আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্বিধা-২ (ধারাবাহিক)



আমি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে একাউন্টস ডিপার্টমেন্টের ইন-চার্জ। ন'টার মধ্যে অফিসে পৌঁছুতে হয় কিন্তু কখন অফিস থেকে বেরুতে পারবো, তা কেউ বলতে পারেনা। আমার সাব-অর্ডিনেটদের সবাই আমার কাছে বলেই অফিস থেকে কেটে পড়তে পারে। কিন্তু আমাকে বেরুতে হলে চেয়াম্যান স্যার মানে আবতাব উ চৌধুরী অথবা ডিরেকটর ম্যাডাম মানে ফারহানা ম্যাডামকে বলতে হয়। আমাদের অফিস আওয়ার প্রায় শেষ হলে চেয়ারম্যান স্যারের অফিস আওয়ার শুরু হয়।

ফারহানা ম্যাডাম ঠিকই সময় মতো অফিসে আসেন কিন্তু চেয়ারম্যান স্যারের কারণে ফিরতে হয় অনেক দেরী করে। চেয়ারম্যান স্যারের সারাদিন কাটে অন্যান্য ব্যবসায়িক অফিসগুলোতে। সুতরাং ডিরেকটর ম্যাডামকেই এই অফিসটি সামলাতে হয়। আর আমরা আটজন এইচওডি অর্থাৎ হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট ফারহানা ম্যাডামকে আগলে রাখি। একাউন্টস ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য কলিগরা হলো বশির সাহেব, হাবিব সাহেব, ফিরোজ সাহেব, শাহানা সুলতানা, তাহমিনা শিল্পী এবং পুজা সাহা।

সবাই যেন এক পরিবারের সদস্য। দিনের বেশিরভাগ সময় যেহেতু আমাদের একই সাথে কাটাতে হয়, সেজন্য একজন আরেকজনের প্রতি আপনজনের মতোই আচরণ করে। একজন আরেকজনের হাঁড়ির খবর পর্যন্ত জানে। মেধা এবং মেঘ এর ব্যাপারেও ওরা নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয়। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একজন আরেকজনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ওরা সবাই কাজের ব্যাপারেও খুউব হেল্পফুল। ওরা সবাই আমার পরামর্শ, নির্দেশনা মেনে চলে। আমাদের ডিপার্টমেন্টে একদম বসিজম চলেনা। ওরা আমাকে মেহেদিভাই অথবা ভাইয়া বলে ডাকে। ফারহানা ম্যাডাম শুধু আমাকে রহমান সাহেব বলে ডাকেন।

মেহেদী বলতে নাকি উনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। কারণ, ম্যাডামের বড় ভাইয়ের নাম নাকি মেহেদী। সুতরাং উনি আমার 'মেহেদী রহমান' নামের শেষাংশ রহমান সাহেব বলেই ডাকেন। সেদিন ছিলো রোববার। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম।

ধানমন্ডির বাসা থেকে বনানী অফিসে পৌঁছুতে প্রায় দেড়ঘন্টা লেইট। হন্ত-দন্ত হয়ে অফিসে গিয়ে শুনি ফারহানা ম্যাডাম ৩/৪ বার আমার খোঁজ করেছেন। ম্যাডামের রুমে ঢুকে দেখি ম্যাডাম বিরক্তমুখে কম্পিউটারে কি যেন করছেন। আমাকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। ওহ্ রহমান সাহেব, আসেন, বসেন।

খবর কিছু রাখেন? কিসের খবর ম্যাডাম? আশ্চর্য! আপনি এইচওডি, আর খবর রাখতে হচ্ছে আমাকে? ঠিক বুঝলামনা। একটু খুলে বলতেন যদি ম্যাডাম। মি. রহমান, ফিপটিন চেকস আর অলরেডী বাউন্সড। হোয়াট হ্যাপেনড? ফারহানা ম্যাডাম রেগে গেলে ইংরেজীতে বলতে থাকেন। হুইচ চেকস? আওয়ার ইস্যুড চেকস অর সাপ্লায়ার্স চেকস ম্যাডাম? সাপ্লায়ার্স চেকস।

বাট হোয়াই ইউ আর নট ইনফর্মড অ্যাবাউট দ্যাট? ম্যাডাম চেকগুলো আমার দিকে মেলে ধরলেন। অবাক ব্যাপার যে, চেকগুলো আমার কাছে ফেরত না এসে ম্যাডামের কাছে এলো কি করে? ম্যাডামের কাছে আসার আগে আমি এগুলোর খোঁজ খবর নিতাম। সাপ্লায়ার্সদের সাথে কথা বলে কারণগুলো উদঘাটন করতাম। সাপ্লায়ার্সদের পরামর্শ সাপেক্ষে প্রয়োজনে কিছু চেক আবার ব্যাংকে প্লেস করতাম। সবশেষে ম্যাডামকে পরিস্থিতি বুঝে জানাতাম।

কিন্তু কার কাজ এটা? কে আমাকে ডিঙিয়ে ম্যাডামের কাছে নিয়ে এলো ডিজ-অনারড চেকগুলো? ব্যাংকের সাইট তো বশির সাহেব দেখে। তাহলে কি ম্যাডামের কাছে আমাকে দ্বায়িত্বহীন বোঝানোর জন্য বশির সাহেব এই কাজটা করলো? ওকে ম্যাডাম। লেট মি চেক অল দ্যা ম্যাটার। ডোন্ট বি ওরিড। আই উইল ইনফরম ইউ লেটার।

ওকে। চেক এন্ড ইনফর্ম মি। চেকগুলো নিয়ে এসে আমার ডেস্কে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকলাম। ভাবলাম, বশির সাহেব গতকাল একটা লিভ ফর্ম নিয়ে এসেছিলো তিন দিনের ছুটি চেয়ে। আমি তাৎক্ষনিক এ্যাপ্রোভ না করে বলেছিলাম, ম্যাডামের সাথে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তবে কি বশির সাহেব সেই শোধ এভাবে নিলো? কাউকে কিছু বুঝতে দিলামনা। কিন্তু আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে অন্যরাও বুঝে ফেললো, সামথিং রং। অনেকদিন ধরে একসাথে কাজ করতে গিয়ে আমার আচরণ ওদের মুখস্থ। কখন মন খারাপ হয়, কখন মুডঅফ করি, কখন প্রফুল্ল চিত্তে থাকি। প্রথমে পুজা এগিয়ে এলো।

দাদা, মন খারাপ কেন? কোনো সমস্যা? কি হয়েছে? নাহ, ঠিক আছি। পুজার পেছনে যথাক্রমে হাবিব সাহেব, ফিরোজ সাহেব, শাহানা, শিল্পী এবং সবশেষে বশির সাহেব। সবাই আমাকে ঘিরে নিরীহ এবং অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বশির সাহেবের চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে, সে-ই অপরাধী। সবাইকে বসতে বলি।

বিষয়টা নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করি। বশির সাহেবকে জিজ্ঞেস করি, 'আপনি এই কাজটা করতে গেলেন কেন'? আমাকে ভুল বুঝবেন না, মেহেদিভাই। আপনার আসতে দেরী দেখে ম্যাডাম ফোন করে সবক'টা ব্যাংকের অবস্থা জানতে চাইলেন। ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং লেজার বুক নিয়ে ওনার রুমে যেতে বললেন। লেজার বুকের ব্যালেন্স এর সাথে ব্যাংক স্টেটমেন্টের ব্যালেন্স এর গড়মিল দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকলেন।

অনেকবার আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আপনি কোনো রেসপন্স করেননি। 'আমাকে ম্যাডাম কল করেছেন? কই আমিতো কোনো কল পাইনি'? বলেই মোবাইলটা হাতে নিলাম। ওমা, এ দেখি ৯টা মিসড কল এবং ১টি মেসেজ এসেছে। বাসে ছিলাম বলে টের পাইনি। সার্চ করে দেখি ম্যাডামের ৪টি, রুপোন্তির ২টি এবং আন-নোউন কল ৩টি।

মেসেজটি এসেছে রুপোন্তির ফোন থেকে। বশির সাহেব আবার শুরু করলো। 'ম্যাডাম অবশেষে ডিপোজিটেড চেক এবং কালেকশান চেকগুলোর অবস্থা জানতে চাইলেন। বাধ্য হয়ে বাউন্সড চেকগুলো দেখতে চাইলেন। ঠিক আছে, আপনি সাপ্লায়ার্সদের লিস্ট এবং স্টেটমেন্টগুলো আমাকে দেন।

দেখছি কি করা যায়। আর আপনারা যার যার কাজে যান। পুজাঃ এ ব্যাপারে আমরা কি কোনো সহযোগিতা করতে পারি, দাদা? হাবিবঃ হ্যা, ভাইয়া। আমাদের কোন কাজ দিতে পারেন। যেকোন কাজ।

শাহানাঃ আগে আপনি একটু ফ্রেস হয়ে চা-টা কিছু একটা খেয়ে নিন। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই আছিনা? শিল্পীঃ শাহানাপু ঠিকই বলেছে ভাইয়া। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। 'ঠিক আছে।

আপনারা যে যার ডেস্কে যান। প্রয়োজনে আপনাদের সহযোগিতা নেওয়া হবে। ' ফিরোজ সাহেব পরিস্থিতি হালকা করতে চাইলো। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলো। 'মেহেদিভাই, মেধা-মেঘ কেমন আছে? আর ভাবী? অনেকদিন হলো ওদের সাথে কথা হয়না।

মেধা কি এখনো পাকা পাকা কথা বলে?' সবাই ভালো আছে ফিরোজ সাহেব। ওদের ব্যাপারে পরে আলাপ করা যাবে। ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে মোবাইলের মেসেজটি ওপেন করি। রুপোন্তির ফোন থেকে মেসেজটি এলেও মেসেজের বক্তব্য মেধার। মেসেজটা শুরু হলো এই ভাবে, 'ফ্রম মেধা টু ডিয়ার সুইট বাবা: বাবা, হ্যাভ ইউ ফরগোট আস? মা ইজ রিবিউকিং আস এজ উই আর নট টেকিং ব্রেকফাস্ট।

বাবা প্লিজ কাম এন্ড সেভ আস। ডোন্ট ফরগেইট এবাউট টেন ডেইজ লিভ, আই লাভ ইউ টু মাচ, মাই সুইট বাবা'। মেসেজটি পড়ে আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। অফিসের এই পরিস্থিতিতে দশ দিনের ছুটি চাইবো কি করে? অফিসের এই ভারী পরিবেশটা আগে হালকা করতে হবে। তারপর পরিস্থিতি বুঝে, ম্যাডামের মুড বুঝে ছুটি চাইতে হবে।

ফারহানা ম্যাডামও মেধা আর মেঘকে খুউব আদর করেন। সেদিক থেকে অ্যাডভান্স অবস্থায় আছি। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।