আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার দেখা থাইল্যান্ড (শেষ পর্ব)


কেনাকাটা হুমায়ুন আহমেদের কোন এক ভ্রমণ গল্পে পড়েছিলাম, একবার নাটকের শুটিং-এ তার দলবল নিয়ে থাইল্যান্ডে গেছেন। ওখানকার সাবানগুলো দেখে সবাই এতটাই মুগ্ধ যে যার কাছে যত বাথ ছিল সব বাথ দিয়ে শুধু সাবানই কিনে ব্যাগ ভর্তি করেছে। স্বভাবতই আমি থাইল্যান্ডে যেয়ে সেই সাবানগুলো খুঁজতে থাকি। আমাকে খুববেশি কষ্ট করতে হয়নি। স্ট্রীটসপগুলোতেই মনোহর সাবানের দেখা মেলে।

এগুলো স্থানীয়দের হাতে তৈরি সাবান। লাল,নীল, হলুদ নানা রঙের তারকাকৃত, ত্রিভুজাকৃতি, চতুর্ভুজাকৃত নানা আকারে নানা সুবাসের সাবান পাওয়া যায়। প্রথম দেখায় সাবানকে সাবান মনে হয় না। দেখে মনে হবে মোমের শোপিস অথবা চকলেট। সুপারশপ গুলো থেকে ফুটপাতের দোকানের সাবানগুলোর তুলনামূলক দাম কম।

বলাবাহুল্য, আমিও ব্যাগভর্তি সাবান কিনেছিলাম। আরেকটা কারণ স্যুভেনিয়র পণ্য হিসেবে সাবানগুলো সস্তা। আর কিনেছিলাম চকলেট। রকমারী ক্যান্ডি এখানে সুলভ মূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। থাইল্যান্ডে যাওয়ার সময় সবাই পরামর্শ দিয়েছিল, যা কেনার ব্যাংকক থেকেই কিনতে।

এখানে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। তাই কেনাকাটা ব্যাংকক থেকে করবো ঠিক করে দুইদিন পাতায়ায় মনের আনন্দে ঘুরেছি। ডলারগুলোও বাথে কনভার্ট করেনি। পাতায়া ঘুরে ব্যাংককে এসে আবিস্কার করলাম ব্যাংককে পাতায়া থেকে ডলার প্রতি প্রায় ১ বাথ কম। যেহেতু উপায় নেই, তাই কিঞ্চিত ঘাটতি দিয়েই বাকি ডলারগুলো বাথে কনভার্ট করে নিলাম।

এখন কেনাকাটার পালা। পকেট থেকে লিষ্ট বের করে ভিমড়ি খাবার যোগাড়। ফেরার প্লেনে উঠার সময় হয়ে গেল অথচ লিষ্টের কিছুই কেনা হয়নি। সাফারি ওয়ার্ল্ড ভ্রমণ শেষে আমরা যখন প‌্যান্টিপ প্লাজার সামনে নামিয়ে দিল তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। ব্যাংককের দিন আর রাতের জীবনযাত্রা দিন-রাতের মতোই আলাদা।

সন্ধ্যা নামতে নামতেই অফিস-আদালত, বড় বড় শপিং মলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রাতযত বাড়তে থাকে বারগুলোর দরজায় লোভনীয় বিজ্ঞাপনেন নিয়নআলো আরও বেশি প্রসারিত হয়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বারবণিতাদের ভিড় বাড়তে থাকে, শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ফুটপাত ভ্রাম্যমান/অস্থায়ী দোকানগুলোর দখলে চলে যায়। আমি যখন শপিং কমপ্লেক্সে প্রবেশ করলাম তখন দোকানগুলো বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করলো। বাধ্য হয়ে সামনে যা পছন্দ তাই হুড়মুড় করে কিনতে লাগলাম।

ফুটপাত থেকেও কিছু জিনিস কিনেছিলাম। এদের ফুটপাতের পণ্যের মান খারাপ না। পুরানো ফ্যাশানের পোশাকগুলো পাইকারীতে ফুটপাতে বিক্রি হয়। আমাদের সঙ্গীরা হাতঘড়ি, টি-শার্ট, জুতা, মেয়েদের চামড়ার ব্যাগ কিনে দুই হাত ভর্তি করে ফেলল। কেনাকাটার জন্য থাইল্যান্ড খুবই ভালো দেশ।

একটু সময় নিয়ে কেনাকাটা করলে, ভালো দামাদামী করতে পারলে থাইল্যান্ড থেকেই প্রাণভরে কেনাকাটা করতে পারবেন। পণ্যের মূল্যমান আমাদের দেশের প্রায় সমান। সবচেয়ে বড় ব্যাপার বিখ্যাত ব্রান্ডের পণ্যগুলো সুলভমূল্যে কেনা যায়। আমি ১টেরাবাইটের একটা হার্ডডিস্ক বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিনহাজার টাকা কমে কিনতে পারলাম। আমার এক সহসঙ্গী এলসিডি টিভি আর হোম থিয়েটার কিনেছিল।

ভ্যাট-ট্যাক্স সহ সব খরচ বাদে প্রায় ষাট হাজার টাকা মতো লাভ করে। ব্যাংককের ফুটপাতের প্রায় সব দোকানদের হাতে আইফোন আর স্মার্টফোনের ব্যবহার দেখে অনুমান করা যায় এখানে মোবাইলের দামও অনেক কম। ব্যাংককের ফ্লোটিং মার্কেটে সুস্বাদু ফল বিক্রি হয়। কিন্তু সময়ের অভাবে ফ্লোটিং মার্কেটে যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাই ফ্লোটিং মার্কেটের অভিজ্ঞতা লিখতে পারলাম না।

ভাষা ভাষা বিড়ম্বনা কাকে বলে থাইল্যান্ডে এসে হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি। এরা না জানে ইংরেজী ভাষা, না জানে বাংলা। জানে শুধু থাই ভাষা। ওদের কথা আমরা বুঝি না। আমাদের কথা তারা বোঝে না।

তারপরও ভাষা আসলে মনের ভাব প্রকাশে বাধা হতে পারে না। একটি উদাহরণ দিই। তাহলে বুঝতে পারবেন। ভাষা ছাড়াও কিভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। কেনাকাটা করছি।

কোন জিনিস পছন্দ হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হাউ মাচ (এইটার অর্থ ওরা এতদিনে বুঝে গেছে?) সে ক্যালেকুলেটর বের করলো। ক্যালকুলেটর টিপে জানালো, ১০০ বাথ। আমিও ক্যালকুলেটর নিয়ে প্রেস করলাম, ৭০ বাথ। সে আবারও ক্যালকুলেটরের সাহায্যে জানালো, ৮০ বাথ।

এইভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমরা দরদাম করে একটা সমঝোতায় আসতে সক্ষম হই। থাইল্যান্ডের ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে ঝা চকচকে শপিং মল গুলোতে তাই ক্যালকুলেটর একটা অন্যতম বিক্রয় মাধ্যম। ট্রাফিক জ্যাম এতিদন আমার ধারণা ছিল ট্রাফিক জ্যামে আমরাই সেরা ব্যাংককে এসে জানতে পারলাম ট্রাফিক জ্যামে ব্যাংককও কোন অংশ কম নেই। আর হবেই বা না কেন। সমগ্র থাইল্যান্ডের এক তৃতীয়াংশ লোকই এই রাজধানী শহরে বাস করে।

অর্থনৈতিকভাবে খুব অল্প সময়ে ব্যাংকক উন্নতি করায় এখানকার মানুষের জীবনযাত্রারও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় প্রতিটা পরিবারই নিজস্ব পরিবহনের মালিকবনে গেছেন। ফলাফল, ব্যাংকক শহরে পর্যাপ্ত রাস্তা, উড়ালসেতু, ফ্লাইওভার, গণপরিবহন, স্কাইট্রেন থাকা সত্বেত্ত তা নিজস্ব পরিবহনের ভীড়ে পর্যাপ্তও অপর্যাপ্ত। থাইল্যান্ডে ট্রাফিক যথেষ্ট কড়া। এরা লালবাতি, হলুদবাতি দেখে গাড়ি চালায়।

ওভারটেক করে না। ফাকা রাস্তায় লালবাতি জ্বলা থাকলে গাড়ি দাড়িয়ে যায়। আর হলুদ বাতির অপেক্ষায় থাকে। ঠিক কত সময় সিগন্যালে দাড়িয়ে থাকতে হবে তা সিগন্যাল লাইটের পাশের সাইডস্ক্রীনে কাউন্ট ডাউন হতে থাকে। এতকিছুর পরেও ট্রাফিক জ্যামের অভিশাপ থেকে ব্যাংকক মুক্ত হতে পারে নি।

তবে মধ্যরাতের পর ব্যাংককের রাস্তায় চলাফেরা করে বেশ মজা পাওয়া যায়। তখন ট্রাফিক জ্যাম থাকে না। টুকটুকে (আমাদের দেশের বাটারিচালিত অটো রিকশার মতো এক প্রকার পরিবহন) বসে পক্ষীরাজের মতো উড়তে উড়তে ব্যাংককের রাতের রাস্তা মাতানো দারুন উপভোগ্য। [ব্যাংকক শহর] পাতায়া শহরে ব্যাংককের তুলনায় চলাফেরা করে আরাম। শহরটা মূলত পর্যটনকেন্দ্রিক।

স্থানীয়দের থেকে পর্যটকদের সংখ্যায় এখানে বেশী। শিল্প-কারখানার প্রভাব এখানে নেই। তাই গাড়ীর ভীড়ও নেই। এখানে বাইক ভাড়া পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে আপনি বাইকভাড়া করে শহরটা ঘুরে দেখতে পারেন।

লেগুনা টাইপের তবে আমাদের দেশের লেগুনা থেকে অনেক আধুনিক একপ্রকার গাড়ী শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা সবসময় চলাচল করে। অল্প খরচে এই গাড়ীতে সারা শহরটা ঘুরে দেখা যায়। আর আছে স্পেশাল দোতাআলা টুরিস্ট বাস। এই বাসে চড়ার মজাই আলাদা। থাই নারী-পুরুষ আমার পাঁচদিনের অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, থাই নারীরাই থাইল্যান্ডের চালিকাশক্তি।

দোকান-পাট, রেস্তোরা, বার, আতিথেয়তা সর্বত্রই থাই নারীরা পরিচালনা করছে। রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ থাই নারী চোখে পড়ে সে পরিমাণ থাই পুরুষের দেখা মেলে না। অন্য সব পেশা বাদ দিয়ে থাই পুরুষরা শুধু গাড়ীর ড্রাইভার আর দালালী পেশাকেই পুরুষোচিত পেশা হিসেবে ধারণ করছে। অন্য সবক্ষেত্রেই থাই নারীয়া সব। থাই নারীরা নিজেই পণ্য হচ্ছে আবার তারাই সকল কর্ম পরিচালনা করছে।

থাইল্যান্ডে প্রচুর হিজড়া চোখে পড়বে। তারা অন্যদের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। আমাদের দেশের মতো সমাজের হেয় শ্রেণী হিসেবে গণ্য হয় না। খাবার-দাবার আমরা পাঁচদিনের ট্যুর প‌্যাকেজে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম। খাবার প‌্যাকেজের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত।

তাই পাঁচদিন প্রায় সববেলায় হোটেলে খাবার খেতে হয়েছে। তিন তারক-চার তারকা এই হোটেলগুলো সকলদেশের মানুষের খাদ্যভাস বিবেচনায় সার্বজনিন খাবার মেনু সেট করে। তাই হোটেলের খাবারগুলোতে আসলে দেশীয় খাবারের স্বাদ পাওয়া যায় না। দেশীয় খাবারের স্বাদ নিতে হলে স্থানীয় রেস্তোরায় ঢু মারতে হবে। আমাদের সেই সুযোগ হয়ে উঠেনি অথবা বলা যায় সেই সুযোগ তৈরি করার সৎসাহস কেউ দেখায় নি।

আমাদের দেশের ভ্রাম্যমান চটপটি-ফুচকা, মাংসের চাপের দোকানের মতো ওদেশে রাস্তায় রাস্তায় প্রচুর ভ্রাম্যমান দোকান দেখলাম যেখানে শকুরের মাংস আর কী সব হাবিজাবি দেদারচ্ছে বিক্রি হচ্ছে। সত্যি বলতে এগুলো খাবারের রুচি হয়নি। পাতায়া সৈকতে ২০ বাথ দিয়ে ডাবের পানি খেয়েছিলাম। এমন মিষ্টি ডাবের পানি আমি আমার লাইফে খাইনি। তবে আফসোস রয়ে গেল, ডাবের ভিতরে জমা শাশ না খাওয়ার।

ডাবের শাশ যে সুস্বাদু খাবার ওরা এইটা জানেই না। বহুবার বললাম, দা দিয়ে ডাবটা দ্বিখন্ডিত করে দিতে। কিন্তু ডাবওয়ালা আমার কথা কানে না দিয়ে বার বার ডাস্টবিন দেখিয়ে দিলো। বুকের ভিতরে হাহাকার জমাট বেধে ডাবটা ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করলাম। ফিরে আসার সময় প্লেন তিনঘন্টা লেট।

শুনে আমার তো মহাখুশি। আরও কিছু সময় ঘোরাঘুরির সময় পাওয়া গেল। প্লেন ডিলে হওয়াতে প্রত্যেকেই ২০০ বাথ করে লাঞ্চ কুপন দেওয়া হলো। ২০০ বাথের সাথে আরো ৪৫বাথ যোগ করে সুবর্নভুমি এয়ারপোর্টে বসে নুডুলস খেলাম। নুডুলসটা শুধু সেদ্ধ, চিংড়ি, লতা-পাতা যেগুলো দিয়েছিল একদম কাঁচা।

অভ্যাস নাই তো, একটু কষ্ট হয়, তবে খাওয়া যায়। স্বাদ খারাপ না। [থাই নুডুলস] আমার সহসঙ্গী বেশি ভাব দেখাতে যেয়ে স্যুপ অর্ডার দিলো। স্যুপ খাবার জন্য দুইটা কাঠি ধরায় দিলো। এই কাঠি দিয়ে তরল স্যুপ কিভাবে খায়? [দুইকাঠিতে স্যুপ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চলছে] খাবার ভিতরে থাইল্যান্ডে সবচেয়ে সস্তা খাবার হলো এ্যালকোহলযুক্ত পানিয়।

একটা বিয়ার ক্যান ২৬ বাথ আর হাফ লিটার মিনারেল ওয়াটার ৪৩ বাথ। আপনি তাহলে কোনটা খাবেন? এখানে বিভিন্ন স্বাদের জুস পাওয়া যায়। কয়েক স্বাদের জুস খেয়ে দেখেছি। স্বাদ ভালো। শেষ করছি নাসির ভাইয়ের বাংলা খাবারের অভিজ্ঞতা দিয়ে।

ব্যাংককে থাকাকালীন দুইবেলা নাসির ভাইয়ের বাংলা খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আসলে আমরা বাঙালী, গরম ভাতা আর ডাল ছাড়া আমাদের পেট ভরে কিন্তু মন ভরে না। নানা স্টেশন থেকে হোটেল অ্যাম্বেসেডর-এর পাশেই নাসির ভাইয়ের বাংলা খাবারের দোকান। বাংলা খাবারের ঘ্রান শুনেই আমার খুশিতে বাকবাকুম। ধোয়া উঠা ভাত, ডাল, আলু ভর্তা, গরু ভুনা, মুরগীর ঝোল; আহ জগতের সেরা খাবার।

পেট ভরে খেলুম আর নাসির ভাইকে বারং বার ধণ্যবাদ জ্ঞাপন করলুম। সবচেয়ে বড় কথা পরিচিতি পরিবেশে বাংলায় কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল। গর্দভ থাইবাসীরা না পারে ইংরেজী না বাংলা। এই কয়দিন চ্যাঙ ব্যাঙ শুনতে শুনতে হাপিয়ে উঠেছিলাম। আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-১ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-২ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৩ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৪ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৫ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৬ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৭ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৮ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৯ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-১০ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-১১ আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-১২
 



আরো পড়ুন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.