আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই যে আমার নানা রং এর দিনগুলি



জীবনের প্রতিটা সকাল একই রকম আসেনা। আজকের সকালটা কেমন যেনো অন্যরকম। বাইরের আলোর দিকে তাকিয়ে নিজের মধ্যে একটা আলো খেলা করছিলো। ঘুম ভেঙে যাবার পর জানালার পর্দার সরিয়ে বাইরের আকাশটা দেখি। ভোরের আকাশ এর নীচে শহরের বাতিগুলোকে কেমন পানসে মনে হয়।

এমন সকালে উঠা হয়না আজকাল। অথচ এই সব সকালে উঠলে এখনো ছোটবেলার মত খুব ভালো লাগে। ছোটবেলায় ভোর বেলায় উঠলেই মায়ের সাথে নামাজ পড়তাম। এর পর বাসার সামনে ফুল বাগানে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি। শরৎকাল হলে শিউলী ফুল কুড়ানো।

এরপর পড়তে বসা। পড়া শেষ হলে চিঠি লেখা। আমার ছোটবেলায় পত্রমিতা আপু ছিলো। ওর নাম হীরা। হীরা শামীম।

সিলেটের রায়নগর ছিলো ওদের বাড়ী। এমন সকালে আমি মাঝে মাঝে হীরা আপুকে চিঠি লিখতাম। ভাবতে কি ভালো যে লাগে....কত্ত ছোটবেলায় আমার কাছে প্রতি সপ্তাহে চিঠি আসতো........। ঢাকা থেকে ভাইজানের। আপুর।

অন্যদিকে হীরা আপুর এবং পরে হীরা আপুর সুবাদে পরিচয় হওয়া দাদামনির। হীরা আপুর বড় বোনেরা সম্ভবতঃ ভাইজানের পরিচিত ছিলো। সেই থেকে পরিচয়। আমার আপু থাকতে ঢাকা ইউনিভার্সিটির শামসুন নাহার হলে। ওর কাছ থেকেও চিঠি আসতো।

আমি তো নিয়মিত চিঠি লিখতাম। আপুকে একটা চিঠি লিখেছিলাম যা নিয়ে ও প্রায়ই খেপাতো। "আপু কেমন আছো? তোমরা কবে আসবা? আব্বা ,মা ,আমি ভালো আছি। আমাদের লাল গরুটার একটা বাছুর হয়েছে। ওর গায়ে সাদা সাদা দাগ।

ওর নাম দেয়া হয়েছে বল্টু। " আপু অনেক দিন পর্যন্ত এই চিঠির লাইন গুলো বলে খেপাতো। আমি তখন খেপে যেতাম। কিন্তু এখন ভাবলে ভালোই লাগে। আর একবার ভাইজানকে একটা চিঠিতে লিখেছিলাম.....(ভাইজান থাকতো ঢাকা মেডিকেলের ফজলে রাব্বি হলে।

) "ভাইজান,সালাম নিও। কেমন আছো?আমি খুব ব্যস্ত। চিঠি লেখার সময় পাই না। আজ একটু আগে ফুটবল খেলে আসলাম। আমাদের দল ২-০ গোলে জিতেছে।

" ভাইজান চিঠিতে হাতের লেখা খারাপ হলে খুব রাগ করতো। তাই ওর কাছে চিঠি লিখতে বসলে খুব মনোযোগী থাকতে হতো। ছুটিতে বাড়ীতে আসলে আপু ভাইজান সুযোগমত এই সব চিঠির কথা বলে ব্লাকমেইল করতো। ভাইজান সবসময় চাইতো আমি যেনো আব্বার খেয়াল রাখি। তাই চিঠিতে সবসময় লিখতো আব্বার সার্টের বোতাম ঠিক আছে কিনা।

জুতায় কালি দেয়া আছে কিনা। কাপড় ইস্ত্রি করা আছে কিনা,যেনো খেয়াল রাখি। আমাদের বাসায় যে ডাকপিওন টা আসতো। বাসার সামনে এসে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলের বেলটা টুংটাং করতো আর ডাকতো সাজিমনি চিঠি। আমি বাসায় থাকলে পড়িমড়ি করে ছুটে আসতাম।

কখনো আপু,কখনো ভাইজান,দাদামিন ,হীরা'পু অথবা পাশের বাসার বাবুদার চিঠি আসতো। বাবুদা তখন রংপুরে কারমাইকেল কলেজে পড়তো। খামের মধ্যে ভরে আমার জন্য মিমি আর চুইং গামের বাহারী কাগজ পাঠাতো। যা পেলে মিমি আর চুইংগামের জন্য মন কেমন করতো। দাদামনি দারুণ চিঠি লিখতো।

মনে হতো কথারা এসেছে খামে ভরে। সেইসব সময়ে দাদামনির হাতের লেখা আমি নকল করতাম। দাদামনির চিঠি জুড়ে থাকতো বৌদিমনি,উনাদের ছেলে ময়ূখ আর দাদামনির মায়ের গল্প। দাদামনির বাড়ী ছিলো চট্রগ্রামের আঁধারমানিক গ্রামে। উনি চাকরীর সুবাদে সিলেটে থাকতেন।

সেই দাদামনিকে দেখেছিলাম একবার.....ভাইজান ভাবী তখন মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে চাকরী করে। চিরটাকাল ভাবনা বিলাসী আমি,আমার লেখা পড়ে দাদামনি আমাদের বাড়ীর সবাইকে যেমন করে ভেবেছিলো...... মির্জাপুরে বেড়াতে এসে হয়তোবা তেমন করে পাননি তাদের। আমার কাছের মানুষদের ব্যবহারে হয়তোবা আমার বলামত উষ্ণতা খুঁজে পাননি,যা উনাকে ব্যথিত করেছিলো। আমি তখন কলেজে পড়ি। এরপর থেকে দাদামনির সাথে যোগাযোগ থাকেনি।

আমি দুই একবার চিঠি দিয়েছিলাম কিন্তু উত্তর আসেনি। দাদামনি আমার জন্য ভূপেন হাজারিকার দুইটা ক্যাসেট এনেছিলেন। সেই সব গান শুনলে এখনো দাদামনিকে মনে পড়ে। কে জানে উনি কোথায় কেমন আছেন। উনার ছোট্ট একটা বোনকে উনি কি মনে রেখেছেন কিনা কে জানে!উনাদের ছেলে ময়ূখ এতদিনে অনেক বড় হবার কথা।

অনেক দিন খুব মন খারাপ লাগতো। মাকে বলেছিলাম সব কথা। মা বুঝতো । একমাত্র মা আমাকে চিরটাকাল বুঝেছে। আমার ভাবনাবিলাসী মনটাকে ছুঁতে পেরেছে।

মা বলতেন তুই যা তুই তাই। কখনো বদলাবি না। কোন ঘাত প্রতিঘাতে হেরে যাবি না। তেমনি থেকেছি। আমি যেমন ছিলাম ,সেই ছেলেবেলার সবার সাজিমনি।

কাউকে এতটুকু ভুলে যাইনি। (চলবে....)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।