আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: কায়েসের আত্মহত্যা পরবর্তি বিভ্রান্তি সমুহ



আমাদের বন্ধু কায়েস, বাঁ'হাতের কব্জির ইন্চি খানেক উপরে যেখানে একটা বড়ো সড়ো তিল জ্বল-জ্বল করে জ্বলে থাকত; তার একটু নিচে; চামড়ার নিচে রক্তে ওৎপেতে থাকা সর্পিল শীরাটা যা প্রায়শই কচুরি-পানায় রোদপোহানো জল-ঢোঁড়া বলে ভ্রম হতো, একটা ভোঁতা ছুরিতে কেটে, ঘন্টা খানেকে বা তার বেশিও হতে পারে, নি:শব্দে মরে গেল । এবং ওর মরে যাওয়া বা নিজেকে মেরে ফেলার দিন তিনেকের মাথায়, আমরা যারা কায়েসের বন্ধু বা বন্ধু বলে দাবি করতাম; যদিও আমাদের দাবির গ্রাহ্যসিমা নিজেদের কাছেও খুব একটা খোলাসা ছিলনা কোন দিন, হঠাৎ করেই বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। দিন তিনেকের মাথায় আমাদের উপলব্ধির চোঁয়াল এঁটে আসে এই ভেবে যে, ১২ কি ১৫বছর বা তারো বেশি সময়ে আমরা কায়েসকে চিনতে পারিনি এমনকি ওর বাঁ'হাতের কব্জির জ্বল-জ্বলে কালো তিলটার নিচে রোদপোহানো জল-ঢোড়াটিকেও বৈশিস্টপুর্ন মনে হয়নি কখনো। আমরা, যারা নিজেদের কায়েসের বন্ধু বলে দাবি করছি, আমাদের পরস্পরের যোগসুত্রের সুতাটা কোন এক মফস্বলের সবচাইতে উঁচু গাছটার ডালে বাধা ছিল। আমাদের চোখের সামনে ইটভাটার চিমনি কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের শোকাতুর লাইট হাউজ হয়ে যেত এবং আমাদের ১২কি১৩ বছরের কচি ঠোঁট গুলো সিগ্রেটের তুমুল ত্রাসে নীল হয়ে উঠত আর আমরা যুথবদ্ধ হয়ে একই মেয়ের প্রেমে পড়তাম।

তো, এরপর যখন শহরের চওড়া রাস্তা আর পেটুক বিপনী বিতান আর চকচক্ব অফিস গুলো অনিবার্য হয়ে উঠল, আমরা সেই সুতা বাধা মফস্বল ছেড়ে এলাম । প্রথাগত ভাবে আমরা এই অনিবার্য শহরে উপগত হওয়ার সময় নিয়ে এসে ছিলাম, আমাদের মফস্বলের কিশোরী নদী, লাল সুরকির রাস্তা, তেলচুপচুপে মাথার বাম অথবা ডান দিকে সরু সিঁথি, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের শোকাতুর লাইটহাউজ, আমাদের কমন প্রেমিকা ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিজোযনের সুত্রে দ্রুতই কিশোরী নদীর জায়গা নিয়ে নিয়েছিল লিকলিকে লেক আর লাইট হাউজটা শহরের বিমর্ষ মনুমেন্ট গুলোর কাছে শুধুই ধোঁয়া ওড়ানো চিমনী হয়ে গিয়েছিল। শুধু আমাদের বন্ধু কায়েসের বুক পকেটের তলানিতে আমাদের অস্পস্ট মফস্বলের কিছু ধুলো রয়ে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে, হয়তবা বছরে এক বা দুইবার মদ্যপানের সময় আমরা সেই তলানি ছেঁকে আমাদের অস্পস্ট মফস্বলের গন্ধ শুঁকতাম। মধ্য ত্রিশের আমরা নিজেদের চৌকষ দড়াবাজিকরের ভুমিকায় নিয়ত দেখতে দেখতে বুড়িয়ে যাচ্ছিলাম এবং মাঝে মাঝে আমাদের মনে হতো "ধুশ শালা, ভাল্লাগেনা এই বালের জীবন!" শুধু কায়েস ঠোঁটের বাঁ কোনে সিগ্রেট ঝুলিয়ে ট্র্যাপিজের সরু তারের দিকে চেয়ে হাসত আর ওর বৈশিস্টহীন মাথাটা এপাশ-ওপাশ দুলাতো।

আমরা যখন সিড়ি ভেংগে উঠে যেতাম দ্রুত বা চিতার ক্ষিপ্রতায় ছুঁতে চাইতাম কোন টার্গেট, কায়েস তখন ঠোঁটের বাঁ'কোনে সিগ্রেট ঝুলিয়ে এই শহরের বৈশিস্টহীন মানুষগুলোকে দেখত নির্বিকার, আর আমরা কায়েসের কালো, ঠেলে ওঠা হনু আর কোঁচকানো ভ্রর নিচে নিভন্ত একজোড়া চোখের সমস্টিতে ঐ শেকড় ছেড়া বৈশিস্টহীন মানুষগুলোর সাথে ওর কোন পার্থক্য দেখতাম না, ফলে শহরের তাবৎ বৈশিস্টহীন মানুষগুলো হুটহাট কায়েসের মধ্যে সেধিয়ে পড়লে আমরা আশ্চর্য হতাম না। কায়েস যেদিন কায়েসের হাতে খুন হলো, তার পরের দিন আমরা ওকে নিতে গিয়েছিলাম। মর্গ নামক জায়গাটা চিরায়ত ভাবেই ঠান্ডা এবং আমরা শীতার্ত হতে হতে কায়েসকে গ্রহন করেছিলাম। শববাহী গাড়িতে আমরা কায়েসের সাথে অপরিসর জায়গাটুকু ভাগাভাগি করে গতো দিনের ধকলের জন্য ভ্রু কুঁচকে কায়েসের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, এবং ভাবছিলাম কায়েসটা আমাদের ভেতর সবার আগে ফেলে আসা অস্পস্ট মফস্বলটার নাগাল পেয়ে গেল। কিশোরী নদীটার ধারে আমরা কায়েসকে শুইয়ে দিয়েছিলাম, যেন কায়েস মাথা উঁচু না করেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের শোকাতুর লাইট-হাউজটা দেখতে পায়।

তারপর আমরা ১২বা১৩ বছরের পুরোন কচি ঠোঁট সিগ্রেটের তুমুল ত্রাসে নীল করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং মনে আছে আমরা কেউই ঠোঁটের বা'দিকে সিগ্রেট ঝুলে পড়তে দিইনি। দিন তিনেকের মাথায়, আমরা শহরের লিকলিকে লেকটার ধারে একটা চা-শালায় একত্রিত হয়েছিলাম। আমরা চায়ের কাপে ঘূর্নি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কায়েস এতক্ষন কড়ে আংগুলটা চুবিয়ে বলতো "কাকা, পানিতো গরম হয়নাই গো!" আমরা সবাই চায়ের ঘূর্নিতে কড়ে আংগুল চুবিয়ে কায়েসের ওম- সল্পতা শুষে নিচ্ছিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ একজন গলা খাকারি দিয়ে বিষয়টি শুরু করার ইংগিত দিচ্ছিল। "ও এই কাজটা কেন করলো!" এটা কোন প্রশ্ন ছিল না বা কোন সরলরৈখিক স্বগতক্তিও ছিলনা, তার পরেও আমরা নড়ে চড়ে বসেছিলাম।

"ওর বউ যে প্রেম করতো কার লগে, ঐ যে ওর মামাতো ভাই না কার লগে জানি। " কায়েসের বউ এর পরকিয়া প্রেম সংক্রান্ত সম্ভাবনাটা আমাদের মাথায় কিছুক্ষন ঝুলে ছিল কিন্তু খানিক বাদে মাথা নেড়ে সম্ভাবনাটা আমরা বাতিল করে দিয়েছিলাম। "ও এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতো না কোন দিন। নিজের বউ এর সাথে অন্য কারো প্রেমের বিষয়ে এতটা নির্বিকার থাকা কায়েসের পক্ষেই সম্ভব ছিল। " "ওর বৌ মামাইতো ভাইয়ের লগে প্রেম করতো বইলা কায়েস মনে হয় সস্তি পাইতো, এ্যাতে কইরা হালায় আরো বেশি একা থাকতে পারতো।

" "জীবনানন্দ নামে কোন কুবি নাকি ট্রাম না ট্রাকের তলায় লাফ দিয়া মরছিল বলে? আমাগো কায়েস তো কুন দিন কুবিতা-টুবিতা লেখে নাই!" "নাকি শালা এই কয়দিনে পৃথিবীর সবটুকু দেখে নিয়েছিল?" সম্ভাবনাগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গলে, আমরা সেদিন আরো কয়েক কাপ চা বেশি খেয়েছিলাম এবং লিকলিকে লেকের ধারে কিছু বৈশিস্টহীন মানুষ এবং তাদের অনুগামী ছায়ার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়েছিলাম কারন তারা প্রত্যেকেই দেখতে কায়েসের মতো ছিল। আমাদের চোখের ভেতর রোদপোহানো জল-ঢোঁড়াটা কাটা মাথা নিয়ে সাঁতরিয়ে বেড়াচ্ছিল, ফলে সাপটিকে মুক্তি দিতে আমরা লিকলিকে লেকের ধারে চা-শালা আর বৈশিস্টহীন মানুষ এবং তাদের অনুগামী ছায়া সমেত শহরের নাভির নিচে নেমে গিয়েছিলাম, যেখানে বিষফোঁড়া অথবা আঁচিলের মতো দালান গুলোর কোন একটায় আমাদের বন্ধু কায়েস থাকত। কায়েসের ঘরে, বিছানার অবিন্যাস্ত চাদর আর হেলে পড়া বালিশ আমাদের প্রয়োজনীয় সুত্র দিতে ব্যার্থ হলে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। "কোন নোটও রেখে যায়নি!" "ও যখন হাতটা কেটে ফেলে, টিভিতে টম এ্যান্ড জেরীর সবচাইতে মজার শো'টা হচ্ছিল!" "হ, শালা কায়েস টম-জেরীর খুব ভক্ত আছিল। " "হুম, বউ আর বাচ্চাটাকে আগের দিন বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।

" "তরা যায় কস না ক্যান, আমার তো মনে হয় কায়েস ওর ছিনাল বৌটার লাইগা সুইসাইড খাইসে!" আমাদের নুয়ে পড়া মাথাগুলো এপাশ-ওপাশ দুলে এই সম্ভাবনাটাকে দ্বিতীয়বারের মতো নাকচ করে দিয়েছিল। টম-জেরীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝে আমাদের নুয়ে পড়া বিভ্রান্ত মাথা গুলো এপাশ-ওপাশ দুলছিল খুব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.