আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার নানি



আমার নানীর কথা আজ মনে পড়ছে ভীষণভাবে। আমার নানি একটা লাল টুকটুকে নাতবউ দেখার জন্য অপেক্ষা করত। শুধু বলত, তোর পড়া কবে শেষ হবে রে! চাকুরী করবি কবে? বলত, শোন একটা ভাল চাকুরী করে লাল টুকটুকে একটা বউ নিয়ে আসবি। সবাই যেন তোর বউ দেখে হিংসা করে। বউটাকে নিয়েই আবার সারাদিন থাকিস না , তাহলে চাকুরী থাকবে না।

আর বছরে অন্ততঃ একটা মাস আমার কাছে তোর বউটাকে রাখবি। আমার লেখাপড়া শেষ হল, চাকুরীও একটা পেলাম। ভাল কিনা জানিনা, অনেকেই বলছে বেশ ভাল চাকুরী। হয়ত বিয়েও করব কিছুদিন পর, লাল টুকটুকে হবে কিনা- জানিনা, হতেও পারে। কিন্তু আমার নানি, বয়সের ভারে বেঁকে যাওয়া জবুথবু নানি আমার আজ নেই তার লাল টুকটুক নাতবউটির গাল টিপে দেয়ার জন্য।

আমার নানি, নানাবাড়িতে আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল যে। আমার খাওয়া গোসল, বেড়ানো থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি নড়াচড়ার দিকে যার ছিল অনন্ত আগ্রহ, খেয়াল- খবরদারীও ছিল অসীম। আমার জাম পেড়ে খাওয়া, আমগাছে ওঠা কিংবা দেশলাই বাক্সের তাস আর মার্বেল খেলার উপর নিষেধাজ্ঞা কিংবা খেলায় জিতলে তার কাছেই সেগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া সবকিছুই ছিল তার শখের মত। কিংবা আরও ছেলেবেলায় আমাকে হাতে ধরিয়ে লেখা শেখানো আর প্রতিটি অক্ষর লিখতে শেখার জন্য আলাদা পুরস্কার। আহারে আমার নানি! আমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাপ্তি কিংবা অর্জনগুলো যার কাছে ছিল সীমাহীন আনন্দের বিষয়।

আমার ছোট্ট প্রাপ্তি তার ছোট্ট বুকের বিশাল স্নেহমাখা হৃদয়ে আলোড়ন তুলত, উচ্ছ্বাস উপচে পড়ত তার চোখেমুখে। আমি বহুদিন কারো জন্য পান গুড়ো করিনা। দু'তিনটি পান আর অর্দ্ধেক কাঁচা সুপারি একসাথে করে একটা লোহার পাত্রে রেখে আরেকটি লোহার বার দিয়ে অনকক্ষণ ধরে ছেঁচে গুড়ো করতাম সম্পূর্ণভাবে। তার হাতে দেয়ার পর সামান্য পেতাম নিজের জন্য। মার বকুনি উপেক্ষা করে সেই পান খাওয়ার বিষম সুখ আর পাই না বহুদিন।

কোন একটা অকান্ড বাঁধিয়ে মার হাতে মার খাওয়ার আগেই নানির কাছে গিয়ে লুকানোর পর উল্টো মাকে ঝাড়ি খাওয়ানোর মিষ্টি অপরাধও করিনা বহুদিন। আমার নানি, শুধুই আমার নানি। গন্ডাখানিক ছেলে আর গন্ডাখানিক মেয়ের অগণিত নাতি-নাতনীর মাঝে আমি তার সোনার মানিক। ছোট মেয়ের একটিমাত্র ছেলে বলেই (তখনও আমার ছোট বোনের জন্ম হয়নি) হয়ত একটু (!) বেশী আদর পেতাম। বড় হয়ে যখন আমার অন্যান্য মামাতো- খালাত ভাইবোনদের জিজ্ঞাসা করতাম যে আমি তাদের চেয়ে বেশী আদর পেয়েছি কি-না তখন তারা দুদিকেই মাথা নাড়াত।

ছোট্ট একটুখানি শরীরের আমার নানির এত মমতা কোথায় লুকানো থাকত। কারও মুখেই নেই তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ। তার বুদ্ধির কথা এখন মাঝেমাঝেই শুনি আমার বড়মামার কাছে। সবাইকেই অসাধারণ দক্ষতায় ম্যানেজ করে নেয়ার এত ক্ষমতা আল্লাহ্ তাকে কিভাবে দিয়েছিল তা আল্লাহ্ই জানেন। অথচ ছিলেন একটি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে পরে একজন পাড়াগাঁয়ের বধু।

তার ধর্মভীরুতা কিংবা ইবাদত-বন্দেগীর কথাও সবার মুখে মুখে। তিন বছর আগের কোরবানী ঈদ। দুপুর বেলা খবর পেলাম নানি ভীষণ অসুস্থ। বারবার ছোট মেয়ে অর্থাৎ আমার মা'কে দেখতে চাচ্ছেন। আমার মামা সেই খবরটি চেপে গেছেন এই চিন্তায় যে এতদূর (সিরাজগঞ্জ থেকে নীলফামারী) থেকে সেদিন আর যাওয়া সম্ভব ছিল না বিশেষ করে ঈদের দিন।

পরদিন আমরা রওনা দিলাম সকাল বেলা ঈদের পরদিন বলে পাওয়া যাচ্ছিল না কোন বাস কিংবা অন্যকোন বিকল্প। যেতে যেতে রাত এগারোটা বাজল। নানি তখনও বেঁচে আছেন ধুকপুকিয়ে কোন রকমে। আমি দেখলাম কয়েকটি হাড় একসাথে পড়ে আছে একটি চামড়ার বেষ্টনীর ভেতর। কাউকেই চিনতে পারছিলেন না।

মাকেও না। সাতদিন কোন খাবার কাননি। স্যালাইন দিতে রাজী হননি, বলেছিলেন তার মরার সময় হয়ে গিয়েছে। পরদিন মাকে চিনতে পারলেন। একটু কথাও বললেন ইশারায়।

সবার ঈদের আনন্দ একটি কষ্টের দানায় পরিণত হয়েছে নানীকে ঘিরে। তারও একদিন পর অর্থাৎ এমরা যাওয়ার দু'দিন পর সন্ধায় আমার কোলে মাথা রেখে শখের দুনিয়া ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন আমার নানি। আমার ছোটমামা যিনি সারাজীবন মানুষকে উপদেশ দিয়েছিলেন মানুষের মৃত্যুতে না কাঁদার তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বড়খালা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। আর সদা স্থির আমার বড়মামার চোখ দিয়ে ঝড়তে লাগল অঝোর ধারা।

এক ছায়াময় বৃক্ষের নির্দয় কর্তনে বিহ্বল হয়ে পড়ল একটি পরিবার একটি গোত্র। ছিন্ন হল একটি বন্ধনের অদৃশ্য অবলম্বন। আমার অনুভূতিশুন্য মনে হচ্ছিল নিজেকে। আজ কেন যেন স্মৃতিগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে কান্না হয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে আমার নানির কথা মনে পড়তেই। হে পরম করূণাময় আমার নানিকে চিরশান্তি নসিব কর।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।