খাদ্য-নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনিÑ গণশিক্ষা, সাক্ষরতা কর্মসূচি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, জমির বহুবিধ ব্যবহার, উন্নত বীজ ও উচ্চ ফলনশীল বীজের প্রচলন, কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা, কৃষি উন্নত প্রযুক্তি কৃষকের দোরগেড়ায় পৌঁছানো, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়বদ্ধতা এবং এগুলো সফল-সঠিকভাবে কার্যকরভাবে জনগণের দোরগোড়ায় যাতে পৌঁছে এজন্য তার সচিবালয়ে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ফুড মনিটরিং সেল স্থাপন করে সুফল মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। Click This Link
গোলাম কাদের
বিশ্বব্যাপী এবং আমাদের দেশেও আজকাল অহরহ খাদ্য-নিরাপত্তার কথা শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণেই খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিশেষজ্ঞদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বের দেশে দেশে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা। আর এজন্যই খাদ্য-নিরাপত্তা গড়ে তুলতে সবাই তৎপর।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বপ্নের বাংলাদেশ সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভুলে যাননি। এজন্য তিনি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাঝে স্বপ্নের বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পরবর্তী সময়ে ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। বরং ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, খুন, হত্যা, দুর্নীতি আর বিদেশিদের কাছে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে দেশের অপবাদ কুড়াতে হয়েছে।
তাই তিনি ক্ষমতায় আসার পর দেশ উন্নয়নের জন্য বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের মতো জরুরি বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা বিধান করে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছেন। বিপ্লবকে সফল করার জন্য তিনি খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, গণশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে যে বাংলাদেশের হাস্যোজ্জ্বল ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল অভাবহীন বাংলাদেশ তিনি চেয়েছেন। বছরে ২০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি নিয়ে দেশ চালাতে যে কাউকে হিমশিম খেতে হবে। তাই দ্বিগুণ উৎপাদনের ডাক দেন।
খাল খনন, পুনর্খনন কর্মসূচি। দেড় বছরে ৪০ লাখ লোককে অক্ষরজ্ঞান দেন আর মাঠকর্মীদের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করেন। তার সময়ে সাফল্য বয়ে এনেছে কর্মসূচির আন্তরিক বাস্তবায়ন। শহীদ জিয়ার স্বপ্নের বাংলাদেশ, স্বাবলম্বী বাংলাদেশ, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার মূল কর্মসূচি ছিল দেশব্যাপী খাল খনন কর্মসূচি। বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ এলাকা।
পলি গঠিত মোট জমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার একর (৫৫ হাজার ৫৯৮ বর্গমাইল)। আর এ এলাকাগুলো গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং এদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা দ্বারা বেষ্টিত। নদীগুলো দীর্ঘ ৯ হাজার মাইল। নদীগুলোর পানি প্রবাহের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৫০ লাখ কিউসেক এবং সর্বনিম্ন ৪ থেকে ৫ লাখ কিউসেক। এ পানি উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে।
এ দেশের মাটি পলিতে উর্বর তাই খাদ্যশস্য ফলে প্রচুর। শহীদ জিয়া দেখলেন তার ৯ কোটি মানুষের প্রয়োজন বছরে দেড় কোটি টন খাদ্যশস্য। কিন্তু ২ কোটি ২৫ লাখ একরে উৎপন্ন হয় ৩২ লাখ টন খাদ্যশস্য। ফলে জনগণের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খাদ্যশস্যের জন্য ব্যয় হয়ে যায়।
দেশে বহু নদ-নদী আছে অথচ বছরে ছয় মাস পানির অভাবে জমির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। তাই বৃষ্টিপাত হয় না। শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের নদীগুলো যখন শুষ্ক থাকে কৃষক সেচের পানিও পায় না। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ঢালু এবং তা প্রায় ২০০ ফুট থেকে ১০ ফুট, ক্ষেত্রবিশেষে আরো কম। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানি প্রায় থাকে না।
সেচ সুবিধা না থাকায় ৪০ ভাগেরও বেশি জমিতে মাত্র একটি ফসল হয়।
এসব বিষয় বিবেচনা করে শহীদ জিয়া জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশব্যাপী খাল খনন ও পুনর্খননের মাধ্যমে সেচ সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নেন। আর এ কর্মসূচিটি সফল করে দ্বিগুণ ফসল ফলানোর জন্য জনগণকে স্বেচ্ছাশ্রমে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। পুলিশ, আনসার, গ্রামরক্ষী বাহিনী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও মহিলা সংস্থার সদস্য সদস্যা, জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এক কথায় সর্বস্তরের জনগণ এ কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালের ১ ডিসেম্বর কর্মসূচি শুরু হয়।
১০৩টি স্কিমের অধীনে ৫০০ মাইল খাল খনন ও ৫ লাখ একর জমি সেচের আওতায় আনার জন্য স্থির করা হয়। কিন্তু জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ ও উদ্দীপনার জন্য স্কিমের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হয় ২৫০টিতে। ৯০০ মাইল খাল খনন ও ৮ লাখ একর জমিতে সেচ সুবিধা গড়ে ওঠে। আর যেখানে কর্মসূচি শেষ হওয়ার কথা এপ্রিলে তা শেষ হয় মার্চে। এতে ১৯৭৯-৮০ সালে যেখানে ১৯ লাখ টন বোরো ফসল পাওয়া যায় সেখানে ১৯৮০-৮১ সালে পাওয়া যায় ২৫ লাখ টন।
আউশ ধান এবং গম অনেক বেশি উৎপন্ন হয়। স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন কর্মসূচি দেশের জনগণের জন্য বয়ে আনে সৌভাগ্য। আর বাম্পার ফলন হয়েছিল বলে স্থানাভাবে সরকারের ব্যক্তিগত পর্যায়ে গুদাম, ও গোলাঘর ভাড়া করে খাদ্যশস্য রাখতে হয়েছিল। এমনকি তখন কিছু চাল উদ্বৃত্ত হিসেবে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া এ খাল খননের মাধ্যমে শুধু ধান ফলনেরই ডাক দেননি, খালের দুই তীরে ফলমূল চাষ, খালে মাছ চাষ, হাঁস পালন, ছোট ফার্ম গড়ে তুলতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বেকার যুবকদের যুব মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নানা স্বনির্ভর শিল্পে জড়িয়ে পড়ার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও করেছেন। তিনি যতোদিন জীবিত ছিলেন খাল খনন কর্মসূচি ততোদিন অব্যাহত গতিতে চলছিল। পরবর্তী সরকার এসে তা বন্ধ করে দেয়। স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। দেশে হাত পাতার রাজনীতি আবার চালু হয়।
জনগণকে পরমুখাপেক্ষী করা হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শুধু একজন কর্মী পুরুষ ছিলেন না। চিন্তায়ও বৈপ্লবিক কর্মসূচি ছিল। তিনি তার রাজনীতি নিয়ে শহরেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বেরিয়ে পড়েছেন গ্রামে। হেঁটে বেড়িয়েছেন, সাধারণ মানুষের ঘরে গিয়ে উঠেছেনÑ বিস্ময়ে মানুষ চেয়ে দেখেছেন আপন সন্তানের মতো প্রেসিডেন্ট নিজ ঘরে।
আপন সন্তানের মতো গিয়ে বসেছেন জিয়া।
লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের স্মৃতির আয়না থেকে একটি উদ্ধৃতি দিলেই পরিষ্কার হবেÑ ‘খাল কাটা উদ্বোধন করতে গিয়ে একদিন এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেন। খুব সাধারণ ভাবভঙ্গি নিয়েই বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। চোখে খুব কম দেখেন। বললেনÑ
‘তুমি কে গো বাবা?
Ñআমি জিয়াউর রহমান।
বৃদ্ধা এসে জিয়া জিয়া বলে স্নেহে তার চোখ-মুখ হাতড়াতে লাগলেন এবং বললেন,
আমার মতো গরিব মাইনষের কাছে কি চাও বাবা?
প্রায় কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধা। জিয়াউর রহমান মার কাছে কথা বলার মতো করেই বললেন,
মাগো, খাঁ খাঁ দুপুর, একটু লেবুর শরবত খাবো।
বৃদ্ধা আরো জোরে কেঁদে উঠলেন।
-বাবারে, আমার ধন, আমার বাড়িতে যে লেবু নাই, কী খাওয়াই, খালি মুখে তো তোমাকে যাইতে দিমু না। বৃদ্ধা যেন কিছু খাবার খুঁজতে থাকে।
জিয়াউর রহমান যেন মার সঙ্গে দুষ্টামি করে বলছেন, মাগো তোর সঙ্গে দুষ্টামি করছিলাম। আগামী বছর আসবো। তুই আমার জন্য লেবু গাছ বুনবি। আমি সেই লেবু গাছের লেবু দিয়ে তোর হাতের শরবত খেয়ে যাবো। ’
এই হলো শহীদ জিয়া।
তিনি ধনধান্যে পুষ্পে ভরা এই দেশ, স্বপ্নের বাংলাদেশে গোয়ালভরা গরু, আঙিনায় মোরগ-মুরগি, পুকুর আর খাল পাড়ে নারকেল, সুপারি, আম-জাম, পেঁপে ফলের বাগান দেখতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে সুখী ও আত্মনির্ভর দেখতে চেয়েছেন। এজন্য ঘুম আরাম-আয়েশকে হারাম করেছেন, ছুটে বেড়িয়েছেন তেপান্তরের রাজপুত্রের মতো মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম। মাসের ২০ দিনই ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামে। কাজে ২২ ঘণ্টা ব্যয় করেছেন, দেখতে চেয়েছেন স্বনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি।
আর এভাবেই তার সময় তিনি খাদ্য-নিরাপত্তা গড়ে তুলেছিলেন।
আজকাল সুশাসন (এড়ড়ফ এড়াবৎহধহপব) সম্পর্কে অনেক জ্ঞানগর্ভ, সারগর্ভ বক্তব্য আমরা বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রতিবেদনে দেখতে পাই। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় হয়তো রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের ব্যাপারে এতো সুবিন্যস্ত ও জ্ঞানগর্ভ উপাদান ছিল না কিন্তু যা ছিল তা হলো একটি প্রচ- গতিময়, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা।
প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না যে বিষয়ে তিনি সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিকবার পরিকল্পনা কমিশনে যেতেন, এনইসি মিটিং করতেন ও বিভিন্ন সেক্টরে গঠিত কমিটিগুলোর মিটিং করতেন।
এছাড়া নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠক তো করতেনই এবং সর্বোপরি দেশের প্রায় সর্বত্র জনসংযোগ করে বেড়াতেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তার গ্রামে-গঞ্জে পদব্রজে মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার কথা।
তিনি খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মানুষের মৌলিক অধিকার নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। মানুষকে অনিরাপদ রেখে খাদ্য নিরাপত্তা দেয়া যাবে না তাই তিনি আইন-শৃঙ্খলার দিকে সবসময় নজর দিয়েছেন সর্বোচ্চ সতর্কতায়।
খাদ্য-নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি (ক) গণশিক্ষা, সাক্ষরতা কর্মসূচি; (খ) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; (গ) আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি; (ঘ) জমির বহুবিধ ব্যবহার; (ঙ) উন্নত বীজ ও উচ্চ ফলনশীল বীজের প্রচলন; (চ) কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা; (জ) কৃষি উন্নত প্রযুক্তি কৃষকের দোরগেড়ায় পৌঁছানো; (ঝ) খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন; (ঞ) কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়বদ্ধতা এবং এগুলো সফল-সঠিকভাবে কার্যকরভাবে জনগণের দোরগোড়ায় যাতে পৌঁছে এজন্য তার সচিবালয়ে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ফুড মনিটরিং সেল স্থাপন করে সুফল মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।