আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোডম্যাপের গতি পরিবর্তন ও রাজনীতির ছাড়পত্র



রোডম্যাপের গতি পরিবর্তন ও রাজনীতির ছাড়পত্র ফকির ইলিয়াস ===================================== হঠাৎ করেই ঘুরতে শুরু করেছে বাংলাদেশের রাজনীতির চাকা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে বলেছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতে যেমন কাজ করেছে, ভবিষ্যতেও তেমনি কাজ করে যাবে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে আসার আগে বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করে এসেছেন। সরকার বলেছে, তার এই মুক্তি দুই মাসের জন্য। তবে প্রয়োজনে তা বাড়তে পারে।

প্রায় একইভাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। শেখ হাসিনার মুক্তির মেয়াদও চিকিৎসার প্রয়োজনে বাড়তে পারে। শেখ হাসিনার মুক্তির পর বেশ কিছু অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেছে জামায়াত-বিএনপি জোট। ভেবে অবাক হয়েছি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন, কি গোপন চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা মুক্তি পেয়েছেন তা রাষ্ট্রের জনগণ একদিন জানবে­ জানতে পারবে। এই খোন্দকার দেলোয়ারই কয়েক সপ্তাহ আগে হাসিনার মুক্তি দাবি করেছিলেন।

এখন হঠাৎ করেই বুলি পাল্টেছেন তিনি। বিএনপি মনে করেছিল শেখ হাসিনা মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই খালেদাকে মুক্তি দিয়ে দেবে বর্তমান সরকার। তবে সরকার বলেছে, খালেদাকে মুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে। তারপর তা বিবেচনা করবে সরকার। খালেদা জিয়া নিজের মুক্তি না চাইলেও তার দুই ছেলের মুক্তি দাবি করেছেন আর বিএনপির নেতারা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা মুক্তি পেয়েছেন, ঠিক একইভাবে খালেদা-তারেক ও কোকোকে মুক্তি দিতে হবে।

বিএনপি-জামায়াত ইতোমধ্যে একান্ত বৈঠকও করেছে কয়েক দফা। জামায়াতের স্বার্থ অন্যখানে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, খালেদার পর পর নিজামীকেও মুক্ত করে আনা। সব মিলিয়ে অবস্খা বেশ জটিলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বর্তমান সরকারের সমালোচনায় মাঠে নেমেছেন ড. কামাল হোসেন, ফেরদৌস কোরেশীর মতো নেতারা।

তারা বলছেন, বর্তমান সরকার তাদের নীতি থেকে সরে এসেছে। দেশ আবার ওয়ান-ইলেভেনের পূর্ববর্তী পরিস্খিতিতে ফিরে যেতে পারে। ফেরদৌস কোরেশীর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে স্পষ্ট বোঝা গেছে, শেখ হাসিনার মুক্তিকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। প্রায় একই কথা ব্যক্ত করেছেন ড. কামাল হোসেনও। যে যাই বলুক না কেন, কয়েকজন উপদেষ্টার প্রচেষ্টায় বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তাদের রোডম্যাপের একটি ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করতে চাইছেন তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

উপদেষ্টা এমএ মতিন বলেছেন, সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ও বিবেচনা করছে। কিন্তু তাকে আবেদন করতে হবে। এ বিষয়ে ‘গোঁ’ ধরে বসেছেন ‘আপসহীন’ নেত্রী খালেদা জিয়া। তার কথা হচ্ছে, তিনি আবেদন করবেন না। তাকে মুক্তি সরকারকে দিতে হবে এমনিতেই।

সরকার ইতিমধ্যেই জরুরি বিধিমালার বেশ কিছু আইনের সংশোধনী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংশোধনীর প্রকৃত বেনিফিসিয়ারি কারা হবেন তা স্পষ্ট হবে আরও কিছু দিনের মধ্যে। তবে এই সংশোধনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার যে কাউকে কাউকে ছাড়পত্র দেব তা অনুমান করছেন দেশের জনগণ। দুই. তারেক রহমানের মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন তার স্ত্রী জোবায়দা রহমান ও কন্যা জায়েমা রহমান। তারা তারেককে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর অনুরোধও জানিয়েছেন।

একটি সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমান মুক্তি পেলেই চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন খুব দ্রুত। সেখানে দলীয় শাখার নেতাকর্মীদের ব্যবস্খাপনায় তার চিকিৎসাও শুরু হতে পারে। তারেক রহমানের একটি ঘনিষ্ঠ মহল নিউইয়র্কে সে ব্যবস্খা নিয়ে রেখেছেন। অন্যদিকে আরাফাত রহমান কোকোর চিকিৎসার সব ব্যবস্খা দেশেই সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তবে অবস্খাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেটাই শেষ কথা নয়।

যে কোন সিদ্ধান্ত যে কোন সময়ই পরিবর্তিত হতে পারে। লন্ডন, নিউইয়র্কভিত্তিক প্রবাসীদের কয়েকজনের উদ্যোগে বিদেশে একটি সমন্বিত প্লাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিএনপির রাজনীতিতে বিশ্বাসী কিছু প্রবাসীর মতে, শেখ হাসিনা বিদেশে থেকে দল চালাতে পারলে, তারেক রহমান তা পারবেন না কেন? তারা চান তারেক রহমানও প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশে থেকে দল পরিচালনা করুন আগের মতো। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া তো দেশেই থাকছেন। যেহেতু শেখ হাসিনা আগে মুক্তি পেয়েছেন, তাই এখন রাজনীতির চাকা ঘুরছে তাকে ঘিরেই।

বিএনপি-জামায়াতের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যে যে সুবিধা পেয়ে এগিয়ে যাবে, চারদলীয় জোট তা অনুসরণ করেই এগুবে ক্রমশ। কথা হচ্ছে, নাইকো, গ্যাটকো মামলায় যদি শেখ হাসিনা-বেগম জিয়া ক্রমশ ছাড়পত্র পেয়ে যান তবে তো জামায়াতের নিজামীসহ অন্য মন্ত্রীরাও মুক্তির পথ খুঁজবে। আর এভাবে পর্যায়ক্রমে ওয়ান-ইলেভেন পূর্ববর্তী একটি পরিস্খিতির দিকে দেশ ক্রমশ ধাবিত হতে বাধ্য হবে। তিন সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে দুদকে ফিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, দুদক তার নিজস্ব গতি নিয়ে কাজ করে যাবে।

অন্য কোন সরকারি এজেন্সি দুদকের কাজকে প্রভাবিত কিংবা বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দুদক কারও বিরুদ্ধে মামলা করে সাক্ষী প্রমাণ, দলিলপত্র হাজির করার পরও বিচার বিভাগের আইনি প্রক্রিয়ায় যদি কেউ মুক্তি পেয়ে যায় তবে কি করতে পারবে দুদক? বর্তমান ছাড়পত্র প্রদানের প্রক্রিয়াগুলো তো সেদিকেই এগুচ্ছে। একের পর এক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আড়ালে থাকা উদ্দেশ্যগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে উঠছে জনগণের কাছে। তিন. বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের শিকড় তৃণমল পর্যায়ে গভীরভাবেই বিস্তৃত এবং সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, তাদের প্রয়োজনে প্রধান দুটি দল একে অপরকে সাহায্য করে, আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী চরম দুর্নীতি করেছিল বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুই একটা ‘আই ওয়াশ’ মার্কা মামলা ছাড়া বিশেষ কিছুই করেনি।

একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিল ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছ থেকে ক্ষমতা পাওয়ার পর। মোটামুটি একটা সমান্তরাল সম্পর্ক দুটি দল সব সময়ই বজায় রেখে এসেছে। ধর্মীয় মৌলবাদী দল ও মোর্চার সঙ্গে দুটি দলই নানা চুক্তি, আঁতাত করেছে নিজেদের সুবিধা মতো। আবার দরকার মতো তারা একে অন্যকে গালিও দিয়েছে লোক দেখাবার জন্য। যেমনটি খোন্দকার দেলোয়ার হাসিনার মুক্তির পরই বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন।

এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও খালেদা-হাসিনার বাকযুদ্ধ লক্ষ্য করেছে দেশবাসী। আক্রমণে শেখ হাসিনা সব সময় এগিয়েই থেকেছেন তা কোন দুর্মুখ ও স্বীকার করবেন অকপটে। ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনের সরকারের সব কাজের বৈধতা দেয়ার কথা বলে শেখ হাসিনা সমালোচিত হয়েছিলেন পটপরিবর্তনের পর পরই। খুবই পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, জামায়াত নামের অজগরটি এই দেশে তার বিষ দাঁত বাড়িয়েছে এই প্রধান দুটি দলের ছত্রছায়ায়। এখনও তারা স্রোতে ভেসে সুবিধা নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে।

গেল কয়েক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে এসেছিলেন জামায়াত নেতা কামরুজ্জামান। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেছেন, জামায়াতের কোন মন্ত্রী-এমপি দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে দল তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্খা নেবে। ’ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, গোলাম আযম বর্তমানে জামায়াতের কোন পদে আছেন? নেপথ্য তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রক তিনি? না হলে গোলাম আযমের নাম ধরে কেন দোহাই দিলেন কামরুজ্জামান? জামায়াত যে এখনও কুখ্যাত রাজাকারদের দখলে এ সাক্ষাৎকার তারই প্রমাণ করছে। এটা প্রায় নিশ্চিত যে কোন সময় মুক্তি পারেন খালেদা, তারেক, কোকো। তাদের পথ ধরে আরও কেউ কেউ কি মুক্তির তালিকায় আছেন? তা বোঝা যাবে ক্রমশ।

ওয়ান-ইলেভেনের রোডম্যাপ তার গতি পরিবর্তন করেছে। এখন তা চলছে অনেকটা টর্নেডোর মতো। বাঁক কোন দিকে ফিরাবে, কোথায় আঘাত হানবে তা বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। ছাড়পত্র দেয়ার নামে এই গতি পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য এখনও অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে। নিউইয়র্ক, ১৭ জুন ২০০৮ ---------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ ।

২০ জুন ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।