আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলচ্চিত্রঃ ব্রিক লেন

mostafizripon@gmail.com

'ব্রিক লেন' ব্রিটেনের দুই প্রজন্মের অভিবাসীদের নিয়ে তৈরী অসাধারন একটি চলচ্চিত্র। সদ্য কৈশর উত্তীর্ণ নাজনীন লণ্ডনে পাড়ি জমায় স্বামীর হাত ধরে। পেছনে ফেলে আসে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, ক্ষেতের আল ধরে ছুটে চলা দূরন্ত জীবন- যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তারই একমাত্র সহদরা। নাজনীন যেন সেই চারাগাছ যাকে ব্রিক লেনের লাল ইটের মাঝে উপড়ে এনে বসানো হয়েছে- যে অপরিসর জানালার ফাঁক দিয়ে পৃথিবীকে দেখে, আর ফেলে আসা সবুজ মাঠের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে। প্রতিবেশীর দরজায় বখাটে ব্রিটিশদের গালিগালাজ- 'বেজন্মা পাকিস্তানী, দেশে ফিরে যা', কিংবা ব্রিটিশ নারীর উল্কিআঁকা শরীর, অথবা ঘরে ফেরার পথে একঝলক দেখা প্রতিবেশীর মদ্যপানের দৃশ্য- নাজনীনকে ব্রিটিশ ভাবতে বাধা দেয়।

ব্রিক লেনে নাজনীনের বাড়ী, কিন্তু এটি যেন তার বসতভিটা নয়। তার জীবন থমকে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশে- যে জীবনের সাথে একমাত্র যোগসূত্র ছোটবোনের চিঠি। ছোটবোনের 'সাত সাগর আর তের নদী পাড়ের রাজকন্যা' আর দশটা বাঙালী নারীর মতোই স্বামীকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে, হয়তো সেটি এক বিশেষ ধরনের ভালোবাসার জীবন- কিন্তু তা নিতান্তই দরকারি ভালোবাসা। দুই কন্যাকে মানুষ করা, স্বামীর সেবাযত্ন, প্রয়োজনে বাজার করতে যাওয়া- এই নাজনীনের জীবন- সেখানে ঘর আছে, দিগন্ত নেই। যে বোনের চিঠির জন্য নাজনীন অপেক্ষা করে, যার সাথে সতের বছর দেখা নেই- সে-ই শুধু অদরকারের ভালোবাসা হয়ে নাজনীনের মুখে ঝলমলে হাসি ছড়ায়।

ছোটবোন তার গোপন কথা বলে, প্রাণের কথা বলে সেসব চিঠিতে। বোনকে বলার মতো অনেক গোপন কথা নাজনীনেরও জমা হয়ে গেছে এতদিনে। সে বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্নদেখে; কিন্তু স্বামীকে জোড় দিয়ে কথাটা বলতেও পারেনা। নাজনীন সেলাইয়ের কাজ শুরু করে। বোনকে দেখতে যাবে- সে পয়সা জমায়।

তার চাকুরী হারানো দার্শনিক স্বামী শুরুতে এটিকে সহজে মেনে না নিলেও চুপ করে থাকে। নাজনীন প্রেমে পড়ে একদিন। যে ছেলেটি সেলাইয়ের কাজ দিত তাকে, তার ভালোবাসা নাজনীনের জীবনে লাল চুমকি বসানো পোষাকের আলো ছড়ায়। এরই মধ্যে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনায় ব্রিটেনের মুসলিম অভিবাসীরা সাদা চামড়ার মানুষদের সন্দেহ আর প্রতিহিংসার শিকার হতে থাকলে ছেলেটি ইসলামপন্থী আন্দোলনে যোগ দেয়। নাজনীন ছেলেটিকে একসময় ফিরিয়ে দেয়- যার কাছ থেকেই সে ভাবতে শিখেছে- ব্রিটেনই আমার বাড়ী।

নাজনীনের বড় মেয়ে শাহানা বাবার ধমকে 'আমার সোনার বাংলা'র ইংরেজী তর্জমা মুখস্ত করলেও তাতে আনন্দ পায়না। আহমেদ সাহেব ভুলে যান তাদের সন্তান বাঙ্গালী নয়, ওরা ব্রিটিশ। বড় মেয়েটি জিন্সপ্যাণ্ট পছন্দ করে বলে তিনি তাকে মেমসাহেব বলে ডাকেন। বাংলাদেশী উচ্চারণে এবং ভুল ইংরেজীতে মেয়েকে শাসন করতে গেলে মেয়ে তাকে ইংরেজীটি ঠিক করে দেয়; আহমেদ সাহেব ঘোষনা দেন, 'আজ থেকে বাড়ীতে ইংরেজী বলা বন্ধ। ' এমন অনেক ছোট ছোট ঘটনায় ধরা পড়ে যায় প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী আর তাদের সন্তানের মধ্যকার সাংস্কৃতিক দূরত্ব কতটুকু।

প্রকাশ পেয়ে যায় নাজনীনের মতো আহমেদ সাহেবও ব্রিকলেনে বেঁচে আছেন, কিন্তু তার শেকড় এখানকার নয়- বাংলাদেশের। আহমেদ সাহেব সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে একেবারে দেশে ফিরে যাবেন। বাবার সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেয়ে শাহানা বাড়ী থেকে পালায়। নাজনীন তাকে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনে, আর স্বামীকে বলে দেয়- সে তার মেয়েদের নিয়ে লণ্ডনেই থাকবে, ব্রিক লেনই তার বসতবাড়ী। আহমেদ সাহেব বুঝতে পারেন, নাজনীন তার সেই 'ভিলেজ গার্ল' নয় আর; তার উড়বার আকশটুকু এখানেই; তার পরবাসই তার সন্তানদের মাতৃভূমি।

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে 'ব্রিক লেন' ছায়াছবির গল্প এটুকুই। টানটান উত্তেজনার কোন কাহিনী নয়, এটি প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের জীবন নিয়ে চিত্রিত সাধারন গল্প। বাংলাদেশের গ্রামের অতি সাধারন এক নারীকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে সে গল্প, যার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে শিশির মাখা এক কৈশরের পদ্য- যে পায়ে পায়ে পাড়ি দেয় সাত সাগর আর তের নদী, তাড়াতে চাইলেও পিছু ছাড়েনা। ব্রিক লেন ছবির শেষ দৃশ্যটি অসাধারন কাব্যময়। দুই প্রজন্মের তিনজন নারী উঠোনের তুষারে একটি তারকার আকৃতিতে শুয়ে 'স্নো এঞ্জেল' বানাচ্ছে, ওপরে খোলা আকাশ।

আহ মুক্তি, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ! ব্রিক লেন ছবিটি শুরু হয়েছিলো শিশির ভেঁজা ধানক্ষেতের দৃশ্যে এক কিশোরীর বিমুগদ্ধতা দিয়ে; আর শেষ হয়েছে লণ্ডনের তুষারপাতে পরিনত এক নারীর মুক্তির আনন্দকে ঘিরে। পরিচালক সারা গেভ্রন চমৎকার কাহিনী বুনেছেন সেলুলয়েডে। বিষন্ন কিন্তু অনিবার্য ভালোলাগা সূচনা সঙ্গীতে কিসের বার্তা আমার জানা হয়নি, কিন্তু আমি আবিষ্ট হয়েছি। অভিবাসী নাজনীনের স্মৃতি পিপিলিকারা- দিগন্তজোড়া মাঠে, বৃষ্টিস্নানে অবোধ্য অথচ অসাধারন কবিতার মতো ঘুরপাক খায়; 'ইস্ট ইজ ইস্ট' কিংবা 'বেণ্ড ইট লাইক বেকহাম' যেখানে মাথাকুটে মরবে। _____________________________________________ ব্রিকলেন চলচ্চিত্রকে নিয়ে আরো লেখা- ইরতেজা আলী'র চলচ্চিত্র সমালোচনাঃ ব্রিকলেন Click This Link


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।