আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মন কেনো এতো কথা বলে?



জীবনের অনেকটা বাঁক পেরিয়ে আমি আমার ছোট্ট বন্ধু মানিকের কথা ভুলতে বসেছিলাম। বছর আটেক আগে বিবিসির বাংলা বিভাগের (এখন দৈনিক প্রথম আলোতে) কুররাতুল আইন তাহমিনা, আমাদের মিতি আপার টেলিফোনে এক লহমায় মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া সেই কালো মানিকের মায়াময় মুখ। মিতি আপা জানতে চান, আপনার কী মানিকের কথা মনে আছে? আমার প্রথমেই সাংবাদিক মানিকের নাম মনে পড়ে। মিতি আপা বলেন, আরে না, আমি টোকাই মানিকের কথা বলছি, ওই যে সে নাকী এক সময় আপানাদের সাথে দলবেঁধে ঘুরতো। আর খুব সুন্দর গান করতো।

... হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু কেনো? সময় থাকলে আপনি এখনই বিবিসির ইন্দিরা রোডের অফিসে চলে আসুন। খুব জরুরী। সে সময় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ফ্রান্সিস হ্যারিসনের সঙ্গে কিছু নিউজ করেছিলাম। এ জন্য বিবিসির ঢাকা অফিসের বাংলা বিভাগের প্রধান মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অনেকের সঙ্গেই আমার সখ্যতা ছিলো।

আমি ইন্দিরা রোডের ধানসিঁড়ি অ্যাপার্টমেনেন্টে গিয়ে স্টুডিওতে মিতি আপার মুখোমুখি বসি। ধূমায়িত এক কাপ ব্ল্যাক কফি সামনে রেখে মিতি আপা ছোট্ট সিডি রেকর্ডার বাজান, হেড ফোন গুজে দেন কানে। বলেন, আপনি আগে এটি শুনে বলুন তো, এটি মানিকের ভয়েস কী না! রেকর্ডে এক বালক কোকিল কন্ঠে গেয়ে চলে: প্রথম দেখার কালে রে বন্ধু কথা দিয়াছিলে/ আসি আসি বলে রে বন্ধু ফাঁকি দিয়াছিলে/ যদি না পাই তুমারে/ এই জীবনের তরে/ তখন কিন্তু বলবো রে আমি/ প্রেম কিছু না রে... ঝাঁ করে আমি ফিরে যাই কৈশর-প্রথম যৌবনের উড়াল দেয়ার দিনে। * সন্ধ্যা ঘনালে চারুকলার শুকনো পুকুর পাড়ে গাব গাছের নীচে বসে নগর-বাউলের আসর। পাগলা জাহিদ, বিপ্লব চক্রবর্তী, বাহার, ইংরেজীর ছাত্র মিল্টন, চারুকলার মৃনাল আর একেবারে পাত্তা না পাওয়া নবী (এখন পথিক নবী নামে স্টার!) -- ঢোল, দোতারার সঙ্গে গাইছেন একের পর এক সদ্য লেখা গান, জমেছে গাঁজার আসর।

রব বাউলসহ আরো দু-একজন নাম বিস্তৃত বাউলও আছেন সেই আড্ডায়। জাহিদ ভাই আমার উপস্থিতিতে খুশী হন। হাত ধরে টেনে এক পাশে বসান। পরিচয় করিয়ে দেন হাবাগোবা, লুঙ্গী পরা এক কালো মতো বালকের সঙ্গে। বলেন, ওর গলায় গান আছে।

... এরই মধ্যে এক বিঘতি গাঁজার কল্কে ঘুরে ঘুরে আসে। একটু পরে আমি প্রস্তাব করি, জাহিদ ভাই, এবার মানিকের গান হোক না! সবাই হইহই করে আমাকে সমর্থন দেয়। এই মানিক, গান ধর তো! ওই যে, ওই গামছার গানটা গা। ... কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই বালক ময়মনসিংহের আঞ্চলিক উচ্চারণে গেয়ে ওঠে: পিরীতেরই রঙিন সুতায় মনের গামছার বানাইছি/ সেই গামছা দিয়া তোরে বাইন্ধা ফালাইছি/তোরে যাইতে দিমু না/ মান করিয়া মানিনিয়া যাইতে দিমু না... এর পর মানিক আমাদের আড্ডাবাজীর দলে, মানে জাহিদ ভাইয়ের গানের দলে ভীড়ে যায়। জাহিদ ভাইয়ের গান ওর গলায় প্রাণ পেয়ে পাখনা মেলে: কোন বা বন্ধনে বান্ধিয়াছো ঘর, কারিগর?/ফাগুনের মাতাল হওয়ায়/ ঘর লড়বড় করে রে আমার/ ঘর লড়বড় করে/ ডাইনে বায়ে দুই জানালা/ ছাঁদ জুড়ে তার দরজা খোলা/ বাউল মনে দিয়া তালা/ থাকি কেমনে ঘরে?... ...এর পর নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমার ব্যস্ততা বাড়ে।

আমি জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে দলছুট হয়ে পড়ি। আগের মতো আর চারুকলা-টিএসসি যাওয়া হয় না। হঠাৎ হঠাৎ মানিকের সঙ্গে ঢাবির ক্যাম্পাসে দেখা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার আকুতি, স্যার একটা টাকা দেন, রুটি খামু। ... আমি অবশ্য এমনি এমনি ওকে টাকা দেই না।

বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে ওর দু-একটা গান শুনে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশী টাকা দেই। কখনো ১০, কখনো ২০টাকা দিলাম, আবার কখনো বা হয়তো ওকে এক বেলা পেটপুরে খাওয়ালাম, এ রকম আর কী! এরই মধ্যে শুনতে পাই, ওর গান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। * নব্বইয়ের পরে আমি পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়ি পেশাগত সাংবাদিকতা জীবনে। ব্যস্ততার ঘেরাটোপ আমাকে এতটুকু অবসর দেয় না। ...কোনো কাজ ছাড়া ঢাবি এলাকা, শাহবাগ, পাবলিক লাইব্রেরি, কী চারুকলায় যাওয়া হয় না।

তবে শুনতে পাই, জাহিদ ভাই, মিল্টন, বিপ্লব, মাসুদ--ওরা পুরোপুরি ভবঘুরে হয়ে পড়েছে...আর ভয়ংকর রকম হেরোইন আসক্ত! রাস্তা-ঘাটে এখানে-সেখানে কাটাচ্ছে ছন্নছাড়া মাদকাসক্তের জীবন! আর সঙ্গ-দোষে মানিকও নাকী ওই বয়সেই সিগারেট-গাঁজা খাওয়া শুরু করেছে। এক সহৃদয় ব্যক্তি মানিককে নাকী নিজের বাসায় রেখে গান শিখাতে চেয়েছিলেন। ও সেখান থেকে পালিয়ে আবার চলে আসে ঢাবির বন্ধনহীন ভাসমান জীবনে। জাহিদ ভাইকেও জনে জনে সুস্থ জীবনে ফেরাতে ব্যর্থ হন। সব জ্ঞানই এখানে অসাড় হে! আমি খবরেরই লোক...কিন্তু এইসব খবরে বুকের মধ্যে হাহাকার করে।

অসহায় সামান্য মানুষ, আমার তখন কিছুই করার থাকে না! আরো পরে ১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। ঢাকার সব রাস্তায় তখন রিকশা চলতো। আমি শাহবাগ থেকে রিকশা করে জিগাতলায় আজকের কাগজের অফিসে যাবো। কিছুতেই রিকশা পাচ্ছি না। হঠাৎ এক অল্প বয়সী রিকশাওয়ালা আমার সামনে এসে অনেকটা পরিচিত কণ্ঠে ডাকে, স্যার, ও স্যার, আমার রিকশায় আহেন।

আপনি বালা আছেন? হাড্ডিসার চোয়াড়ে চেহারার কিশোর রিকশাওয়ালাকে আমি চিনতে পারি। এ আমার সেই ছোট্ট বন্ধু মানিক! প্রথমে ওর রিকশায় বসতে একটু সংকচ হলেও পরে আমি তাতে চেপে বসি। পথে টুকটাক কিছু কথা হয়। মানিক জানায়, ওর এখনো রিকশার লাইসেন্স হয়নি। সে 'নিশা' করা পুরোপুরি ছেড়েছে।

আর তার রাতটুকু কাটছে সূর্যসেন হলের ক্যান্টিন বয়দের সঙ্গে। আমি জাহিদ ভাইয়ের কথা জানতে চাই। মানিকের অকপট স্বীকারোক্তি, হে অহন গ্যাস লয়, আর পাবলিক লাইবরির বারান্দায় বইয়া ঝিমায়। তারে বাড়ি থিকা খ্যাদায় দিছে! আরো কোনো ভয়ংকর কথা শুনতে হবে, এই ভয়ে আমি কথা বাড়াই না। গন্তব্যে পৌঁছে ওকে ৮-১০ টাকার জায়গায় ৫০ টাকার একটা চকচকে নোট দেই।

মানিক 'স্লামালাইকুম স্যার' বলে কেটে পড়ার আগে স্বাভাব সুলভ হাসিতে জানায়, টিএসসিতে যে কোনো সন্ধ্যায় রবির চায়ের দোকানে এলে তাকে পাওয়া যাবে। এখনো সে গান করে। অনেক নতুন নতুন গানও শিখেছে। ... সেটাই ছিলো মানিকের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। কেনো? বলছি... * আরেক কাপ কফি শেষ করে আমি ফিরে আসি মিতি আপার মুখোমুখি, ধানসিঁড়ি অ্যাপার্টমেন্টে, বিবিসির স্টুডিওর হিমঘরে।

মিতি আপা প্রতিভাবান পথশিশুদের ওপর বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদন করছেন ‌'প্রবাহের' জন্য। এ জন্য মানিকের সূত্রধরে খোঁজ পড়েছে আমার। শুরু হয় আমার সাক্ষাতকার গ্রহণ। আমিও আবেগ ঝেড়ে ফেলে পেশাদারের মতো গড়গড় করে বলতে থাকি: নব্বইয়ের দশকে কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ 'মন্দিরা' নামে ছোট একটি নগর বাউলদের গানের দল করেছিলেন। বিপ্লব চক্রবর্তী, জাহিদ হাসান ও বাহার ছিলেন সেই গ্রুপের।

এদিকে ময়মনসিংহের রেল স্টেশনে গান গেয়ে ভিক্ষে করে বেড়াতো এক টোকাই ছেলে মানিক। সে কোনো বাউল দলে গান শিখেছিলো। ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে বেড়াতে বেড়াতে মানিক চলে আসে ঢাকায়। ... মন্দিরা-গ্রুপের সঙ্গে কিছুদিন গান করে বেড়ায়। মঞ্চেও সে বেশ কয়েকবার গান করে প্রশংসা পেয়েছে।

এক ব্যাক্তি বাসায় রেখে তাকে গান শেখাতে চেয়েছিলো। কিন্তু মানিক সেখান থেকেও পালায়...ভাসমান পথশিশুদের বেলায় যেমনটা হয় আর কী। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর সে একটু বড় হলে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে। তখন সে রাতে থাকতো সূর্যসেন হলের ক্যান্টিন বয়দের সঙ্গে। আমি শুনেছি, এক রাতে ওর খুব জ্বর হয়েছিলো।

কিন্তু ছাত্রদলের ক্যাডাররা ওর কোনো কথা শোনেনি। ওকে তারা জোর করে ডাব পাড়তে গাছে ওঠায়। মানিক ওই অসুস্থ অবস্থায় বাধ্য হয়ে গাছে চড়ে। দূর্বল শরীরে হাত ফস্কে সে গাছ থেকে পড়ে যায়। ছাত্ররা ধরাধরি করে ওকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানান, মাথায় আঘাত পেয়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যূ ঘটেছে।

। ... * সম্প্রতি একটি সংস্থা 'তিনচাকার গান' নামে এক আয়োজনে রিকশাওয়ালাদের গান রেকর্ড করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই বাছাই পর্বের ওপর আমার এক সময়ের সহকর্মী মুন্নী সাহা 'এটিএন বাংলায়' করেন একটি বিশেষ প্রতিবেদন। নিউজটি দেখতে দেখতে এক কিশোর রিকশাওয়ালার উদাত্ত গানের গলা শুনে আমার মানিকের কথা মনে পড়ে যায়। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে, ওরই করা সেই গান: কে বলে পাগল, সে যেনো কোথায়, রয়েছে কতই দূরে/ মন কেনো এতো কথা বলে?/ পাগল মন, মন রে, মন কেনো এতো কথা বলে?/ আশি তোলায় সের হইলে, চল্লিশ সেরে মন/ মনে-মমনে একমন না হইলে, মিলবে না ওজন/ পাগল মন, মন রে, মন কেনো এতো কথা বলে? ... --- ছবি: বিমল দাস বাউল, সাহাদাত পারভেজ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।