আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবারো মালয়শিয়া !!! (শেষ পর্ব) : হাত ধরেছি হাঁটছি পথে কড়া দুপুর, জোছনা রোদে, ভিজে বিকেল, চুল উড়ে যায়, মন ভিজে যায় দূর্বা ঘাসে... ....ভাসছি আহা...খুঁজছি আহা...ভাবছি আহা...

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

আমার এবারের যাত্রাটা নিতান্তই অকস্মাৎ পরিকল্পনা ; কারণ বছর দু’য়েকের মাথাতেই আবারো এতোটা পথ উড়াল দিব এটা সত্যিই চমক ছিল আমার নিজের কাছে তা আগেও বলেছি। সেজন্যই এতোসব ঘোরাঘুরির ফাঁকে পুরোন পরিচিতদের সাথেও দেখা-সাক্ষাৎ অথবা ফোনালাপ সেড়ে নেয়াটা বেশ উপভোগ্য ছিল । কেউ কেউ চেষ্টাও করছিল নিজ নিজ কাজের মাঝে আমাকে যতটা সম্ভব সময় দিতে । প্রায় চার কি পাঁচ বছর পর দেখা হলো এক পুরোন সহকর্মীর সাথে তাও আবার KL -এ । বেচারীর গল্প করার মত দেশী মানুষ নেই তেমন তাই কথার ঝাঁপি খুলতে সময় লাগে না ।

দু’জনে মিলে অনেক রান্না-বান্নাও হলো । সারাভানান, (মালয় তবে অরিজিন তামিল ইন্ডিয়ান, পেশায় উকিল, যুক্তিতর্কে পেরে ওঠা দায়) একদিন লাঞ্চের দাওয়াত দিলো । ওর কাছে আব্দার জুড়ে দিলাম আমার পুরোন হোস্টেলের সামনে দিয়ে এক চক্কর ঘুরিয়ে আনতে হবে । আব্দার রক্ষার বিনিময়ে লাঞ্চে আমি চমৎকার শ্রোতার ভুমিকা পালন করলাম; সারাভানান বকর বকর করে গেল মালয়শিয়ার কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে, নিজের পেশা নিয়ে, পরিবার নিয়ে । দেশে ফিরে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে আমার রোগা স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এ মন্তব্য ছিল লী’র (চাইনিজ মালয়) ।

চশমার বদলে কণ্টাক্ট লেন্স - ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না স্যাম (চাইনিজ মালয়) –এর । এক সন্ধ্যে বেলা চট করে ঘুরে আসলাম ইসলামিক ইউনিভার্সিটি । Suria KLCC –র সামনের লেকটার একটা অংশই দেখেছিলাম আগেরবার , এবার ঘুরে ফিরে আশপাশটাও দেখে নেয়া গেল । অনেকদিন পর মোসাদ্দেকের সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল । শুরুর দিকে KL এসে খুবই বিষন্ন থাকত ছেলেটা ।

প্রায়ই তার এক কথা ছিল, ”আপু, কি করব ?” , সেই মোসাদ্দেকের চকচকে চেহারা, ফিটফাট পোষাক বলে দিল এখানকার মানুষ, পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর সাথেই এখন সে অনেক বেশী স্বাভাবিক। আমার কারণেই বেশ দেরী হয়ে গেল, তবু মোসাদ্দেক সময় দিতে চাইলেও একটা ফোন আসায় ওকে যেতেই হলো। এ জায়গা আমার অপরিচিত কিছু নয়; একাই কিছুক্ষণ ঘুরব-ফিরব ঠিক করলাম। KLCC -র সামনে ঘুরে-ফিরে ভিডিও করছি, হঠাৎ মাথায় খেলে গেল, কেননা এখান থেকে হেঁটে হেঁটে মাসজিদ জামেক পর্যন্ত যাই! একটা সময় নব্বই সেন্ট বাঁচাতে প্রায় তিরিশ মিনিট হাঁটতাম এই রাস্তায়। হাঁটা শুরু করতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

রাস্তা পার হয়ে আরেকটা বাস স্টপেজ, বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় ওখানে বসে ঝুম বৃষ্টি, পথচারী, গাড়ী, উঁচু উঁচু অফিস বিল্ডিংগুলো দেখতে লাগলাম। বৃষ্টি কমতেই হাঁটা শুরু , অবশ্য মাঝে মাঝে থেমে টুকটাক ভিডিও করে নিলাম । এবারও সেই তিরিশ মিনিটের খুব বেশী লাগেনি । আগের মতই স্ট্যান্ডার্ট চার্টার্ড ব্যাংকের একটু সামনে থেকে বাস নিয়ে ফিরে গেলাম। এগুলো পরে বলতেই কেউ কেউ মৃদু হাসল ; জয় তো বলেই বসল, ”আপু, আপনি পারেনও !” ।

একদিন মাসজিদ জামেক এলাকার একটু ভেতরের রাস্তায় হাঁটছি কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খাবো বলে । চোখে পড়ল কয়েকজন মিলে রাস্তায় বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে । হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম এইরকম কিছু অভিনব পন্থায় বিদেশে ভিক্ষাবৃত্তি হয়ে থাকে । নিজেই একটা বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম । এরা তো নিজেদের মেধা দেখিয়েই রোজগার করছে, হোক না রাস্তায় ।

রাস্তায় তো বিশাল আয়োজন করে কনসার্টও হয়, অনেক টাকা দিয়ে হৈ-হু্ল্লোড় করে সেই কনসার্ট দেখা হয় । নামীদামী শিল্পীদের বেলায় অর্থপ্রাপ্তি হয়ে ওঠে সন্মানী। একটা সুস্থ উপায়ে রোজগার করাটাকে ভিক্ষাবৃত্তি নাম দেয়াটা আমাদের এক ধরনের উন্নাসিকতাই কি ! পঞ্চাশ রিংগিতের নোট নিয়ে বেজায় মুশকিলে পরলাম । একখানে দিতে গেলে ফেরত দিয়ে বলল, নোটের গায়ে লেখা তাই এটা চালানো যাবে না ! লেখা বলতে কলম দিয়ে সংখ্যা লেখা, মনে পড়ল দেশে মানি এক্সচ্যাজারের লোকটাই রিংগিত গুনে গুনে কোন কোন নোটের উপর সংখ্যা লিখে রাখছিল । মালয়দের টাকার যত্ন নিতে দেখেছি, এদের এখানে একদম পুরোন, ভাঁজ পরা, ছেঁড়া নোট দেখাই যায় না! সেন্ট্রাল মার্কেটের কাছেই আরেকটা মার্কেটে (চায়না টাউন না কি জানি, মনে পড়ছে না ঠিক তবে এখানে সস্তায় কেনাকাটা করা যায় নাকি) একটা টি-শার্ট কিনে নোটটা চালানোর চেষ্টা করলাম আবার ।

নোটটা দেখে এই দোকানিও ফেরৎ দিয়ে দিল । এরপর আরেকটা দোকান থেকে সুভ্যেনির হিসেবে ছোট্ট টুইন টাওয়ার কিনলাম। দোকানি বাংলাদেশী ছিল, তাকে নোটটা দেখিয়ে অবস্থাটা খুলে বললাম। দোকানি বলল, দেখি কি করা যায় । দোকানের মালিক চাইনিজ মালয়, সে কাছেই ঘোরাফেরা করছিল ।

দাম কেটে বাকী রিংগিত ফেরতের জন্য দোকানি মালিকের কাছে নোটটা দিল , মালিক তাড়াহুড়ায় তেমন খেয়াল না করেই বোধহয় বাকী রিংগিত ফেরৎ দিল । দোকানি আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয় আমিও ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসি । এদিকেই একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি । বাংলা আলাপ-চারিতাতেই রেস্টুরেন্টে যারা কাজ করছে তাদের অনেকেই বুঝে গিয়ে কথা বলতে এগিয়ে আসল । দেখা গেল বেশীর ভাগই বাঙালী এবং অনেকেই খুব বেশী দিন হয়নি এসেছে।

বিশেষত যারা নতুন, তারা খুবই মন খারাপ করল দেশের জন্য । কেউ কেউ বলল, এর চেয়ে দেশেই ভাল ছিল; এখানকার মত দিনরাত রেস্টুরেন্টের মেঝে পরিস্কার করা, বড় বড় গামলা টানাটানি করতে হতোনা অন্তত । - তাহলে কি বুঝে আসলেন ? কেউ কেউ বলল, যা বুঝে-শুনে এতো টাকা খরচ করে এসেছে, সে ভাবে পায় নি । নতুন জায়গায় আসলে স্বভাবতই চট জলদি মানিয়ে নিতে কষ্ট হয় সবারই। তারপরও কেউ কেউ কষ্ট করে, একটু বুদ্ধির জোরে এক সময় মানিয়ে নেয়; তবে ভাগ্য সব সময় তো সবার সহায় হয়না।

এই সব শ্রমিক শ্রেণীর সাথে কিছু প্রতারক দালালদের কারণে তথ্য সংক্রান্ত লুকোচুরি হয় বেশী । কি দেশে , কি বিদেশে, বাঙালীরাই বাঙালীদের লুটে-পুটে খাচ্ছি- এসব লুকোচুরিতে যে সব দালালরা থাকে তারা যে বেশীর ভাগই বাংলাদেশী তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না ! এখানকার অনেক রাস্তাঘাট যেমন চিনি, আবহাওয়াকে জানি, খাবারের স্বাদের সাথেও পরিচিত তেমনি কিছু কম-বেশী পরিচিত বন্ধু-বান্ধব তো আছেই। তাই খুব স্বাভাবিক চলাফেরা, ঘোরাফেরা, গল্পগুজব, কাজ- কর্মে আমার তো মনে হচ্ছিলই সেই সাথে কেউ কেউ তো বলেই ফেলল যে বছর দু’য়েক পরে মাত্র ক’দিনের জন্য নয়, মনে হচ্ছে আমি যেন অ-নে-ক দিন থেকেই আছি (এবং শুধু আছি নয় বরং ফিরে যাওয়ার নামই নিচ্ছিনা এই টিপ্পন্নীও ছিল সাথে ; বলা বাহুল্য আমি সহাস্যে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেছিলাম ভাবনার এই অন্ত:মিলের সাথে) । রিটার্ন টিকেট ছিলই ; মাঝে এক দিন KL Central গিয়ে তারিখটা একটু পিছিয়েও নিয়েছিলাম কিন্তু সময় কখনও থেমে থাকে না । পঞ্জিকার পাতায় ঠিকই বিদায়ী দিন-ক্ষণ জ্বলজ্বল করে উঠল ।

চতুর্থবারের মত KLIA -তে পা দিয়ে আবিস্কার করলাম, মিলন আর বিচ্ছেদের এক অদ্ভূত জায়গা হলো বিমানবন্দর ! এখানে যে মুখকে অনেক উচ্ছ্বাসে ভিড়ের মাঝ থেকে খুঁজে নেয়া হয়, তাকেই আবার এক সময় ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখতে হয়; অথবা নিজেকেই । উইন্ডো সিট আবারো, পাশের সিটটা ফাঁকা । মন খারাপের ছাপ চেহারায় বেশ পড়েছিল বোধহয়, এটা-ওটা দিতে আসা এক ক্রু জিগেষ করল, ”ম্যাম, আর ইউ ওকে ?” । ওদিকে বিমান ছুটলো, উড়লো তারপর ভাসল - ফিরে যাচ্ছি দেশে । ... ... ... মধ্য রাতের ঘন্টা পরার একটু আগেই ZIA -র মেঝেতে পা দিলাম ।

কাস্টমসের কি সিস্টেম নাকি কাজ করছিল না, তাই ম্যানুয়ালি, কাগজে লিখে লিখে সবাইকে চেক আউট হতে হচ্ছিল । এতে অযথা সময় বেশী লাগছিল বলে, বেশ কয়েকজন যাত্রী একটু উচ্চবাচ্যও করল । লাগেজ বুঝে নিতে সময় লাগেনি । দিক নির্দেশনা দেখে এগিয়ে গেলাম, অটোমেটেড বেল্টে সবার লাগেজ ঘুরে ঘুরে আসছে - ZIA -তে এই পদ্ধতি আগে খেয়াল করিনি মনে হয়। বাইরে পা দিয়ে ভাইয়াকে দেখেই বললাম, ”তুই তো শুকিয়ে গেছিস!” ।

মাঝ রাতের ঢাকা শহর পুরো ফাঁকা, ক্যাব এক টানে বাড়ি পৌঁছে দিল । আম্মা এটা-ওটা খেতে এমন ভাবে সাধতে লাগল যেন আমি এক যুগ পরে দেশে ফিরলাম। টুকটাক , চটজলদি গল্প সেড়ে চোখে রাজ্যের ঘুম কিনবা ক্লান্তি নিয়ে ঘুমুতে গেলাম । সকালেই অফিস, দু’সপ্তাহ পর আবার সেই প্রতিদিনের ছকে বাঁধা ব্যস্ততা শুরু হতে যাচ্ছে ... । ************************** ভিডিও পরিচিতি : দু'টো ভিডিও -ই আমার ধারণকৃত ।

সেদিন একা একা ঘুরে-ফিরে, হেঁটে-ভিজে এই কাজই করলাম । প্রথমটি Twin Tower, KLCC আর দ্বিতীয়টি KLCC থেকে মাসজিদ জামেকের দিকে যেতে প্রায় মিনিট দশেক হাঁটলেই একটা মনোরেল স্টেশন । লম্বা, বাঁকানো কংক্রীটের ট্র্যাকের সাথে গুবরে পোকার মত আটকে থাকা এই ইলেকট্রনিক বাহনটা (মনোরেল) আমাদের দেশে থাকলে রাস্তায় জ্যামে আটকে পরা গাড়ীগুলোকে উপহাস করে কত দ্রুতই না গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম ! ************************** প্রথম পর্ব : Click This Link দ্বিতীয় পর্ব : Click This Link তৃতীয় পর্ব : Click This Link চতুর্থ পর্ব : Click This Link পঞ্চম পর্ব : Click This Link


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।