আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শকুমেন্টারি শকোথেরাপি এবং কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসি - মনজুরুল হক



[ মনজু ভাইয়ের এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিতব্য বইটি থেকে ] শকুমেন্টারি শকোথেরাপি এবং কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসি -------------------------------------------------------------------------------- বাঙালি বলে আত্মপরিচিত হওয়ার জন্মগত অধিকারটুকুও হারিয়েছে বাঙালি। যখনই সে কর্পোরেট ব্যাপারিদের ভেতর লীন হয়েছে তখনই তার বাঙালিত্ব উপহাসে রূপান্তর ঘটেছে। যখনই শিক্ষিত বাঙালি ফুটবলকে ব্যঙ্গ করে 'চর্মনির্মিত গোলাকার বস্তুবিশেষ যা পদাঘাতে স্থানান্তরিত হয়' শব্দ আবিষ্কার করেছে তখনই সে বাংলাকে ‘হত্যা’ করে কলাপাতায় বিশ্বমাতার বেদিতে ভেট দিয়েছে। সেন যুগ, পাল যুগ, মোঘল যুগ এমনকি পাকিস্তান যুগের পয়লা বৈশাখের হালখাতা বা তার আগের রাত্তিরেতে চৈত্রসংক্রান্তি, মিষ্টি-মণ্ডা, বাতাসা, ঘুড়ি-নাটাই আর মাটির পুতুলের মেলা, পাতার বাঁশি, দশ টাকা শোধ করে নতুন খাতা খুলে ১৪ টাকার মিষ্টিলুচি খেয়ে ঢেকুর তোলা বাবুদের ধূতির কোঁচা এখন ফিনফিনে ঘিয়ে পাঞ্জাবি আর লালপেড়ে ঘিয়ে বা সাদা শাড়িতে টারমিনেটেড হয়ে বর্ষবরণে ঠেকেছে। লেক্সাস, প্রাডো, বিএমডব্লিউ থেকে নেমে বটমূলে পান্তা খাওয়া আর চারুকলার আদেখলেদের সঙমিছিলের ছবি হ্যান্ডিক্যামে তোলাতে ঠেকেছে।

ঠেকবে না-ই বা কেন? বাঙালি তখন তো নয়-ই এখনো ঠাওর করতে পারেনি কবে কীভাবে তার পয়লা বৈশাখ কর্পোরেট ব্যাপারিদের বাইপ্রডাক্ট তথা কথিত মুক্তমনের গণতন্ত্রে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। যে জাতির শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ শুদ্ধ বাংলায় কথা কইতে জানে না, যে জাতির জাতিসত্ত্বা পর্তুগিজ, মগ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, আরব, মোঘল, পাঞ্জাবি আর আরাকানি দ্বারা ধর্ষিত হতে হতে মৌলিকত্ব হারিয়েছে তার কাছে বাংলা নববর্ষ কী তাৎপর্য বহন করে? বাংলার ভেতর অবাভবোধ নেই বাংলা সহজিয়া, তাই সহনিয়া। আর সে কারণেই ইংরেজি দিয়ে বাঙালকে মডার্ন বানানো হয়েছে। সে যত মডার্ন হয়েছে তত তার অভাব বোধ বেড়েছে, অ্যাফলুয়েন্ট সমাজ সর্বদাই অভাব বোধকে নবায়ন করে, নতুন নতুন মাত্রার অভাববোধ জাগরুক করে। আমাদের এখনকার আদেখলেপনা ভরা বর্ষবরণ সেই অভাব বোধ থেকে সৃষ্ট।

অ্যাফলুয়েন্ট বা প্রতুল সমাজে ক্রমাগত অভাব সৃষ্টি হতে থাকে অভাব পূরণের মধ্য দিয়ে এবং কথাটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন গলব্রেথ, আমেরিকান খাদকসমাজের আচরণ লক্ষ্য করে। শিল্পসমাজ যত প্রাচুর্যের পথে এগিয়ে যায় বিজ্ঞান ও টেকনোলজির সাহায্যে তত অভাব বৃদ্ধিও হতে থাকে চাহিদাও বাড়তে থাকে, সেই অভাব পূরণের কৌশল ও পদ্ধতির ভেতর দিয়ে এবং সেই কৌশল হলো বিজ্ঞাপন ও বিক্রয়কলা। উৎপাদকরা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাহিদার বাজার ক্রমাগত চষতে থাকেন এবং নানা কৌশলে প্রলোভনের বীজ ছড়ান, যাতে ভালো ফসল ফলে অর্থাৎ নতুন একটা অভাব বোধ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে। ধনবাদী শিল্পসমাজের এই বিশিষ্ট গড়নকে গলব্রেথ বলেছেন টেকনোস্ট্রাকচার, যেখানে সর্বপ্রকারের প্রতিভাকুশলতা কৃতিত্ব বিশেষজ্ঞানবিদ্যা এবং অভিজ্ঞতার অধিকারীদের সমাবেশ হয় ম্যানেজার গোষ্ঠীর নীতিনির্ধারণের উদ্দেশ্যে। কারণ ব্যক্তিগত ধনতন্ত্রের কাল অর্থাৎ সেই দস্যুবেরনদের কাল শেষ হয়ে গিয়েছে ম্যানেজেরিয়াল বিপ্লবের ফলে।

আর এই টেকনোস্ট্রাকচারোদ্ভুত খাদকসমাজের ডিজনিল্যান্ডে যারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট হয়েছে এবং ক্রমাগত হচ্ছে। এই যে উল্কার বেগে আকৃষ্ট হওয়া একে অনেকে উল্লম্ফন বলছেন। বিপ্লব বলছেন। সমাজের অগ্রসরমানতা বলছেন। ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যক্তির ভোগবাসনা বিক্ষিপ্তভাবে সঞ্চার হওয়ায় প্রয়োজন হচ্ছে সন্নিবশিত করা, এককেন্দ্রিক করা, আর তখনই সংগঠনের অভাব বোধ দেখা দিচ্ছে।

সংগঠন গড়ে ওঠার পর তাকে আরো এককেন্দ্রিক করার জন্য রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার সাধনের অভাব বোধ দেখা দিচ্ছে। একটা আধা সামন্ত মানসিকতার আধা ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। চাষার ছেলের হাতে সেলফোন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য শ্রেণী বিভাজনকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিথিল করতে হচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্যের ফলে এক ধরনের অভাব বোধের বিলুপ্তি ঘটলে অন্য ধরনের অভাব বোধ তৈরি করা হচ্ছে। সমাজ জীবনের অভাব বোধ মেটানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রক্ষেত্রের অভাব বোধ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে।

পণ্যকে সহজগম্য করার জন্য এক ধরনের অ্যাকুমুলেশন অথবা গণতন্ত্রায়নের আবশ্যকতা প্রকট হয়ে উঠছে। আর সেই গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র এবং সমাজ জীবনে কম্পাইল করার জন্য সমাজের বড়ো বড়ো মাথাদের ইনস্ট্যান্ট অভাব বোধ মিটিয়ে তাদের কিনে ফেলা হচ্ছে। অকুপাইড করে নেওয়া হচ্ছে সেই ম্যানেজেরিয়াল প্রশাসনের অধীনে। সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে বলেন, কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসি। রাষ্ট্র এবং সমাজের কোনো কিছুই এই কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসির বাইরে নয়।

সমাজের বিকাশ, মানুষের ক্রিয়েটিভিটি, শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি এবং ধর্মাধর্মী সবই কর্পোরেট সিস্টেমের অধীনে। এর বাইরে যা কিছু তা মনো, ডিজিটাল নয়, অ্যাম্পলিফাই নয়। কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসিতে সব কিছুই বিপণনযোগ্য, ক্রয়যোগ্য, ইন্সটলেশন, ইরেকশন, মর্ডানাইজেশন, ফর্মুলেশন যোগ্য। যা কিছু এর ভেতর পড়ে না তা সেকেলে। রিজেকটেড।

বহুজাতিক কর্পোরেশন হাউসগুলো প্রথমেই কিনেছে গণতন্ত্র। কেনা গণতন্ত্র যখন বিক্রয়পণ্য হয়েছে তখনই সে তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। তাকে শুধুই গণতন্ত্র বললে আর চলছিল না। বিপণনের জন্য নিজেকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পটে বসে মূল্যমানের যথার্থতা প্রমাণ করতে হয়েছে। আধা সামন্ত মানসিকতার গণতন্ত্র যখন বিক্রয়-পরবর্তী কর্পোরেট গণতন্ত্র হয়েছে তখন তার অধীনের সব কিছুর প্রাধান্যে রূপান্তর ঘটে গেছে।

এর পর তারা কিনেছে অভাব বোধ। নিত্যনতুন অভাব বোধ ছাড়া বহুবিধ পণ্যের সঞ্চালন হয় না, তাই নিত্যনতুন অভাব বোধ জাগরুক করার জন্য মেট্রোপলিস আরবানাইজড গোষ্ঠীকে বহুমূল্যে ক্রয় করে সেই ম্যানেজেরিয়াল কর্পোরেশনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরা বহুমূল্যে বিক্রয়লব্ধ জ্ঞানভাণ্ডার আরো শাণিত আরো নিখুঁত করার জন্য নিত্যনতুন কলা আবিস্কার করেছে, যেটাকে আমরা শিল্প-সাহিত্য বলছি। এই মানুষগুলো শিল্প-সাহিত্য সেক্টরে যে মেধা এবং শ্রম দিয়ে সমাজকে টেনে টেনে আরো উপরে নেওয়ার কসরৎ করে যাচ্ছেন তাকে আমরা বলছি মডার্নাইজেশন, নেক্রোপলিশন। এরা নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ কর্পোরেট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

একজন সাধারণ মানুষের দিন শুরু হচ্ছে সেলফোন সেটের এলার্ম দিয়ে অথবা টাইমার ওয়াচের এলার্ম দিয়ে। দাঁত ব্রাশের জন্য দরকার হচ্ছে হাইজেনিক টুথব্রাশ। ফ্লোরাইড টুথপেস্ট। বেসিনের জল ঠাণ্ডা হলে গিজারে গরম করতে হচ্ছে। শাওয়ার ছেড়ে চাঁদিতে সজোরে জল পড়ার কুফল যদি চুল ওঠা হয় তাহলে হ্যান্ড শাওয়ার ব্যবহার করতে হচ্ছে।

সাবানের কস্টিক শরীর নষ্ট করে (এটা সাবান ব্যবহারের সময় উল্লেখ হবে না) তাই কন্ডিশনারযুক্ত শ্যাম্পু। নরমাল শ্যাম্পু খুব যেনতেন হয়ে যাওয়ায় কন্ডিশনার ও হারবাল যুক্ত হতে হয়েছে। নাশতার টেবিলে দুই পিস পাউরুটির জন্য আট-দশ রকম ক্রোকারিজ এবং ডাইল্যুশন পেস্ট মাখার জন্য মেয়োনিজ বা ওই ধরনের ছয়-সাত প্রকারের পেস্ট, জেলি, জ্যাম দরকার হচ্ছে। চা বা কফির জন্য চার-পাঁচ ধরনের ব্লেন্ড দরকার হচ্ছে। টিব্যাগ, না ডাস্ট সেটাও বিজ্ঞানসম্মত এবং হাইজেনিক হতে হচ্ছে।

১৬ অথবা ২০ পৃষ্ঠার কালারফুল সংবাদপত্রসহ হালসংবাদের সঙ্গে সন্নিবেশিত হওয়ার জন্য ইন্টারনেট অথবা ৬২ চ্যানেলের ক্যাবেল লাইন প্রয়োজন পড়ছে। আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাকের জন্য ম্যালামাইন অথবা ভেনিয়ার বোর্ডের অথবা অ্যালয়য়ের কাবার্ড ট্রপিক্যাল স্যুট বার করতে হচ্ছে। ম্যাচিংয়ের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিউটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে মনে করে পোশাক পরতে হচ্ছে। কতটুকু সময় কাজ করবে কতটুকু হাঁটবে তার ওপর নির্ভর করে জুতো পছন্দ করতে হচ্ছে। এর পর একজন সাধারণ আরবানাইজড মানুষ কাজে বেরুচ্ছেন।

এই গ্যাজেট মাত্র দু-তিন ঘণ্টার। পুরো দিনে এবং রাতে তাকে এ ধরনের আরো হাজারো ফর্মুলা এবং ফরমেশনের মধ্যদিযে যেতে হচ্ছে। এই মানুষটি এখন আর কেবলই মানুষ নন। এক ধরনের রোবোটবিশেষ। এই মানুষটির পক্ষে সৃষ্টিশীল কোনো কিছু আর সম্ভব নয়।

সম্ভব যে নয় সেটাও আরোপিত। অনেক চিন্তাভাবনা করে ভাড়াখাটা মাথা থেকে এই বুদ্ধিগুলো বার করা হয়েছে। অনেক ভাড়াখাটা মাথার ক্রিয়েশনের নিট রেজাল্ট এ রকম একজন 'আধুনিক মানুষ'। মানুষ যদি নিজের বাইরে দু' দণ্ড ভাবতে না পারে তাহলে তাতে আর অক্টোপাশে কোনো তফাৎ থাকে না। মানুষকে জড়বস্তু অথবা চলনশীল মেশিনারিজ অথবা ক্যাপিটাল মেশিনারিজের এক্সেসরিজ করে দেওয়া হয়েছে।

এই আধুনিক মানুষের বুকের মধ্যেখানের ধুকপুক ছাড়া বাকি সব কিছুই বহুজাতিক কর্পোরেমনের দান। কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসির উপাদান। আজকের সভ্যতা, বিজ্ঞানের উপাদান ছাড়াই মানুষ লাখ লাখ বছর ধরে বেঁচে থেকেছে, বংশবৃদ্ধি করেছে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। হানাহানি কাটাকাটি করেছে, আবার জীবনকে জীবনের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।

এখনকার চাপিয়ে দেওয়া সেলফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, ফাইবার অপটিক ছাড়াও মানুষ বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ইতিহাসের হাত ধরে পেছাতে পারে, এগোতে পারে। আজ থেকে একশ দুশ বছর পর যখন এখনকার ইলেকট্রনিক গ্যাজেটগুলো অথর্ব-অসার হয়ে যাবে, যখন সংবাদপত্র আর কাগজে ছাপা হবে না, যখন গল্প-উপন্যাস আর বই আকারে বেরুবে না, তখনকার মানুষও এমনি করে ভাববে যে, এসব ছাড়াই মানুষ গোয়ের্নিকা এঁকেছিল, পিরামিড বানিয়েছিল, ম্যাট্রোলিয়াজম, ডায়ালেকটি ম্যাটরিলিয়াজম আবিষ্কার করে বিশ্ব দর্শনকে এক ঝটকায় হাজার বছর এগিয়ে দিয়েছিল। 'ওয়ার এন্ড পিস' লেখা হয়েছিল। 'মা' লেখা হয়েছিল।

যুদ্ধের ভেতর বসে যুদ্ধবিরোধী 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ লেখা হয়েছিল। কার্ল সেগানের 'কনটাক্ট'-এ আমরা দেখি চরম ইলেকট্রনিক্সের উৎকর্ষের সাহায্য নিয়ে আদিম স্বর্গে পৌঁছানো এবং অভাব বোধহীন এক অপার শান্তিময় জগত। সেখান থেকে অভাব বোধের এই মর্তে ফিরে আসাও এক অভিশাপ। বহুজাতিক কর্পোরেশন আমাদের সব কিছু গ্রাস করেছে। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি, মনুষ্যজীবন-মনুষ্যমরণ-মনুষ্যবিকাশ-মনুষ্যবিনাশ, ভালোবাসা, ভালোলাগা, স্নেহমমতা, কর্তব্য, বোধ-বোধি, আধ্যত্ম ইহজাগতিকতা, পরলৌকিকতা সব।

কিন্তু একটা সময়ের একটা স্রোতের সব কিছু গ্রাস করার পরও একটা সময় আসে যখন কমোডিটিজের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। আর নতুন পণ্য চলতে চায় না। তখন পণ্যের বহুমুখীনতা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেই আবশ্যকতা থেকেই কর্পোরেট সভ্যতা হাজির করে মিনি, ম্যাক্সি, জাম্বু, জায়ান্ট এবং ফ্যামিলি প্যাক। তা যেমন শ্যাম্পু, সাবান, টুথপেস্টে; তেমনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে।

ছোটগল্প অপাংক্তেয় পানসে হয়ে গেলে বড়ো গল্প। উপন্যাস জোলো হয়ে উঠলে এ্যান্টিউপন্যাস। তৈলচিত্র একঘেঁয়ে হয়ে গেলে কোলাজ। নাটক ঝুলে যাওয়া শুরু করলে সিরিয়াল। সিরিয়াল দর্শক ধরে রাখতে ব্যর্থ হতে শুরু করলে মেগা।

যেটা যেভাবে বিকোয়। বিকোনোর প্রত্যয় থেকে সৃষ্টি করা হয় নিত্যনতুন কমোডিটিজ। তাতেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। হয়নি। আর তাই এর পর ভাড়াখাটা সুশীল সমাজ, মাথা বিক্রি করা ধীমান, আত্মবিসর্জন দেওয়া আত্মম্ভরি আত্মচালিত বিবেক কর্পোরেট সোসাইটির জন্য আবিষ্কার করে সেন্ট্রালাইজড এমবারগো।

অথাৎ পেটেন্ট। তুমি তোমার বিদ্যা বিবেক দর্শন সংস্কৃতি দিয়ে সবই নির্মাণ করতে পারো কিন্তু তা বিপণনের সার্টিফিকেট দেবে বহুজাতিক কর্পোরেশন। তাদের দালাল বহুপাত্রে বিক্রিত বিদ্বোৎসমাজ, বহু ক্ষেত্রে ভাড়াখাটা কর্পোরেট মাথার ক্রিয়েশন। এদের সঙস্থা কর্পোরেট ডেমোক্র্যাসি। সেই ডেমোক্র্যাসির পরিচালক কর্পোরেট সরকার এবং একটা বাতিল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত আল্ট্রাকসমোপলিটান স্টেট।

এখন সাহিত্য পুরষ্কার দিচ্ছে ইউরোপভিত্তিক ইলেকট্রনিক কোম্পানি। রচনা পুরস্কার দিচ্ছে সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানি। এভাবে শান্তি পুরস্কার, কবিতা পুরস্কার, সাহসিকতা পুরস্কার, সাংবাদিকতা পুরস্কার, দারিদ্র্য বিমোচন পুরস্কার, স্যানিটেশন পুরস্কার, ক্রিয়েটিভ পুরস্কার সবই দিচ্ছে বহুজাতিক কর্পোরেশন। মৃতের শোভাযাত্রার স্যুভেনিরেও স্পন্সর হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি। সরকার-রাষ্ট্র কীভাবে কত জোরে, কতটুকু চলবে তাও বলে দিচ্ছে অ্যাফলুয়েন্ট সোসাইটিকে ডিসকমফোর্ট করে দেওয়া বহুজাতিক কর্পোরেশন।

'আইএসও ২০০০' বা 'আইএসও ২০০১' নাম দিয়ে সার্টিফিকেট ইস্যু করা হচ্ছে। ওটা ছাড়া বহেমিয়ান কোনো কমোডিটিজ বিপণনের যোগ্য নয়। কম্পিউটার আর ডাটা ব্যবহার করে দশ ডিজিটের নম্বর লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ইতিমধ্যেই সাধারণ অল্পশিক্ষিতদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও পণ্য উৎপাদনকারীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিকাশের ফলে বৈরী বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে।

মানুষ মাঝে-মধ্যেই সব ছেড়ে ছুড়ে অরণ্যচারি হতে চাইছে। ক্ষণে ক্ষণেই বলে উঠছে 'দাও ফিরে সেই অরণ্য'। সায়েন্স ফিকশন তার তুকতাক মন্ত্রতন্ত্রে আবিষ্ট হয়ে নিভৃতচারি হতে চাইছে। মানুষকে এখান থেকে ফেরানোর জন্য পণ্য প্রবাহ আর অভাব বোধের অসীম আকাক্সক্ষা ফেরানোর জন্য ধরে ধরে শক্ দেওয়া হচ্ছে। সিনেমার মাধ্যমে শক্ দেওয়া হচ্ছে।

বীভৎস ছবি ছেপে শক্ দেওয়া হচ্ছে। অরবিটাল ভেরিয়েশনে সৃষ্টি করে হরর মুভি, হরর উপন্যাস, স্যাডিস্ট গল্প, রেপিস্ট সিনড্রোম গিলিয়ে শক্ দেওয়া হচ্ছে। ট্রাডিশনাল শিল্পকর্ম এখন শক্, শকুমেন্টারি। তিনটি 'এস' দিয়ে তাদের বিবস করে দেওয়া হচ্ছে। এস ফর সেক্স, এস ফর স্যাডিজম এবং এস ফর শক্।

এর ফলে মানুষের চিরাচরিত ভাবাবেগ, বিচারবুদ্ধি, বিবেক, দর্শন সব শকোথেরাপিতে স্যাডিজমে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর নির্বিকার প্রদর্শনে দেখা যাচ্ছে ছাত্র পেটাচ্ছে শিক্ষককে। মাওলানা ধর্ষণ করছে বালককে। পুলিশ সমবেত ধর্ষণ করছে শিক্ষিকাকে। সংবাদপত্রে নগ্নছবির প্রতিযোগিতা।

সম্পাদক বিকোচ্ছে কর্পোরেশনে। সাংবাদিক জিন আর ভোদকায় বিবস হচ্ছে, বার্তা সম্পাদক 'লিডের' জন্য মৃতের সংখ্যাধিক্য চাইছে। বিচারক পয়সা নিয়ে খুনিকে ছেড়ে দিচ্ছে, নির্দোষকে ফাঁসি দিচ্ছে। সারা দিন অনৈতিকতার সাগরে ডুবে রাতে ধর্মবাণী ফেরি করছে। ইহজাগতিক পাপের পঙ্কিলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পরলৌকিকতার তাবিজ-কোবজ জড়ো করে সন্ত সেজে স্বর্গের গৌরব গাইছে।

সারাক্ষণ নিজ নিজ শ্রেণীর সোপান পেরিয়ে ঊর্ধ্ব শ্রেণীর মোহময় স্পর্শ পাওয়ার জন্য ঘরের স্ত্রীকেও ভেট দিচ্ছে। অধ্যাপক বিদ্যা নিয়ে হাট বসাচ্ছে। বেসরকারি মোকাম, ঝকঝকে হাট। ওখানে বিদ্যা বিক্রি হচ্ছে- মিনি-ম্যাক্সি-মেগা সাইজের বিদ্যা। চাই চাই খাই খাই এই জীবনেরও একটা তাল লয় আছে।

আজকের বেসুরো বেতাল জীবন যত আপাতবিসদৃশ উৎকট হোক না কেন, তারও একটা অন্তরমিল আছে। এবং সেটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব বুদ্ধিমান মানুষের অর্থাৎ 'বুদ্ধিজীবীদের', যারা এখনো বিপণনের জন্য বাজারে উঠেননি, তাদের।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।