আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেনজির ভুট্টো : উপমহাদেশের এক প্রগতিশীল মুসলিম নারী নেত্রীর প্রস্থানের এক বছর

বিবর্ণ জীবনে কয়েক ফোটা রং......

২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর। আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন উপমহাদেশের প্রগতিশীল নারী নেত্রী এবং পাকিস্তানের দু'বারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। মাত্র ৫৪ বছরের জীবনে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে খ্যাতির শীর্ষে আহোরণ করেছিলেন তিনি। জীবনের চলার পথটি কখনই মসৃণ ছিল না বেনজিরের জন্য। সমালোচনা আর একের পর এক মামলার কারণে অনেকবারই পরবাসী হতে হয়েছে তাকে।

সেই বেনজির পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হল আজ। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সারা বিশ্বেই আজ স্মরণ করা হচ্ছে তাকে। ফিরে দেখা হচ্ছে তার অতীতের বর্ণাঢ্য জীবনের দিকে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ১৯৫৩ সালের ২১ জুন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বেনজির পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বড় মেয়ে।

তিনি দু' দু বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বেনজির ছিলেন ইসলামী দেশগুলোর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী মহিলা প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ডটিও বেনজিরের। বেনজির মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানকার র‌্যাডক্লিফ কলেজ থেকে আন্ডার গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর তিনি আবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন।

১৯৭৭ সালে তিনি এখান থেকে তার দ্বিতীয় ডিগ্রীটি অর্জন করেন। এবছরেরই শেষের দিকে বেনজির দেশে ফিরে আসেন। সে সময় তাঁর বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দেশে ফেরার মাত্র কিছুদিনের মধ্যই ১৯৭৭ সালেই জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান এবং বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেফতার করেন। ১৯৭৯ সালে বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার পর বেনজির ভুট্টো মোট ৮ বার গৃহবন্দী ও কারাবন্দী হন।

এরফলে পরবর্তীতে তিনি বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। এর আগে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তানের পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে বিদেশে নির্বাসনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার আগে বেনজিরকে ৩ বছর আটক রাখা হ্য়। এরপর তিনি লন্ডনে বসবাস শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে ভাই শাহনেওয়াজকে ফ্রান্সে রহস্যজনকভাবে হত্যার পর ভাইকে কবর দিতে বেনজির দেশে আসেন।

এসময় সরকার বিরোধী র‌্যালিতে অংশ নেয়ার অপরাধে আবারও বন্দী করা হয় বেনজিরকে। পরে মুক্তি পেয়ে আবার তিনি লন্ডনে ফিরে যান এবং দেশে সামরিক শাসনের অবসান হলে ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে বেনজির পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। এবছরই তাকে তার মায়ের সঙ্গে যৌথভাবে পিপলস পার্টির কো-চেয়াম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে বেনজির সিন্ধু প্রদেশের ব্যবসায়ী আসিফ আলী জারদারিকে বিয়ে করেন। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে আয়োজিত পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বেনজিরের পিপলস পার্টি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।

এরফলে মাত্র ৩৫ বছর বয়সী বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস রচনা করেন। ২ ডিসেম্বর ১৯৮৮ ক্ষমতায় বসার মাত্র ২ বছর পরই ১৯৯০ সালের ৬ আগষ্ট আমেরিকার ইঙ্গিতে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন তৎকালীন পাক-প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান। এরপর ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পিপলস পার্টি আবারও জয়লাভ করে এবং বেনজির ভুট্টো ১৯ অক্টোবর আরেকবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতায় এসে এবার বেনজির দেশের আনাচে-কানাচে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেন এবং দেশের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তানের পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর তিনি বেইজিং এ আয়োজিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আবারও বরখাস্ত করেন সে সময়ের প্রেসিডেন্ট ওয়াসিম সাজ্জাদ। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের পিপলস পার্টির আজীবন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এবছরই অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগের কাছে হেরে যায়। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় বেনজিরের অপর ভাই মীর মূর্তজা বেশ কিছু দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে। এরই এক পর্যায়ে করাচিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মূর্তজা।

এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে পিপিপি সমর্থকরা সেসময় বিভক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের দু'টি আদালতের রায়ের ভিত্তিতে বেনজির ভুট্টো আর তাঁর পরিবারের কয়েক শ'কোটি মার্কিন ডলারের সম্পত্তি ও ব্যাংকের আমানত জব্দ করা হয় এবং তাকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এ সময় আদালতের রায়ে বলা হয়, বেনজির আর কোনদিন সরকারের কর্মচারী হতে পারবেন না। এছাড়াও তাকে ৮৬ লাখ মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে এ সময় তার স্বামী আসিফ আলী জারদারিকেও কারাদন্ড দেয়া হয়।

ফলে এ বছরই বেনজির আবারও বিদেশে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। আবারও তার ঠিকানা হয় লন্ডন। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ও বেনজিরের মধ্যে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সহ বিভিন্ন বিষয়ে এক দফা সমঝোতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, পারভেজ মোশাররফ, বেনজির ভুট্টো সহ পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা এবং রাজনীতিককে বিশেষ ক্ষমা প্রদান করেন। এর বিনিময়ে বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি নির্বাচন বর্জন করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে বেনজির ভুট্টো দীর্ঘ ৯ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচিতে ফিরে আসেন। সেদিন রাতেই করাচিতে তার আগমনের বিরুদ্ধে দু'দফা বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ১৪০ জন নিহত ও ৫০০জনের বেশী লোক আহত হয়। অল্পের জন্য বেনজির ভুট্টো এ যত্রায় মৃত্যু থেকে রেহাই পান। কিন্তু মৃত্যু তার পিছু ছাড়েনি।

২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে এক নির্বাচনী সমাবেশে বর্বরোচিত এক আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন বেনজির। শহরের লিয়াকত বাগে প্রথমে তাকে লক্ষ্যকরে গুলি ছোড়া হ্য়। এরপর হামলাকারী তার বোমার বিস্ফোরন ঘটান। এই হামলায় বেনজির ছাড়াও কমপক্ষে আরও অন্তত ২০ জন নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি লোক আহত হ্য়। নিহত বেনজিরের লাশ আকাশ পথে সিন্ধুর লারকানা জেলার তার নিজ শহর ঘারি খুদা বখসে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানেই ভুট্টো পরিবারের পারিবারিক গোরস্তানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয় বেনজিরকে। ব্যক্তি জীবনে বেনজির ভুট্টো মোট ৩ সন্তানের মা। তাঁর দুই ছেলে বিলাওয়াল এবং বখতাওয়ার। আর এক মেয়ে আসিফা। বেনজিরের মৃত্যুর পর ৩০ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে তার অক্সফোর্ড পড়ুয়া ১৯ বছর বয়সী ছেলে বিলাওয়ালকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।

তবে বিলাওয়াল বড় না হওয়া পর্যন্ত এ দায়িত্ব তার স্বমী আসিফ আলী জারদারি পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হ্য়। আসিফ আলী জারদারিকেও এ সময় পার্টির কো-চেয়ারম্যান করা হয়। পরবর্তীতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে পিপলস পার্টি জয় লাভ করলে জারদারি পারভেজ মোশাররফকে হটিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে নিজেই প্রেসিডেন্ট পদে অসীন হন। পাকিস্তানের ১২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে এখন জারদারিই দায়িত্ব পালন করছেন। e-mail :


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.