আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের ক্রিকেট ব্যাট শিল্প

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের স্বরূপকাঠিতে গড়ে উঠেছে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির বহু কারখানা। দেশে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির পথিকৃত আবদুল লতিফ মিয়ার স্বপ্ন এখন শুধু দেশের চাহিদা পূরণ নয়, তৈরি করতে হবে বিশ্বমানের ক্রিকেট ব্যাট। তার বিশ্বাস প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রযুক্তি সহায়তা পেলে স্বরূপকাঠির তৈরি ক্রিকেট ব্যাট একদিন শোভা পাবে শচীন, শেবাগ, আফ্রিদি, রিকি পন্টিংদের হাতে। তবে আবদুল লতিফ মিয়ার এই স্বপ্ন পূরণ না হলেও ইতিমধ্যেই তার একাধিক সহকর্মী পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তার অন্যতম সহকর্মীর স্ত্রী নিলুফার ২০০৬ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলনে যোগ দেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে।

মানুষমাত্রই স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। আর এ স্বপ্ন তাকে কখনও কখনও পরিণত করে নতুন কোন সৃজনশীল কর্মের কারিগর রূপে। স্বরূপকাঠির এক অজপাড়াগাঁয়ের কারিগর আব্দুল লতিফ মিয়া বিশ্বমানের ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর এমনই স্বপ্ন দেখছেন, যা বিদেশে রপ্তানি হবে একদিন। বয়োজৈষ্ঠ এই কারিগরের স্বপ্ন অমূলক বা অলীক নয়। বাংলাদেশে প্রথম ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর কারিগর তিনি দেড় যুগ।

আগে ঢাকায় ক্রীড়া সরঞ্জাম মেরামত কারখানার হেড মিস্ত্রী স্বরূপকাঠির আব্দুল লতিফ মিয়া। আমদানীকৃত বিদেশী ক্রিকেট ব্যাটের সমমানের ব্যাট প্রস্তুতে এখন জীবনের শেষ দিনগুলো কাজে লাগাতে চান তিনি। স্বরূপকাঠি অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৬০টি ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর শতাধিক কারখানাসহ সারা দেশের আরও সমসংখ্যক অনুরূপ কারখানার পথিকৃৎও এ ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। যৌবনে ছিলেন কাঠ মিস্ত্রী। তার হাতে সূচিত দেশী ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর শিল্প ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এখন আর বাইরে থেকে সৌখিন ক্রিকেট ব্যাট আনতে হয় না।

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের বিন্না, উড়িবুনিয়া, জিলবাড়ী, খেজুরবাড়িয়া, গগণ, বয়া, ডুবি, কাটাখালীসহ নাজিরপুর ও বানারীপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম গত এক যুগে ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর গ্রাম হিসাবে নাম করেছে। দেশীয় নানা কাঠের সহজ প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে কাঠ ব্যবসার প্রসিদ্ধ এলাকা স্বরূপকাঠির পশ্চিম-উত্তর অঞ্চলে এ গ্রামগুলোতে ১৭/১৮ বছর ধরে বহু কারখানায় তৈরী হচ্ছে ক্রিকেট ব্যাট। প্রতিদিন শত শত ব্যাট এখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানে। স্থানীয় এসব ফ্যাক্টরিতে তৈরী দেশীয় কাঠের ব্যাটের কাঠামোকে বার্নিশ, লেমিনিটিং, হাতলে সিনথেটিক গ্রীফ সেটিং, স্টিকার সেটিং করে পরিণত করা হয় পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ব্যাটে। দেশে যে হাজার হাজার দেশীয় খেলনা ব্যাটের ব্যবহার তার জনক বেলুয়া নদীর তীর ঘেঁষে স্বরূপকাঠির নিভৃত গ্রাম দক্ষিণ উড়িবুনিয়ার অখ্যাত ছুঁতোর পরিবারের জন্ম নেয়া অতি দরিদ্র আব্দুল লতিফ মিয়া।

আব্দুল লতিফ ২৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে কাঠ মিস্ত্রী হিসাবে এক সময় খেলার সামগ্রী ব্যবসায়ী জুরাইনের ‘খেলার সাথী’ দোকানে কাজ পান। দোকানের মালিক সিরাজুল ইসলামের কারখানায় তিনি খেলার প্রাইজশীল্ড ও কেরামবোর্ড তৈরী এবং ক্রিকেট ব্যাট ও হকিষ্টিক মেরামত ইত্যাদি কাজ করতেন। সিরাজ মিয়ার কৌতূহলজনিত নির্দেশে তিনি আমদানীকৃত একটি ক্রিকেট ব্যাটের লেমিনিটিং, স্টিকার ও বার্নিশ তুলে ফেলেন এসিড দিয়ে। চিনে ফেলেন ব্যাট তৈরীর কলাকৌশল ও উপাদান। এরপরই কাঠ মিস্ত্রী লতিফের মাথায় চাপে ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর নেশা।

বিদেশী ব্যাটের কাঠ সেভাবে চিনতে না পারলেও তিনি বুঝতে পারেন হালকা ও অপেক্ষাকৃত নরম আঁশের কোন গাছের কাঠ হচ্ছে ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর মূল উপাদান। তিনি খুঁজে বের করেন সমমানের কাঠ দেবদারু। এ কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয় বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেট ব্যাটটি। এরপর ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রির দোকানের জন্য তিনি কদম, দেবদারু, বকাইন ইত্যাদি কাঠ দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট তৈরী করতে শুরু করেন। সস্তায় ব্যাট তৈরীর টার্গেট নিয়ে এক পর্যায়ে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন গ্রামে।

নিজ বাড়ীতে গড়ে তোলেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর কারখানা। ঢাকার বাইরে এটাই প্রথম প্রতিষ্ঠিত পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ব্যাট ফ্যাক্টরী। স্থানীয়ভাবে দেশীয় কাঠ যেমন- কদম, ছাতিম, বকাইন, আম, আমড়া ইত্যাদি সহজলভ্য হওয়ায় এসব কাঠ ব্যাট তৈরীতে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং উৎপাদন খরচও কম পড়ে। লতিফ মিয়ার কারখানাকে ভিত্তি করে ঢাকায় আমদানীকৃত ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি দোকানে স্থান পায় স্বরূপকাঠির ক্রিকেট ব্যাট। এক সময় ঢাকার চাহিদা পূরণ মাত্র একটি কারখানা থেকে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

শুরু হয় আরও কারখানা সম্প্রসারণের কাজ। এভাবেই কয়েক বছরের মধ্যে আশেপাশের গ্রামগুলোতে স্থাপন করে নতুন নতুন ব্যাট কারখানা। স্বরূপকাঠির পশ্চাৎপদ এলাকাও পরিণত হয় ক্ষুদ্র শিল্প অঞ্চলে। আব্দুল লতিফের নিজ গ্রাম বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই তার সূচিত ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর দেশীয় প্রযুক্তি এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

লতিফের সহকর্মী কালাম নিজ বাড়ীতে যে বিরাট কারখানা তৈরী করেছেন তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে। কালামের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন ২০০৬ সালের আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছিলেন স্বামীর ক্রিকেট কারখানার অন্যতম মালিক হিসাবে। কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে নিলুফা যোগ দেন নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি-দলের সদস্যা হিসাবে । পদক্ষেপ নামে একটি এনজিও’র ক্ষুদ্র ঋণ গ্রুপের সফল শিল্প উদ্যোক্তা নিলুফা। এ বছরই নিলুফা ঢাকায় সিটি গ্রুপ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার পান।

কানাডার সম্মেলন থেকে অন্যান্য পুরস্কার ছাড়াও নিলুফাকে চার হাজার ডলার নগদ অর্থ উপহার দেয়া হয়। বাংলাদেশী ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকার সমমানের এ উপহারের অর্থ দিয়ে কালাম-নিলুফা দম্পতি জমি কিনে নিজ বাড়ী ও ব্যাট কারখানার সামনে স্থাপন করেছেন একটি স-মিল ও রাইস মিল। কালামকে স্থানীয়রা ‘ব্যাট কালাম’ বলে ডাকে। এ দম্পতি ভগ্নিপতি তথা ওস্তাদ আব্দুল লতিফকে তাদের এ সুনাম ও প্রতিষ্ঠার প্রেরণা-পুরুষ হিসাবে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। স্মরণ করেন একইভাবে অন্যান্য ব্যাট কারখানার মালিকরাও।

আব্দুল লতিফ তার নিজের ব্যাট কারখানায় ম্যাচ ব্যাট তৈরীর সাধনায় ব্যাপৃত। সাধারণ দেশী অন্যান্য কাঠ দিয়ে এরকম উন্নতমানের ক্রিকেট ব্যাট তৈরী সম্ভব নয় বলে তিনি স্থানীয় ভাষায় ‘ভদভইদ্দা’ গাছের সন্ধান করছেন। পিটালী নামের এ গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ট্রিউইয়া-পলিকার্পা যা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে পিটকিরা, মেরা বা ডোডাইল নামে পরিচিত। লতিফের প্রত্যাশাঃ চাহিদানুযায়ী এক গাছ পেলে তিনি পর্যাপ্তভাবে তৈরী করতে পারবেন তার স্বপ্নের ক্রিকেট ব্যাট। সুত্রঃThe Daily Ittefaq( 06,20, 2008) রিপোর্টারঃনাসিম আলী


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.