসন এক ধরনের সংস্কারাভিযান চালায়।

ধীরে ধীরে তৈরী হয় ভিক্টোরীয় নৈতিকতা, যার রেশ ধরেই পর্নোগ্রাফিকে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা শাসকদের মাথায় আসে। পর্নোগ্রাফি, ইংরেজি শব্দ ইরোটিকা বলতে যা বোঝায়, তা থেকে আলাদা। ইরোটিকার উদ্দেশ্য হতে পারে, যৌনতার মতো স্বাভাবিক ও মৌলিক বিষয় নিয়ে, ও তাকে ঘিরে মানবিক সম্পর্কের ঘটনাবলীকে অবলম্বন করে কোনো পেইন্টিং বা চলচ্চিত্র বা সাহিত্যকর্ম নির্মাণ। কিন্তু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্য দর্শক-পাঠকের যৌনকামনাকে জাগ্রত করা। সাহিত্য, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র উভয়ক্ষেত্রেই পর্নোগ্রাফির প্রয়োগ দেখা যায়।

পর্নোগ্রাফিনির্ভর অনেক পত্র-পত্রিকায় যেমন স্থিরচিত্র প্রকাশিত হয়, তেমনি সেলুলয়েড বা ভিডিও ফরম্যাটে অনেক পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়ে থাকে, যার বিপণন ইন্টারনেট কিংবা সিডি-ডিভিডির মাধ্যমে বিস্তৃত হতে পারে। সত্যি বলতে, পর্নোগ্রাফি একটি বিরাট শিল্প এবং বিলিয়ন ডলার এখানে বিনিয়োগ হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতেই এই শিল্পের প্রসার সবচেয়ে বেশি, তবে এর গ্রাহক বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান। তবে পশ্চিমা দেশসমূহে পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্র গ্রেডিং পদ্ধতিতে আইনের আওতায় প্রকাশ্যে পরিবেশিত হয়ে থাকে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে পর্নোগ্রাফির নির্মাণ ও পরিবেশনা গোপনে পরিচালিত হয়, তবে এর উৎপাদন খুব সীমিত।

জনপ্রিয়ধারার চলচ্চিত্রে নব্বই দশকের শেষ থেকে ও শূন্য দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘কাটপিস’ আকারে পর্নোগ্রাফির এক ধরনের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন ভারতে সচিত্র কামসূত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা একধরনের সেক্স-ম্যানুয়েল বলে বিবেচিত। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে বিস্তৃতরূপে লিবিডো বা কামভাবনানির্ভর কবিতা রচিত হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায় ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর মতো কামকাব্য। আধুনিক সময়ের বাংলা সাহিত্যেও কামনির্ভর কাব্য-উপন্যাস-গল্প রচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

তবে সািহত্য ও চলচ্চিত্রে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে পশ্চিমা দেশসমূহে। ঐসব দেশে পর্নোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণও হয়েছে বিশদভাবে এবং ঐসব বিশ্লেষণকে আশ্রয় করেই এই প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে পর্নোগ্রাফিক বা অশ্লীল সাহিত্যের প্রেক্ষাপটটা বিশ্লেষণ করা হবে পশ্চিমা রেনেসাঁ-পরবর্তী সাহিত্য অবলম্বনে এবং চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণটি হবে আধুনিক সময়কে ধরে। অবশ্য মাধ্যম হিসেবেও সাহিত্য প্রাচীন এবং চলচ্চিত্রের বয়স এক শতকের একটু বেশি মাত্র। চলচ্চিত্রের আগমণে পর্নোগ্রাফি বিষয়টা চলচ্চিত্রের একলার অধিকারে চলে গেছে যেন।

পুরনো ইউরোপীয় সাহিত্য বিচার করলে দেখা যাবে সেখানে পর্নোগ্রাফি এসেছে একধরনের প্রতিরোধের জায়গা থেকে -- বিশেষত রাজতন্ত্র ও চার্চকে আঘাত করার জন্য সাহিত্যে যৌনতার মতো বিষয়কে বেছে নেয়া হয়েছে। পুরুষপ্রাধান্যের সেসব সাহিত্যে অবশ্যই নারীর অবমাননা হয়েছে, কিন্তু এসব সাহিত্যের রাজনৈতিক দিকটিকে উপেক্ষা না করে আমলযোগ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। আর কারও কারও 'অশ্লীল' সাহিত্য দার্শনিক একটি পর্যায়েও উপনীত হয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় নিরেট পর্নোগ্রাফি, নারী-পুরুষের যৌনকর্মের সরাসরি চিত্রায়ণ। নারী-পুরুষের যৌনতানির্ভর সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের জটিলতাকে ঘিরে মনোদৈহিক একটি ন্যারেটিভ এসব ছবিতে পাওয়া যায়না।

পর্নোগ্রাফি হলো মূলধারার বা বিকল্পধারার বাইরে চলচ্চিত্রের একটি পৃথক জঁরা (genre)। ফলে পুরুষদর্শকদের জন্য নির্মিত এবং পুরুষ প্রযোজক-পরিচালক দ্বারা সৃষ্ট এসব চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান চরমভাবে অবমূল্যায়িত হয়। পর্নোগ্রাফির কাঁচামালই হলো নারী ও তার শরীর, যা পুরুষের যৌনকামনা জাগ্রত করার জন্য ও পুরুষপ্রযোজকদের মুনাফার জন্য ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি এই দুই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে গিয়ে কীভাবে নারী পুরুষের আধিপত্য-পীড়ন-অধস্তনতার শিকার হচ্ছে, পর্নোগ্রাফির সেই মতাদর্শিক নির্মাণের দিকটিকে এই প্রবন্ধে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীবাদী তাত্ত্বিকেরাই পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে, বিশেষত সেখানে নারীর অধস্তন রূপায়ণের বিরুদ্ধে, উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন।

ভ্যালেরি মাইনার-এর মতে, 'পর্নোগ্রাফি যতটা না যৌনতার প্রকাশ তার চাইতে বেশি করে [পুরুষের] ক্ষমতার চর্চা' (স্টার্ন উদ্ধৃত, ১৯৯২: ১৯৯)। চলবে ... প্রথম প্রকাশ: রবিউল করিম সম্পাদিত ছোটকাগজ 'ব্যাস'-৮, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.