আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নোম্যান্স ল্যান্ড!

সফল ব্লগার নয়, সত্যবাদী ব্লগার হওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য।
আমার জন্ম প্রায় বর্ডারেই বলতে পারেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বর্ডার আমাদের কাছে ডাল-ভাত। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মাণ দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।

প্রায় সারা বছরই কোন কাজ থাকে না। কৃষি জমি এখানে যা আছে তা অল্প কয়েকটি পরিবারের দখলে। বেশীর ভাগ মানুষই ভূমিহীন। ভূমিহীন এ মানুষগুলোর জন্য তাই বর্ডার ছাড়া কোন গতি নাই। এই বর্ডার কেড়ে নিয়েছে কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী আবার কারো সন্তানকে।

মাত্র ২০০-৮০০ টাকার জন্য এরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ডার পার হয়। আর তাদের এই কাজে ঠেলে দেয় সামান্য কিছু মানুষরূপী পশু যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। আর এই চোরাচালানের অর্থের মূল অংশটুকুই যায় স্থানীয় নেতা, বিজিবি, পুলিশ আর প্রশাসনের পকেটে। বর্ডার আর নিরীহ এই মানুষগুলোকে ব্যবহার করে এই সব নরকের কীটগুলো দিন দিন ফুলে ফেঁপে বড়লোক হয়েছে, কিন্তু সেই নিরীহ মানুষ গুলো এখনো অর্ধাহারে অনাহারে কোন মতে বেঁচে আছে! আমি ৮/৯ বছরের বাচ্চা ছেলে-মেয়েদেরকেও দেখেছি চিনির বস্তা মাথায় নিয়ে ভীত খরগোশের মত দৌড়াতে। আবার ৭০/৮০ বছরের বৃদ্ধরাও যায়।

এদের পেটে ভাত নাই, ঘরের চাল নাই। রোগ-বালাই সারাক্ষণ লেগেই আছে। একটি ঘটনা বলি, তখন ১৯৯৯ সাল, গ্রামের বাড়ি, প্রত্যন্ত বর্ডার এলাকা। বর্ডারের ধার ঘেষেই আমাদের কিছু ধানের জমি আছে। আমাদের রাখালরা গরু নিয়ে সেই বর্ডারে যায়।

কৃষকেরা চাষাবাদ করে। আবার এই বর্ডার দিয়েই অবৈধ অস্ত্র, মাদক, গরু, শাড়ি ইত্যাদি পাচার হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তারাই নিয়ন্ত্রণ করে বর্ডারের এই অবৈধ ব্যবসা। তবে যে দিনের ঘটনা বলছি সেদিন সকালে আমি রাখালদের সাথে গরু নিয়ে গেছিলাম বর্ডারে। সেখান আমাদের গ্রামেরই মন্টু নামের এক কৃষক আর তার ভাই নিজের জমিতে হাল চাষ করছিলো।

দুপুর হলে তারা সঙ্গে নিয়ে আসা রুটি আর ভাজি দিয়ে খাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ হালের মহিষ দুটো ঘাস খেতে থেতে বর্ডার পার হয়ে প্রায় ৩০০ গজ ভিতরে চলে গেলো। এ ঘটনা দেখে সবার তো মাথায় হাত! এখন কি হবে! কিন্তু দরিদ্র্য মন্টু চাচা তার একমাত্র সম্বল হালের মহিষ দুটো ফিরিয়ে আনার জন্য বর্ডারের অপার যেতে চাইলো। সবাই অনেক বোঝালেও সে তার সিদ্ধান্তে অনড়, শেষে তার ভাইও তার সাথে যাবে বলে ঠিক করলো! ওপারে ভারতের সিঙ্গাবাদ বর্ডার, বিএসএফ এর ক্যাম্প আছে। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র আর গাড়ি নিয়ে দুর্বল ট্রেইনিং প্রাপ্ত নির্বোধ বিএসএফরা সব সময় টহল দেয়।

মন্টু চাচা আর তার ভাই মহিষ আনার জন্য ওপারে গেল। মহিষ দুটো ধরে তারা যখন ফিরতি পথ ধরলো তখনই ঘটলো বিপত্তি! টহলরত দুজন বিএসএফ সদস্য তাদের পথ আটকালো। তারা দাবি করলো যে মহিষ দুটো নাকি চুরি করা। মন্টু চাচা যতই বোঝায় যে মহিষ দুটো তার, বেখেয়ালে এপারে চলে এসেছে তারা ততই বোঝে না! এক পর্যায়ে কোন রকম উষ্কানি ছাড়াই একজন বিএসএফ সদস্য তার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করতে গেলো! মন্টু চাচা তখন সেই বিএসএফটিকে ঝাপটে ধরে কাদায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো আর তার ভাইকে চিৎকার করে পালিয়ে যেতে বললো। মন্টু চাচার ভাই ভয়ে নড়তে পারছিলো না।

অপর বিএসএফটি বন্দুক তাক করে গুলি করার সুযোগ খুজতে লাগলো, একপর্যায়ে মন্টু চাচাকে লাথি মেরে দুরে সরিয়ে তারা দুজন মিলে নির্মম ভাবে বুকে ও পেটে গুলি করে মারলো। মন্টু চাচার ভাইকেও তারা বুকের ওপর পা তুলে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে মাথায় গুলি করে মারলো। আর এ সবই ঘটলো আমাদের চোখের সামনে! পাখির মতো গুলি করে মারা হলো বাংলার দুই নিরীহ দরিদ্র কৃষককে। দুই ভাইকে মারার পর তারা আমাদের দিকেও গুলি ছোড়া শুরু করলো। আমরা কোন মতে গরুর আড়াল নিয়ে দুরে সরে গেলাম।

এর মধ্যে একজন বিডিআর(বর্তমান বিজিবি) ক্যাম্পে খবর দিলো। কিন্তু সেখান থেকে বিডিআর আসতে আসতে বিকাল হয়ে গেল। মন্টু চাচা আর তার ভাইয়ের লাশ পড়ে রইলো নোম্যান্স ল্যান্ডে! এর পরের কাহিনী বিশেষ কিছু না, বিডিআর-বিএসএফ এর ফ্ল্যাগ মিটিং, বিডিআরের প্রতিবাদ, আর পুলিশের পোস্ট মর্টেম। ঘটনা এটুকু মনে হলেও আসলেই কি তাই? মন্টু চাচা আর তার ভাইয়ের উপর নির্ভর করে তাদের দুজনের সংসার, ছেলে-মেয়ে এবং বৃদ্ধ বাবা-মা বেঁচে ছিলো। কিন্তু তারা দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের কে পথে নামতে হয়।

বাচ্চা গুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। কাজের ব্যস্ততা আর শহরকেন্দ্রিক জীবনের কারণে বহুদিন তাদের খোঁজ নেওয়া হয় না। জানি না এই ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কেমন আছে তারা....! আর এরকম একটি নয়, শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে বর্ডারে! এই ঘটনা গুলোর বিচার তো দুরের কথা অনেক সময় লাশও পায় না হতভাগা পরিবার গুলো। উপরের ঘটনাটি যে সময় ঘটেছে তখন মিডিয়া-টিভি বর্তমান সময়ের মতো ছিলো না। ব্লগ-ফেইসবুক তো বহু দূরের কথা! আর সেই অজো পাড়া গাঁয়ে যেয়ে রিপোর্ট করার মতো সাংবাদিকও ছিলো না।

সেসময় পত্রিকার ভেতরের পাতায় মাত্র কয়েকটি লাইনে ঠাঁই পেয়েছিলো এই ঘটনাটি। কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষ গুলোর জীবনে তা এক অভিশাপ হিসাবে আবর্তিত হয়েছে। উপরের এই ঘটনাটি ছাড়াও প্রায়ই বিএসএফের প্রহরায় বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়ার ডাকাত-সন্ত্রাসীরা এপারে এসে ডাকাতি করে, গরু ছাগল নিয়ে যায়, ঘর জ্বালিয়ে দেয়, নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় আরো কত কি! সে গুলো বলতে গেলে আরো অনেক পোস্ট লিখতে হবে। বর্তমানে অনলাইনে চলছে ইস্যু কালচার। সবাই ঘুম থেকে উঠে অনলাইনে ঢুঁ মেরে জেনে নেয় আজকের ইস্যু কি?? তারপর শুরু হয় পোস্ট, স্ট্যাটাস, কমেন্ট, লাইক আর শেয়ারের বন্যা! সাথে তর্ক বিতর্ক, একে অপরকে দোষারোপ, গালাগালী, নোংরামী, মিথ্যাচার পুরাই ফ্রি! তো এই ইস্যু কালচারটা আমি আবার ঠিক মতো রপ্ত করতে পারিনি।

তারপরও মাঝে মাঝে গুরুজনদের দেখে দু'চার লাইন লিখে ফেলি আরকি। তবে আজকে নতুন কিছু লিখিনি। জানুয়ারী মাসের বর্ডার হত্যাকান্ড নিয়ে লেখা একটি পোস্টকে কেটে-ছেঁটে আবার দিলাম। তো ভাই লোগ, গত জানুয়ারীতে যে ইস্যু নিয়া সরগরম ছিলেন গত আট মাসে কিন্তু সেটা নিয়া সিরকুম কুনো কথা-বার্তা কৈতে দেখলাম না কাউরে! ঘটনা আট মাস আগেও যা ছিলো তাই আছে। মন্টুরা মরতিসে, ফেলানীরা ঝুলতিসে! মাঝখান থাইকা আমরা হুদাই প‌্যাচাল পাড়তিসি! ফেলানীর বিচার শুরু হইলো, খুব লাফাইলাম! শাবাশ সরকার! শাবাশ মানবাধিকার! এই না হইলে আইনের শাসন! আরো কত কি বড় বড় লেকচার! এখন আবার অমিয় ঘোষরে নির্দুষ কৈসে আবার লেকচার শুরু! এই সরকার চ্রম খ্রাপ! এই সরকারে উমুক নীতি খারাপ-তুমুক নীতি খারাপ! হুর মিঞা থামেন! ইন্ডিয়ান গান না শুনলে আপনার ঘুম আসে না, হিন্দি না জানলে আপনার সম্মান থাকে না, একটা সিরিয়াল মিস হইলে আপনি চিক্কুর পাইড়া কান্দেন, আইপিএলে জুয়ার বোর্ডে টাকা দিতে মিস হয় না, বলিউডি পোশাক না কিনলে ঈদ-পূজা হয় না, ইন্ডিয়ান ১৫০ সিসির বাইক না থাকলে স্টাইল হয় না, বিড়ির পুটকি ডন সিনেমার শাহরুখ খানের মতো ফিকা না মারলে আপনার ভাব আসে না, কানের হেডফোনে বাজে ক্যাটরিনার জারা জারা টাচ মি টাচ মি টাচ মি, ইন্ডিয়ান বলদ না হইলে আপনার কুরবানী হয় না, কারো কারো তো আবার ইন্ডিয়ান ডাইল ছাড়া পিনিকই আসে না! তাইলে হুদাই এত চিল্লাচিল্লি কিসের? আবার কিছুদিন পর নতুন আরেকটা ইস্যু আসবে।

নতুন নতুন পোস্ট/স্ট্যাটাস হবে, আবার সেই নোংরামী, আবার গালাগালী, আবার একে অপরকে দোষারোপ এবং আবারো একটি নতুন ইস্যুর জন্য অপেক্ষা। আর এত কিছুর মধ্যে ফেলানীর মতো ঝুলতে থাকবে ফেলানীর বিচার, মন্টুরা মরতে থাকবে হালের মহিষের জন্য, মানুষ ছুটতে থাকবে দু'মুঠো ভাতের আশায়, নোম্যান্স ল্যান্ডে। এই বিষয়ে আর কোন কথা বলবো না। বাস্তবে কারো কিছু করার ইচ্ছা থাকলে জানায়েন....। অ. ট. যাদের অন্তরে পাকি প্রেম টগবগ করে ফুটছে তারা অতি উৎসাহী হয়ে কমেন্ট করে বসবেন না যেন! একটুখানি অসাবধানতা আপনার পুটুতে আরো দু'চারটা এক্সট্রা ফুটার কারন হয়ে যেতে পারে!
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।