আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওই কাব্যকথা, ওই গল্পকথা, ওই সুরগান, ওই প্রেমকলা, ওই (...), (...)

প্রতিদিনকার চলা মমি করে রেখে যাই ওয়েবের পিরামিডে

বাসায় খেয়ে বইপাড়া বলে খ্যাত শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে কুলি ফেলা বা ওখানে ঘেমেনেয়ে একশেষ হয়ে বাসায় ফিরে স্নানঘরে ঢোকার অভ্যেসটা বছরকয়েক (১৯৯৭-২০০৪) খুব গেড়ে বসেছিল আমার মধ্যে। এমন নয় যে অন্যসময়গুলোতে আর ওখানে একেবারেই যাওয়া হয় নি। যাওয়া তো শুরু হয়েছে সেই ১৯৯৪ থেকেই। ২০০৪-এর পরেও যাই, যেতে হয়, কিন্তু প্রতিদিন যাওয়াটাকে এখন আর আবশ্যিক জ্ঞান করি না একদম। ওখানে এখনো যাওয়া লাগে মনের খাদ্য বই-সিডি সংগ্রহে।

সেটার জন্য প্রতিদিন যাওয়া কোনোভাবেই জরুরি নয়। লক্ষণীয় যে, একটা বয়সে এসে নিয়মিত শাহবাগী প্রায় সব আড্ডারুরই কমবেশি প্রায় একইরকম অবস্থা হয়। অনেকেই হয়ত একসময় ভাবেন যে, প্রতিদিন শাহবাগে যাওয়া মানে সময়ের অপচয়। কেন এরকম মনে হয়? সে প্রশ্নের কিছু জবাব খুঁজে দেখবার চেষ্টা করা যাক। ১. বয়স যে বেড়ে যাচ্ছে, একটা বয়সে এসে এটা আর কারো মনে করিয়ে দিতে হয় না।

নিজে নিজেই মনে পড়ে। এই ভাবনাটা হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখে। চাকুরি, সংসার, সন্তান ইত্যাদির দাবি মিটিয়ে যে এক-আধ ঘণ্টা সময়ও বাঁচে, সেটা পড়ে-লিখে বা অন্য কোনো কাজ করে ব্যয় করাই প্রয়োজনীয় মনে হয়। ২. অনেকেরই আড্ডা দেবার পন্থা বদলে গেছে। অনেকেই এখন ঘরে বসে নেটে-চেটে আড্ডা দেন।

এ জগৎ আরো অনেক বড়ো। ব্যস্ততাও বেশি। একান্ত রক্তমাংসের মানুষের সাথে আড্ডা দরকার হলে সময়, তারিখ, স্থান পূর্বাহ্নে নির্দিষ্ট করে নেবার চেষ্টা চলে। ৩. সমসময়ের লেখক-শিল্পী, যাদের সাথে তুই-তুকারি সম্পর্ক ছিল, গেলেই আর তাদের সবার দেখা পাওয়ার সুযোগ নেই। প্রত্যেকের জীবনই হয়ত একটা কিনারা খুঁজে পেয়েছে, অথবা কিনারার খুঁজে চলছে মরিয়া প্রয়াস।

কাজেই তাঁরা আর বন্ধুদর্শনে আদুপুররাত শাহবাগে বসে থাকেন না। ৪. ওপাড়ার নিত্যদৃশ্য মানুষজনকে চিনে নেবার যে কৌতূহল ছিল, সেটা ফুরিয়ে এসেছে। নতুন করে হয়ত আর চিনে নেবার ইচ্ছেটাই জীবিত নেই। ভাবনা হয়ত এরকম যে, 'আমাকেই অন্যেরা চিনে নিক'। ৫. একসময় শাহবাগকে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ভাবলেও কালে সে ভাবনায় বদল এসেছে।

অর্থাৎ নিত্য একবার শাহবাগের মাটি স্পর্শ না করলেও সাহিত্যের মেইল ট্রেন ফেল করার সম্ভাবনা নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। (বলাই বাহুল্য, এপাড়ায় নিজের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে এমনদের ক্ষেত্রে এসব অনুমান প্রযোজ্য নয়) আমরা সবাই জানি, আজিজ সুপার মার্কেট চালু হবার আগে পিজিচত্বরই হয়ে উঠেছিল তরুণ শিল্পকর্মীদের মিলনস্থল। কবিতা-গল্প-চিত্রকর্ম-আবৃত্তি-গান-নাটক-সিনেমার শিল্পোষ্ণতা এবং গাঁজা-ভাং-মদ-পেথেড্রিন-ফেনসিডিল-হেরোইনের অসুস্থতায় সরগরম থাকত ওই হাসপাতাল চত্বর। মার্কেট চালু হবার পরে ক্রমশ যা এদিকে ঝুঁকে আসে।

এটা শুরু হয়েছিল আশির দশকে। ক্রমে এ তল্লাটে আশির শিল্পসাহিত্যকর্মীরা কমতে থাকে ও বাড়তে থাকে তাঁদের পরবর্তীরা অর্থাৎ নব্বইয়ের কর্মীরা। যথারীতি এরাও একসময় কমতে শুরু করে, শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় শূন্যের। এই তো শূন্যের হাট সবে ভাঙতে লেগেছে, জমে উঠছে তাদেরও পরে শুরু করা অতিতরুণদের জমজমাট আসর। যাঁরা একসময় প্রতিদিন আসতেন অথচ এখন আসেন কালেভদ্রে, তাঁদের কাউকে কাউকে 'এখন আর আসেন না যে বড়ো!'-- এরকম প্রশ্ন করে চোখের দিকে তাকালে যে জবাব পাওয়া যায় তা হলো, এখন আর আগের মতো আড্ডা জমে না ('কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই' ধরনের)।

সন্দেহ নেই, এটা ডাহা মিথ্যা এক। আড্ডা ঠিকই জমে, এমনকি আগের চেয়ে বেশিই জমে, সেটা কলকাতার কফি হাউজে যেমন তেমনি আজিজ মার্কেট, শাহবাগ মোড়, পিজি প্রেমিজ, টিএসসি, চারুকলা সর্বত্রই। কেবল বদলে যায় আড্ডার মুখ, মুখের অভিব্যক্তি। কালে কালে এই-ই হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়ত এ প্রক্রিয়ায় বড়ো কোনো বদল হবে না। আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমরা পুরানো নিয়মিতরা হয়ত আজিজ মার্কেটের দিনগুলো-রাতগুলোকে সবাই মিস করি খুব।

ওই কাব্যকথা, ওই গল্পকথা, ওই সুরগান, ওই প্রেমকলা, ওই (...), (...)-- আর হবে কি আমাদের! হায়!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।