হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই
সময়টা তখন ছিল খুব খারাপ। সবে মাত্র দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। ১৯৯১ সাল।
ঢাবিতে ভর্তি হয়েছি। জিয়া হলে অ্যাটাচড। কিন্তু সে সময় হলে সিট পেতে হলে বড় ভাইদের (মায়ের পেটের আপন বড় ভাই না কিন্তু) আশীর্বাদ বাধ্যতামূলক ছিল। আমার বাড়ী বরিশাল। আমার বন্ধু জুয়েল এর বড় ভাই সোহেল ভাই তখন মুজিব হলে থাকত।
জুয়েল কে নিয়ে ওনাকে ধরলাম। ছোট ভাইয়ের বন্ধু হিসাবে আমাকে হলে থাকার সুযোগ করে দিলেন। সেটা মুজিব হলের ৫০১/ক। জানি না এখন ও ওই রুম আছে কিনা। ওটাকে আমরা বলতাম গনরুম।
মানে ৮ বেডের রুম। কিন্ত্ থাকত ১৬ জনের ও বেশী। ভাল কথা আমরাই সায়েন্স ফ্যাকাল টির লাষ্ট ব্যাচ যারা আর্টস ফ্যাকাল্টির হলে অ্যাটাচড ছিলাম।
মাস খানেক ও লাগল না যেতে ওয়ান ফাইন মর্নিং মুজিব হলের পিছনে ধাম ধাম গুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক গড়ান দিয়ে তখন মেজেতে নেমে গেছি কারন অন্যরাও ততক্ষনে মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছিল।
দশ মিনিট গোলাগুলির শেষে ফলাফল ইলিয়াস গ্রুপের মাহমুদ আর স্বপন মৃত। সেই প্রথম জীবনে ক্যাম্পাসে গুলি আর লাশের অভিজ্ঞতা।
তখনকার ছাত্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু বলে নেই, অভি গ্রুপ ডাঃ মিলন হত্যাকান্ডের জন্য বি এন পি অধ্যুষিত হলগুলো থেকে বিতাড়িত সব যেয়ে জগন্নাথ হলে উঠছে। ছাত্রদল আধ্যুষিত হলগুলো তখন এক কভাবে ইলিয়াস গ্রুপের দখলে। শোনা গেল অভি গ্রুপ নাকি হল অ্যাটাক করে মুজিব হলের পেছনের দেয়াল টপকে বের হয়ে যাচ্ছিল।
এই সময় ইলিয়াস গ্রুপের ক্যাডাররা তাদের ধাওয়া করে, হলের পেছনের দেয়াল টপকাতে যেয়ে ওপারে আজিজ মার্কেটে অভি গ্রুপের পালটা গুলির শিকার হয়ে মারা যায়। মাহমুদ আর স্বপন ছিল আমাদের ব্যচমেট। খুব অল্প সময়ে ভাল সাহসী হিসাবে ইলিযাস গ্রুপে নাম করেছিল।
ওই সময় অভি গ্রুপের যাদের নাম খুব শুনতাম শিশির, সজল, গুড্ডু, কাজল, ক্যাপ সোহেল আরো অনেকে। স্মৃতির ভারে নাম গুলো এখন বিস্মৃত প্রায়।
এর কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের ব্যাচের খালেদ, রুনু, ডগ শিশির, মিলন, তাপস, পাভেলের মোটামুটি অস্ত্র নাড়াচাড়া করতে শুরু করছে টোকাই জাকিরের নেতৃত্বে এই গ্রুপটাকে বলা হত জুনিয়ার গ্রুপ বা জাকির গ্রুপ। ইতিমধ্যে ই লিয়াস গ্রুপের মধ্যে নেতৃত্বর দ্বন্দ আবার শুরু হয়ে গেছে। ইলিয়াসের সাথে তখন ঠান্ডা লড়াই চলত রতনের। ইলিয়াস গ্রুপের মধ্য তখন নাম করা সিনিয়র অস্ত্রবাজ ছিল জিন্নাহ, বুষ্টার মানিক, ওয়েষ্টার্ন মানিক, নুরু, ফ্রিডম সোহেল, বরিশালের তুহিন, ন্যাটা বাবু।
এদিকে তখন জাকিরের নেতৃত্বে জুনিয়ার গ্রুপ সিনিয়রদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিল না।
ব্যাপারটা সিনিয়রদের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়াল। জুনিয়র গ্রুপকে শিক্ষা দেবার জন্য এক দিন পাভেলকে মহসিন হলে সিনিয়র গ্রুপ দরজা আটকিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ওই সময় ব্যাপারটা খুব অলোচিত হয়েছিল, এতে ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সিনিয়রদের রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটা নড়বড়ে হয়ে যায়।
সূর্যসেন হলের সেক্রেটারী জিন্নাহ তখন অনেকটা সুবিধজনক অবস্থানে ছিল, সে নিজের একটা গ্রুপ তৈরী করার প্রস্তুতি নেয় রতনের সাথে মিলে।
ব্যাপারটা ইলিয়াস আলীর পছন্দ হয় না। আবার যুদ্ব। মারা যায় জিন্নাহ। ইলিয়াস গ্রুপ হয় ক্যাম্পাস থেকে বহিস্কৃত। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল জাকির।
ক্যাম্পাসে তখন ইলিয়াস গ্রুপ নেই, রতন গ্রুপের সিনিয়রা বহিস্কৃত। সমস্ত জুনিয়রদের নিয়ে জাকির ক্যাম্পাসে এক ছত্র আধিপত্য কায়েম করে।
জাকির গ্রুপের ক্যাডাররা সরাসরি অস্ত্র হাতে নিল। ইতিমধ্যে খালেদ, রুনু, ডগ শিশির, মিলন, তাপসদের সাথে সুজন, নান্না, আসাদ, পালাশ, আরিফ এর যোগ দেয়। জাকির গ্রুপের হাতে চলে আসে ঢাবি র তৎকালীন ১৪টা হল।
এরাই আমার জানা মতে শেষ বাহিনী যারা মুজিব হল থেকে এফ এইচ হল পর্যন্ত পুরো ক্যাম্পাস দখলে রাখছিল।
এদের প্রায় সবার সাথে আমার ভাল সম্প র্ক থাকার কারনে খুব কাছ থেকে তাদের ব্যাবহৃত কিছু অস্ত্র দেখার সৌভাগ্য(!) হয়েছিল। কাটা রাইফেল, ৭.৬২ পিস্তল, .৩৮ রিভলবার, শটগান, কিছু সময়ের জন্য একটা স্টেন গান ও দেখছিলাম। মাঝে মাঝে দেখতাম কোথা থেকে যেন এক টা G-3 রাইফেল আসত।
প্রতিটা হলে গেটে অবধারিত পাহারা থাকত জুনিয়র ক্যাডারদের সহায়তায়।
সিনিয়ররা মাঝে মাঝে প্রহরা চেক করে যেত। যুদ্ব কালীন পরিস্থিতিতে হলের ছাদেও পাহাড়া হত। যেকোন অপরিচিতকে গেটে ক্যাডার দের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত। পান থেকে চুন খসলেই সিনিয়রদের জেরা। প্রায় আর্মি কমান্ড চলত।
জুনিয়ররা সিনিয়দের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। সিগারেট তো অসম্ভব সিনিয়রদের সামনে। হল ক্যান্টিন থেকে ফ্রি খাবার আসত।
১৯৯৩ সালে একবার ছাত্রলীগ শক্তি সঞ্চয় করে ডাস দখলের চিন্তা করে ওই সময় দেখছিলাম এক রাত্রে ১৭ টা অবৈধ অস্ত্র। তার আগের দিন জাকিরকে লক্ষ্য করে ডাসে গুলি করা হয়।
কিন্তু ভাগ্যবশত জাকির বেচে যায় হলে এক সাথে এত অবৈধ অস্ত্র আমি একসাথে জীবনে দেখিনি। মাজে মাজে জুনিয়রদের দিয়ে গুলি ফুটিয়ে অস্ত্রের কার্যকারিতা পরখ করত। জাকির এক পর্যায়ে রতনের নেতৃত্ব অস্বীকার করে সরাসরি তৎকালীন এক কেন্দ্রীয় নেতার নেতৃত্বে চলে যায়। নাখোশ হয় রতন।
এদিকে ন্যাটা বাবুর নেতৃত্বে রতন গ্রুপ আবার ক্যাম্পসে আস্তে আস্তে প্রবেশ করে।
ওদিকে দেশের রাজ নৈতিক পট পরিবর্তনের সময় চলে। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।