আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুদেরকে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করার হীন চেষ্টা রুখতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে।

মানবতা ............থেকে মানবিকতা.........

শিক্ষা মানে আমাদের প্রজন্মকে শুধু চাকুরির উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য দক্ষতা শেখানো নয়, তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, বরং এর চেয়ে বেশি কিছু। এর মানে হলো প্রত্যেক নতুন প্রজন্মকে ঐ সমস্ত মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে তোলা যেগুলো আমাদের এই মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- দেশপ্রেম, আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, সাহস, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার সক্ষমতা এবং সর্বোপরি এটা বুঝার মানসিকতা যে, এই পৃথিবীতে আমাদের যা আছে এবং যা কিছু অর্জন তার সবই একজন দয়াময় প্রেমাদ স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসে” অতএব, মূল্যবোধ নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। পৃথিবীর সকল ধর্মই এ ব্যাপারে একমত যে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষিত মানুষই প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করে। নীতি ও মূল্যবোধ বিবর্জিত কাজকে সকল ধর্মেই ঘৃণা করা হয়েছে।

ইসলাম এমন এক মানবতার ধর্ম যেখানে নৈতিকতা ও চারিত্রিক উৎকর্ষতাকে উচ্চ স্তরে আসীন করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা বলেছেন, “তোমাদের যার স্বভাব চরিত্র সুন্দর, সে তোমাদের মধ্যে উত্তম” (বোখারী, মুসলিম)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, “সৎস্বভাবের পূর্ণতা আনয়নের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি” (মোয়াত্তা মালেক) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “বিচারের দিন সর্বাপেক্ষা যে ভারী জিনিস মুমিনের পাল্লায় দেয়া হবে তা হলো সুন্দর স্বভাব। নিশ্চয়ই আল্লাহ অশ্লীল ও অমিতব্যয়ীকে ঘৃণা করেন” (তিরমিজি)। অপরদিকে সকল প্রকার সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও বিশৃকôখলার মূলোৎপটনে আল্লাহ বলেন, “আর তোমাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা দিয়ে আখেরাতে আবাস অনুসান কর এবং দুনিয়া হতে তোমার অংশ ভুলে যেও না এবং তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্ট করতে চেও না।

নিশ্চয়ই আল্লাহ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ভালবাসেন না। (সূরা কাসাস, আয়াত ৭৭)। কাজেই মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষা যে একে অপরের পরিপূরক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্ম শিক্ষার আদলেই হোক আর হোক প্রতিটি মানুষের জন্যই দরকার হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া এবং জাগতিক অন্যান্য বিষয়াবলীর উপরে এগুলি প্রধান্য দেয়া। যেমনটি করেছিলেন বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন।

তিনি তার সন্তানকে শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে চিঠি পাঠিয়ে যে শিক্ষাটা কামনা করেন তারও ছিল মূলত মূল্যবোধ পরিপূর্ণ। তিনি তাঁর চিঠিতে বলেন­ মহাশয়, আমার ছেলেকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে প্রেরণ করলাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি। আমার ছেলেকে অবশ্যই শেখাবেন­ সব মানুষই ন্যায়পরায়ণ নয়, সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। তাকেও এও শেখাবেন, প্রত্যেক বদমায়েশের মধ্যেও একজন বীর থাকতে পারে, প্রত্যেক স্বার্থপর রাজনীতিকের মধ্যেও একজন নি:স্বার্থ নেতা থাকে।

তাকে শেখাবেন প্রত্যেক শত্রুর মধ্যেও একজন বু থাকে। আমি জানি এটা শিখতে তার সময় লাগবে। তবুও যদি পারেন তাকে শেখাবেন, পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। এও তাকে শেখাবেন কিভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কিভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে শেখাবেন।

যদি পারেন নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য তাকে শেখাবেন। সে যেন আগেভাগেই এ কথা বুঝতে শেখে, যারা পীড়নকারী তাদেরকে সহজেই কাবু করা যায়। বইয়ের মধ্যে কি রহস্য লুকিয়ে আছে তাও তাকে বুঝতে শেখাবেন। আমার ছেলেকে শেখাবেন, বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্খা থাকে।

এমনকি সবাই যদি সেটাকে ভুলও মনে করে। তাকে শেখাবেন ভদ্রলোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে। কঠোরদের প্রতি কঠোর হতে। আমার ছেলে যেন শক্তি পায় হুযুগে মাতাল জনতার পদাঙ্ক অনুসরণ না করার, সে যেন সবার কথা শোনে এবং তা সত্যের পর্দায় ছেঁকে যেন ভালটাই শুধু গ্রহণ করে- এ শিক্ষাও তাকে দিবেন। সে যেন শেখে, দু:খের মধ্যে কীভাবে হাসতে হয়, আবার কান্নার মধ্যে যে লজ্জা নেই- এ কথা তাকে বুঝতে শেখাবেন।

যার নির্দয়, মির্মম তাদেরকে সে যেন ঘৃণা করেেত শেখে আর অতিরিক্ত আরাম আয়েশ থেকে যেন সাবধান থাকে। আমার ছেলের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না। কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন তার সাহসী হওয়ার ধৈর্য। তাকে এ শিক্ষাও দিবেন- নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্খা থাকে, আর তখনই তার আস্খা থাকবে মানবজাতির প্রতি।

ইতি আপনার বিশ্বস্ত আব্রাহাম লিঙ্কন। বিখ্যাত পণ্ডিত লোকমান হেকিম তার ছেলেকে এই বলে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, “বেটা, জ্ঞানীদের মজলিসে বেশি বেশি বস এবং বিজ্ঞ লোকদের কথা গুরুত্বসহকারে শোন, কারণ আল্লাহ তায়ালা প্রজ্ঞার আলো দ্বারা মৃত অন্তরকে এভাবে সঞ্জীবিত করেন, যেমন শুষ্ক জমিন প্রবল বৃষ্টি দ্বারা সুষমামণ্ডিত হয়। এবার কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, নিকৃষ্ট লোক কে? তিনি উত্তরে বলেন, যে এ কথার পরওয়া করে না যে, কোন ব্যক্তি তাকে খারাপ কাজ করতে দেখে ফেলবে। এগুলোই হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চা যা শুধু আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না বরং আমাদের পরিবার, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে বয়সের ভিত্তিতে একাডেমিক কারিকুলামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। বাংলাদেশ সংবিধানেও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় মদ ও অন্যান্য মাদক পানীয়, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যবস্খা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে ১৮(১)(২)।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এই নৈতিকতা শিক্ষার অন্যতম একটি মাধ্যম মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রক আজ হুমিকর মুখে। যে শিক্ষার মাধ্যমে এ দেশের হাজার হাজার শিশুকে প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ধর্মীয় আচার-আচরণ শেখানো হয় তাকে নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে এতদসংক্রান্ত বাজেট পরিকল্পনা কমিশনে আটকে রাখা হয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ এটা কী উদ্দেশ্যে করছে তা জনগণের কাছে পরিষ্কার করেনি, তবে এটুকু বলা যায় যে, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে পরিচালিতি অন্যতম একটি সফল কার্যক্রম। আইনি বা কাগজপত্র সংক্রান্ত কোন জটিলতা থাকলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে নিরসন করা যায়। এছাড়া অন্য কোনরূপ সমস্যা পরিলক্ষিত হলে তা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ নিতে হবে এবং সার্বিক মান বিবেচনায় যুযোপযোগী করার জন্য দরকার হলে শিক্ষকের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্খা করতে হবে।

তথাপি এ ধরনের একটি সফল এবং রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য হিতকর কার্যক্রমকে ব করে রাখা কোনক্রমেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। বিশ্বের কোথাও বোধ হয় এরূপ নজীর নেই যেখানে ধর্ম ও নৈতিকতার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে জনগণকে প্রকৃত জনসম্পদে পরিণত করার এরূপ প্রতিষ্ঠানকে ব করে দেয়া হয়েছে। কারণ একজন মানুষের সুপ্ত মনোবৃত্তিগুলো বিকাশের পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখে তার বাল্যকালের শিক্ষা। ওই সময়ে সে তার কাছের প্রিয় মানুষদেরকে যা করতে দেখে বলতে দেখে সেগুলোই তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং পরবর্তী জীবনে তার কাজেকর্মে এই প্রতিফলন ঘটে। তাই একজন শিশুর বিকাশের এই প্রারম্ভিক মুহূর্তগুলোতে তার চারপাশের পরিবেশকে এমন রাখা চাই যা তাকে নৈতিকতা ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে তার মা-বাবা তথা পরিবার, কারণ মা-বাবাকেই সে সর্বাধিক ভালবাসে। দ্বিতীয় ভূমিকা রাখে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকগণ। আর মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষকগণ যেহেতু সংশ্লিষ্ট মসজিদের ইমাম হন এবং শিক্ষায়তনটিও হয় সেই মসজিদ, সেখানে একটি শিশু একদিকে যেমন নৈতিকতা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত একজন ইমামের কাছ থেকে তার প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের আবশ্যকীয় বিষয়াবলী জানে তদ্রুপ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে সমসাময়িক অবস্খার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাই এরূপ একটি জনহিতকর ও নৈতিক আদর্শভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমকে ব না করে বরং কিভাবে আরো গতিশীল ও যুগোপযোগী করা যায় সে ব্যাপারে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে অনতিবিলম্বে একে চালু করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।