আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পেন্সিল আর কলমের কথা

... ... ... ...

হাতে-খড়ি বলে একটা অনুষ্ঠান নাকি প্রচলিত আছে। আমার যে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেটা হয়নি তা জানি, আর আমি কখনো কারো হাতে-খড়ি হতেও দেখিনি। তাই জিনিষটা কেমন তা দেখার খুব ইচ্ছে আছে। হাতে-খড়ি না হলেও প্রথম পেন্সিল ঘুরানোর সময় যে আমার হাতকে ঘিরে মায়ের হাত ছিল তা নিশ্চিত। যে বয়স থেকে মনে করতে পারি, সে বয়সের স্মৃতি বলে-- ক্যাটক্যাটে হলুদ কিংবা একটু কমলা কমলা ধরণের একটা পেন্সিল আমার প্রথম পেন্সিল ছিল।

নাম উটপেন্সিল। ক্যামেল মার্কা ছিল বোধহয়, খেয়াল করার বয়স ছিল না। মেঝের উপরে বসে সামনে একটা চকি নিয়ে সেটার উপরে রুল-টানা খাতায় উটপেন্সিল দিয়ে স্বরে-অ স্বরে-আ লেখতাম। পাশেই বড় বোন যখন কলম দিয়ে লেখতো...কি যে হিংসা হতো! হাতের লেখা যাতে খারাপ না হয় তাই নাকি পেন্সিল দিয়েই ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখতে হবে। বড় গোটা গোটা হরফে রুলটানা খাতায় পেন্সিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বর্ণমালার চর্চা করে দিন গণা ছাড়া তাই আর কোনো উপায় ছিল না।

উপায় যে একেবারেই ছিল না... তা না। বোনের অজান্তেই মাঝে মাঝে তার কলম নিয়ে পুরান পেপারের উপর ইচ্ছে মতো সাহিত্য চর্চা করতাম। তেলাপোকারাই মনে হয় সেই সাহিত্যের একমাত্র সমঝদার ছিল। সে সময়ের কলম ছিল ইকোনো ডিএক্স। পেন্সিলে লেখার বয়সে সে কলমটা ছুঁতে পারলেও কি যে ভালো লাগতো!! পেন্সিলও যে আমার ভালো লাগত না তা না...উটপেন্সিল বাদে সব পেন্সিলই ভালো লাগতো।

আমার বন্ধু কিংবা ক্লাসের অন্য ছেলে-মেয়েদের হাতে মাঝে মাঝে উটপেন্সিল বাদে অন্যরকম পেন্সিল দেখা যেত। আমিও কিছু কিছু পেন্সিলের প্রথম দেখাতেই লোভে পড়ে যেতাম। এরকম কিছু পেন্সিলের কথা বলি। আমাদের ক্লাসেরই এক মেয়ের ছিল একটা লালচে রঙের পেন্সিল। গায়ে মাছ-টাছ আঁকা ছিল।

সেই আঁকা আমাকে আকর্ষণ করেনি। যেটা করেছিল তা হল পেন্সিলের মাথায় মাছের আকৃতির ইরেজার। কারো কাছে দেখা যেত ১০টা শিষের পেন্সিল। পেন্সিলের পিছন দিয়ে একটার পর একটা ঢুকিয়ে ব্যবহার করতে হতো। শার্প করার কোনো ঝামেলা ছিল না।

প্রথম দেখায় এসব পেন্সিলের লোভে পড়ে যেতাম...তবে লোভে পড়লেও উপায় ছিল না। মাঝে মাঝে অবশ্য আমাকেও কিনে দেয়া হতো কিছু সুন্দর পেন্সিল...কাঠের গায়ে বিভিন্ন ছবি আঁকা পেন্সিল, কিংবা অন্যরকম রঙের পেন্সিল। আর একবার আমি উপহার পেয়েছিলাম কাঠের গায়ে খুব সুন্দর ডিজাইনে খোদাই করা পেন্সিল। এতোই ভালো লেগেছিল যে পেন্সিলটা সাজিয়েই রেখে দিলাম। আর ব্যবহার করাই হলো না।

কখন যে হারিয়ে গেলো তাও বুঝিনি। আজকের যুগের লীড পেন্সিল অবশ্য সেসময় দেখিনি। অনেক অনেক পরে লীড পেন্সিল ব্যবহারে সৌভাগ্য হয়েছিল। পেন্সিলে লেখার বয়স একসময় শেষ হলো। কলমে লেখা ধরলাম।

তখন বোনকে মাঝে মাঝে আমার নতুন কলম দেখিয়ে হিংসায় জ্বালিয়ে মারতাম। ইকোনোর সাদা কিংবা নীল রঙ্গা কলমগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে ঝগড়াও হতো। সে সময় আশে-পাশের সবার হাতেই এই কলম ঘুরতো... কিছু বন্ধুদের সংগ্রহে থাকতো অন্যরকম কিছু কলম। যেমন রেডলীফ। ওই কলমের শীষের মধ্যে তুলা ভরা থাকতো যাতে কালি গড়িয়ে না পড়ে।

আরো এক ধরণের কলম ছিলো টিপ-কলম। টিপ দিলে শীষ বের হতো, টিপ দিলে বন্ধ হতো। আমিও এরকম কিছু কলম ব্যবহার করেছি। তিন চার কালির টিপ-কলমও আমাদের সময়ে ক্রেজ ছিল। আরো ছিলো কালি কলম।

আদিম যুগের কলম, হয়তো আমাদেরই বাবা মা ওই কলম ছেড়ে বলপেনে লেখতে চাইতো। আর আমাদের যুগে আমরা বলপেন ছেড়ে ফাউন্টেন পেনের দিকে প্রেমনয়নে তাকাতাম। পাইলট কলম ছিল বাবার ব্যবহার করা কলমগুলোর মধ্যে আমার অন্যতম প্রিয় কলম। শুধু যদি আমার প্রিয় হত তাহলে তো হতোই...আমার বোনেরও প্রিয় ছিল। তাই বাবা বাসায় ওই কলম আনলে আমাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।

বাবা বাসায় আসলেই আমি আর বোন বাবার পকেটের দিকে নজর দিতাম...যদি কোনো নতুন কলম দেখা যায়...কে আগে দখল করবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা আর কি! নজরকাড়া আরো কিছু কলম ছিল সেসময়। স্মৃতিশক্তি ভালো না দেখে মনে পড়ছে না। কৈশোরে আসতেই কলমের অন্য ব্যবহার শিখলাম। স্কুলের কাঠের বেঞ্চে বসে যখন পেনফাইট খেলা শিখলাম, তখন কলমের শখ আরো চাগিয়ে উঠলো। সেসময় ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি।

কলম নিজে কেনার মতো স্বাধীনতা পেয়েছি। কিনতে যেতাম গ্রিপারওয়ালা কলম। লেখতে আরাম। ঢালু বেঞ্চের ঢাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ে না পেন ফাইটের সময়। কলমযুদ্ধের এই হাতিয়ার নিয়ে আমাদের যতো মাথাব্যাথা।

কেউ হয়তো নতুন কলম কিনেছে জাম্বো সাইজের, গ্রিপ দারুণ...ওর সাথে কলম যুদ্ধে পারা যাচ্ছে না। অন্যসব যোদ্ধাদের কি দুঃশ্চিন্তা! স্কুল জীবন পুরাটাই পার হয়ে গেলো কলম যুদ্ধের হিসাব কষে। শুধু কলমের যে আসল ব্যবহার সেটাই আয়ত্তের বাইরে রয়ে গেল। এরপর আর কলম কিংবা পেন্সিল নিয়ে ভাববার অবসর হয়নি। এখন তো প্রযুক্তির এ যুগে হাতে লেখতেই কষ্ট লাগে।

তার চাইতে টাইপ করতে বেশি আরাম। কমসে কম কেউ এটা তো বুঝবে না যে আমার হাতের লেখা তেলাপোকার নাচন-কুর্দনের সমগোত্রীয় কিছু একটা! সত্যি বলতে কি, একসময় সাহিত্য চর্চার ইচ্ছে জেগেছিল...কিন্তু নিজের হাতের লেখা দেখে নিজেই সাহিত্য ভুলে ডাইরীটা চিরজীবনের জন্যে বন্ধ করেছিলাম। এখানে ব্লগে লিখে মজা পাই...আমার হাতের লেখা কত্তো সুন্দর দেখায়!! পেন্সিলে লেখার একটা বয়সে কলম ছোঁয়ার কি আপ্রাণ স্বপ্ন ছিল আমার...কলমে লেখার এই বয়সে এসে সেই আমি কলম ছেড়ে আবার পেন্সিলে ফিরে গেলাম...কেন জানি না পেন্সিলে লিখতে ভালো লাগতে লাগলো। হয়তো ভুল শুধরে নেবার সুযোগ আছে বলে...কিংবা হয়তো ভাঙ্গা পেন্সিল হতে চাই বলে! (সবার লেখা দেখে স্মৃতিকথা লেখতে ইচ্ছে হলো, সমস্যা হলো স্মৃতিগুলো এতো আউলা-ঝাউলা! কিছুতেই গুছাতে পারলাম না। কানে ধরছি, আর লেখবো না।

)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।