আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্কসবাদের ইতিহাস পড়তে পড়তে অনিবার্যভাবেই আমার লালনের কথা মনে পড়ে গেল

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

মাঝে মাঝে আমি ভাবি: সভ্যতার ইতিহাসে কে প্রথম বললেন যে, ঈশ্বর বাস করেন মানুষের ভিতর। কথাটা যে লালন বিশ্বাস করতেন তা আমরা জানি। কিন্তু, তার আগে? দ্বাদশ শতকের পারস্যের কোন কবি? নবম-দশম শতকের কোনও সুফীসাধক? ভাবলে অবাক লাগে ইউরোপও প্রগতিশীলেরাও ওই একই ধারণায় পৌঁছেছিল।

কখন? কার্ল মার্কসের তরুন বয়েসে। জার্মানিতে। ১৮৩৬। কার্ল মার্কস বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন । এর ৫ বছর আগেই হেগেল মারা গেছেন।

হেগেলের প্রভাব অবশ্য তখন সারা জার্মানীর শিক্ষিত সমাজে তুঙ্গে। মার্কসও তখন আইন পড়া বাদ দিয়ে রাতদিন হেগেল পড়ছেন। হেগেলের অনুসারীরা ততদিনে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল রক্ষণশীল, গোঁড়া; অন্য দলটি র‌্যাডিকাল। হেগেলের র‌্যডিকাল অনুসারীরাই Young Hegelians নামে পরিচিত ।

মার্কস বলাবাহুল্য র‌্যাডিকাল Young Hegelians দের দলেই যোগ দিলেন। হেগেলের কাছে ঈশ্বর ছিল Absolute বা পরম মন। বা যৌক্তিক সত্যের নিরঙ্কুশ সমগ্রতা। বা ধারণাগত যৌক্তিকতা। (দর্শনের ভাষা এমনই হবে, করার কিছুই নেই) হেগেল মনে করতেন যে- ঈশ্বরের অবস্থান মানুষের চেতনায়।

অনত্র নয়। ইতিহাসের গতিপথে ঈশ্বর প্রকাশিত হন সীমিত মানব মনে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানে। T.Z .Livine লিখেছেন, "God exists only as He is revealed, manifested, externalized, and embodied in human consciousness, in finite minds, in social institutions, in the course of history." ( From Socrates to Sartre. page, 264) তরুন হেগেলবাদীরা এই যুক্তিতে হয়ে উঠলেন নিরীশ্বরবাদী। তাদের কথা হল, যে ঈশ্বর কেবলি মানুষের মনে বাস করে যে ঈশ্বরের অস্তিত্বই নেই। মানুষ আছে তো ঈশ্বর আছে।

নৈলে নাই। ক্ষুদ্র মানুষের ওপর নির্ভরশীল সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর। Young Hegelians আরও একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিল। হেগেলের মতে ঈশ্বর বা পরম মনের বিকাশ হয় মানবীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে। সেহেতু মানুষই ঈশ্বর।

মানবসত্ত্বাই প্রকৃত স্বর্গীয়। মানুষই ঈশ্বর। মানুষের পবিত্রতা; তার ঐশ্বিরিক সমমানতা এর আগে ( অন্তত ইউরোপে) অনুভূত হয়নি। কাজেই Young Hegeliansরা বলল, পৃথিবীতে মানুষ বাঁচবে ঈশ্বরের মতন। স্বাধীন।

সর্বশক্তিমান হয়ে। তারা আরও একধাপ এগিয়ে গেল। তারা বলল, পৃথিবীকে মানুষ-ঈশ্বরের বাসযোগ্য করার জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিপ্লবের। Ludwig Feuerbach (1804-72) ছিলেন Young Hegelians পাঠচক্রের এক প্রধান পুরুষ। মানুষই যে ঈশ্বর তা একটি বই লিখে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন।

বইয়ের নাম, The essence of Christianty. সে বইয়ে Feuerbach বললেন: মানুষের সারবস্তুই (essence) খ্রিস্টধর্মে ঈশ্বরে আরেপা করা হয়েছে। অবশ্যই যা ভ্রান্ত। এখন উচিত ঈশ্বরের essence মানুষে প্রযুক্ত করা। Feuerbach আরও বললেন যে, হেগেল আসলে ভাববাদী। কেননা, হেগেলের পরম মন বা Absoluteই হচ্ছে খ্রিষ্টান ঈশ্বরের ধারনা।

হেগেলের মতে Absolute বা পরম হচ্ছে মানুষের ঐতিহাসিক অর্জন। ঈশ্বর সম্বন্ধে হেগেল যা বলেছেন এখন থেকে তা আমাদের ভাবতে হবে মানুষ সম্বন্ধে। ২ তখন বলছিলাম,কার্ল মার্কস বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন ১৮৩৬ সলে। ১৮৩৬ সালে লালনের বয়স কত? প্রায় ৬২। ততদিনে হয়তো-বা লিখে ফেলেছেন- কে কথা কয় রে দেখা দেয় না নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম-ভর মেলে না।

আপন দেহের ভিতর ঈশ্বরকে লালন এভাবেই খুঁজেছেন। বলেছেন, হাতের কাছে হয় না খবর কি দেখতে চাও দিল্লি-লাহোর? প্রখ্যাত লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, “বাউলের সাধনা দেহকেন্দ্রিক। তাই চলতি কথায় বাউলের গানকে দেহতত্ত্বের গানও বলা হয়। এই দেহের মধ্যেই “পরম পুরুষ” “সহজ মানুষ” “রসের মানুষ” “অটল মানুষ” “অধর মানুষ” “ভাবের মানুষ” “মনের মানুষ” “অচিন পাখি” বা “সাঁই নিরঞ্জনের” গুপ্ত-অবস্থিতি। ” (লালন সাঁইয়ের সন্ধানে।

পৃষ্ঠা, ৩৯) আমরা জানি, লালন বিশ্বাস করতেন যে মানুষের দেহের ভিতর ঈশ্বর বাস করেন। আর Young Hegeliansরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, মানুষই ঈশ্বর। পৃথিবীতে মানুষ বাঁচবে ঈশ্বরের মতন। স্বাধীন। সর্বশক্তিমান হয়ে।

আর এর জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিপ্লবের। লালন প্রাজ্ঞ বলেই বিশ্ববিপ্লবের ডাক দেন নাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।