আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাইভেটাইজেশন এবং বিনিয়োগ-৩



এর আগে বিরাষ্ট্রীয়করণের কয়েকটি তালিকা দেখেছিলাম, এবং জানিয়েছিলাম যে বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রধানতম ধাপ হলো এগুলোকে লোকসানী প্রতিষ্ঠান বানানো এবং লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যাপক প্রচার দেওয়া। একাজটি প্রতিটি সরকারই খুব ভালো ভাবে করেছে। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে যুক্তি আসে সেগুলো হলো - সরকার এই লোকসানী প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখে কি করবে? লোকসানী প্রতিষ্ঠান মাত্রই সরকারের বোঝা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসান সরকারকে টানতে হলে সেই সরকার অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারেনা..... ইত্যাদি। একটু দেখলেই বুঝা যাবে, এসব প্রচারণা আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং প্রচণ্ড ভ্রান্ত। প্রথম কথা হচ্ছে এসমস্ত প্রতিষ্ঠান বাস্তব গ্রহণযোগ্য কারণে লোকসানী হয়েছে নাকি এসমস্ত প্রতিষ্ঠানকে লোকসানী প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে।

লোকসানের পেছনে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়- সেগুলোর মধ্যে আছে দুর্নীতি, মাথাভারী ও অদক্ষ ম্যানেজমেন্ট, সিস্টেমের আধুনিকায়ন না করা, অদক্ষ কর্মচারী ও শ্রমিক, আমলাতান্ত্রিকতা ইত্যাদি। এসমস্ত কারণকে সত্য ধরে নিলেও প্রশ্ন আসে- এগুলো দূর করা কি যেত না? তারচেয়েও এগুলোর জন্য প্রকৃত দায়ী কে বা কারা? সবার প্রথমেই আনা হয় দুর্নীতির কথা, কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে এই দুর্নীতির সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এবং এমনকি সরকারে অবস্থিত লোকজনই জড়িত ছিল নানাসময়ে। সে দুর্নীতির দায় চাপিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকেই বন্ধ করে দেয়া কি যৌক্তিক? রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক, বাপ-মা সবই রাষ্ট্র তথা সরকার। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা, প্রতিযোগীতাশীল বাজারের উপযোগী বানানো, অন্যদেশের সাথে প্রতিযোগীতায় সমর্থন দেয়া এসমস্ত কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হয়। এটি যদি না করা হয়, তবে সেই প্রতিষ্ঠান কি কোনভাবেই দ্রুত বর্ধনশীল প্রতিযোগীতামূলক বাজারে টিকতে পারবে? আমাদের ক্ষেত্রে সরকার কি সেই ভূমিকা নিয়েছে? সবচেয়ে বড় কথা এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান তো একসময় লাভজনক ছিল! এবং এখনো এসমস্ত সেক্টরে অভূত সম্ভাবনার কথা সরকারই স্বীকার করছে, যদিও তা প্রাইভেট সেক্টরকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে।

প্রাইভেট সেক্টরকে আকর্ষণ করার লক্ষে বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়েব সাইটে এ ধরণের প্রচারণার মধ্যে এ কথাও ফলাও করে ঘোষণা করা হয় যে, সে সেক্টরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে বা করা হবে!! কিছু উদাহরণ দিলে এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ইস্পাত সেক্টরকে সম্ভাবনাময় খাত হিসাবে দেখাতে গিয়ে বলা হচ্ছে- ইস্পাত খাতে সাম্প্রতিক বুমিং এর কথা, চাহিদা-যোগান সম্পর্কের কথা এবং সেই সাথে ৮৭ তে নেয়া শিল্প উদারীকরণ সিদ্ধান্তের কথাও। সেই সাথে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ বিরাষ্ট্রীয়করণের কথা জানান দেয়া হয়। অথচ, একসময় দেশের চাহিদার সামান্য অংশই এই চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ মেটাতে পারতো, বাকিটা আমদানি করতে হতো। সে সময়ও তো এই রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানাটির সামনে অভূত সম্ভাবনা ছিল- ১৯৮৭ এর পর থেকে আজতক বেসরকারী খাতে ৩০০ এর বেশী ইস্পাত ও ইস্পাত সামগ্রী প্রস্তুতকারক ইউনিট, ৯টি সিআর শিট/কয়েল ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, ২৫০ টি মিল সম্বলিত ৬টি ইস্পাত রি-রোলিং ইউনিট গড়ে উঠেছে, স হজলভ্য পানি ও গ্যাস ব্যবহার প্রতিটিই লাভজনক অবস্থায় আছে, এমনকি রপ্তানীর দিকে এগিয়ে যেতে পারে; তখন কি একবারো মনে হয় না, আমাদের চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ এর পক্ষে কি সম্ভব ছিল না ইস্পাত সেক্টরে লিডিং অবস্থানটি নিতে? আজ টাটা এখানকার সস্তা গ্যাস, পানি, ভূমি, শ্রমের গন্ধে ইস্পাতে বিনিয়োগ করতে আসলে, সকলের চোখ চকচক করে ওঠে; জনমত উপেক্ষা করে বারেবারে টাটা গ্রুপের সাথে দরকষাকষি হচ্ছে- অথচ সরকারের পক্ষ থেকে যতখানি ফেভার অফার করা হয়েছে, ততখানি ফেভার কি চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ পেতে পারতো না? (টাটা আরো সস্তায় সবকিছু পেতে চায়- সে ভিন্ন প্রসঙ্গ!) একইভাবে পাট খাতের দিকে তাকাই....... পাট খাত আজ আমাদের এক দীর্ঘ হতাশার আরেক নাম।

"অর্থকরী ফসল", "সোনালী আঁশ" খ্যাত পাট ছিল আমাদের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল। পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ সালে প্রথম পাটকল আদমজী জুট মিলে উৎপাদন শুরু হয়, ১৯৫৫ এ আরো ৬টি পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ষাটের দশকে ভারতের সাথে প্রতিযোগীতার সম্মুখীন হলে- সরকার রপ্তানী আয়ের উপর ৩৫% বোনাস ভাউচার নামে ভর্তুকি চালু করে। অর্থাৎ ১০০ টাকা রপ্তানী আয় হলে সরকার ৩৫ টাকা ভর্টুকি দিত, ফলে মোট আয় হত ১৩৫ টাকা। এভাবেই ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ এ পাটকলের সংখ্যা হয় ৭৭টি, আদমজী হয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল, এ কারখানা দিয়েই আদমজী পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শীর্ষে উঠেছিল, এর মুনাফা দিয়েই আরো ১৩টি পাটকল গড়ে তুলেছিল।

যদিও পাটকলের মালিক সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী, আমাদের পাটের মুনাফার পুরোটাই চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে- সেই বৈষম্য ভিন্ন ইতিহাস। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে অব্যাহত লুটপাটের মধ্য দিয়ে এহেন পাটখাতকে লোকসানী বানানো হয়েছে। এর পরে চলেছে একের পর ধ্বংস যজ্ঞ। এই ধ্বংসলীলার সাথে বিশ্বব্যাংকের নাম বিশেষভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক্রমেই প্রথম বেসরকারীকরণ শুরু হয় ১৯৮২ সাল থেকে স্বৈর শাসক এরশাদের আমলে।

বন্দুকের নলকে সামনে রেখে ঐ বছর ৩০ নভেম্বর এক দিনে ১০ টি পাটকল বেসরকারীকরণ করা হয়, পরের মাসে আরো ১৩ টি- ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৬৯ টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। সরকার এই মিলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দিয়েছিল মাত্র ১৭৫ কোটি টাকায়। আর মালিকেরা ৩৪ কোটি টাকা পরিশোধ করার পর আজ পর্যন্ত বাকি টাকা পরিশোধ করেনি (যুগান্তর ৬ আগস্ট, ২০০৫)। ১৯৯৪ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সাথে "জুট সেক্টর স্ট্রাকচারাল কন্ট্রাক্ট" স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় আদমজীকে ডাউন সাইজ করার কাজ শুরু হয় অর্থাৎ আদমজীর তাঁত সংখ্যা ৩২৫০ থকে কমিয়ে ১৫০০ টি করা হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিক্রি, বন্ধ এবং শ্রমিক ছাটাই সহ পাটখাতকে সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় (যদিও শেষ পর্যন্ত দিয়েছে ৫ কোটি ডলার!!), একই সময়ে ভারতকে পাটশিল্প উন্নয়নের জন্য ইউএনডিপি (জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল) দিয়েছে ২৫ কোটি ডলার। অবশেষে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে বিএনপি-জামাত সরকার চিরতরে আদমজী বন্ধ করে দেয়, ৩০ হাজার শ্রমিক পথে বসে। অথচ, ২৩০ কোটি টাকা খরচ করলেই আদমজী আধুনিকায়ন করা যেত। বিশ্বে যখন পাটজাত পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, যে সময়ে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানী আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে- সেসময়েই পাটকলগুলো একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব দেখে কি লোকসানের গল্পটিকে ফাঁপানো মনে হয় না?? পাটকলগুলোকে কি আধুনিকায়ন করা হয়েছিল? অর্ধ শতাব্দীর জীর্ণ-নড়বড়ে তাঁত দিয়েই কেন তাকে প্রতিযোগীতায় নামতে হবে? ৩২৫০ তাঁত চালানোর উপযোগী মিলে মাত্র ১৫০০ টি তাঁত চালানোয় বাধ্য করা হলো কেন? এসবের যদি লোকসান হয়- সেটিকে কি পরিকল্পিত মনে হয় না? এরকমই ঘটেছে, এবং ঘটছে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বেলায়।

এই লোকসানের সমস্তটাই আরোপিত। শাসকগোষ্ঠী চেয়েছে, তাদের প্রভু দাতাগোষ্ঠী চেয়েছে- এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ুক- ধুকে ধুকে চলুক। এবং সেটাই হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের কথা- আমরা তাদের প্রচারণায় এমনই বিভ্রান্ত যে, এই প্রতিষ্ঠান গুলোর লোকসানে আমরা যতখানি চিন্তিত-উদ্বিগ্ন, এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ তথা ধ্বংস করার মাধ্যমে যে লোকসান ঘটেছে- ঘটছে, তার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি!! ... (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।