আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পোস্টমর্টেম: শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা নিরাপত্তা(!)হীন

( লেখাটি এর আগে সরব ডট কম 'এ প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের অনুরোধে এখানে রিপোস্ট দিলাম) হঠাৎ করেই দিন কয়েক আগে টেলিভিশন চ্যানেলে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের একটা সংবাদ চোখে পড়লো। সেখান থেকে যা জানলাম তার সারকথা হলো, মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের মর্যাদা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের কোন নিরাপত্তা নেই- না জীবনের, না সম্মানের। মা-বাবার কাড়ি কাড়ি অর্থ বা প্রতিপত্তি নেই বলে যাদেরকে মেধার লড়াই করে দূর-দূরান্ত থেকে মেডিকেল কলেজে পড়তে আসতে হয়, তাদের এই নিরাপত্তাহীনতার আহাজারি শুনতে অসম্ভব কষ্ট হলো। এমনিতেই আজকাল পেপার খুললে ধর্ষণের ঘটনায় মেয়েদের কষ্ট পেতে দেখি, তার উপর ডাক্তার সাজিয়ার অকাল মৃত্যুর পর খুব বেশিদিন পার হয় নি- এরই ভেতর আবারো মেডিকেল কলেজের ঘটনা এবং ছাত্রীদের অপমানিত হবার কাহিনী দেখে ভয়ঙ্কর এক ক্ষোভ জন্মালো ভেতরে ভেতরে।

আর তাই লিখতে বসে গেলাম শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের লাঞ্ছিত হবার কথা। সূত্রপাত- ** এক মাস আগের ঘটনা ঘটনার সূত্রপাত হয় মাসখানেক আগে। মেডিকেল কলেজের ৪০তম ব্যাচের তিনজন ছাত্রী নিয়মানুযায়ী নতুন ছাত্রী হলে সিট পাবার পর থেকে। নিয়ম মেনে তারা যে রুমটিতে সিট পেয়েছিলো, সেটি পছন্দ হয় ৪২তম ব্যাচের বিশেষ এক ছাত্রীর যে কিনা তাদের চেয়ে দুই বছরের জুনিয়র। তবুও তার আলাদা প্রভাব থাকায় তার পছন্দের মূল্য দিতে গিয়ে ভুগতে হচ্ছে এখন পুরো মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের! কারণ কারণ ৪২তম ব্যাচের সেই ছাত্রী মেডিকেল কলেজ ছাত্রকল্যাণ পরিষদের (ছাত্রলীগের গঠন করা পরিষদ) উপ-সহসভাপতির (প্রো-ভিপি) বান্ধবী।

জানা গেছে, বান্ধবীর আবদার রক্ষার্থে প্রভাব খাটিয়ে ২০২৩ নাম্বার রুমটি ছেড়ে দেবার জন্য ঐ রুমের তিনজন ছাত্রীকে প্রায় এক মাস ধরে হুমকি দিয়ে আসছে তার লোকজন। এ কারণে বেশ কয়েকবার তারা শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের শরণাপণ্ন হয়েছিলেন। তারা অনুরোধ করেছিলেন যেন তাদের তিনজনকে অথবা ৪২তম ব্যাচের ঐ মেয়েটিকে ২০২৩ নাম্বার রুম বদলে অন্য কোন রুম দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ তাদেরকে তখন যথাসাধ্য সাহায্য করবার আভাস দেন এবং ঐ মেয়েটিকে হলের অন্য যে কোন শূন্য রুম পছন্দ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু পুরো হলে তার একটিমাত্র রুমই পছন্দ হবার কারণে শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

**২০ জানুয়ারি, ২০১৩ (রবিবার) দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করে রোববার আনুমানিক রাত সাড়ে ১২টার দিকে- ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সহসভাপতি আবুতালেব মো. আবদুল্লাহ এবং উপ-সহসভাপতি আবদুল্লাহ বাকি অনুমতি ছাড়া ছাত্রীনিবাসে ঢুকে ২০২৩ নাম্বার রুমের খোঁজে প্রায় প্রতিটি রুমে কড়া নাড়বার পর। (প্রথম আলো ২২ জানুয়ারি, ২০১৩এর রিপোর্ট দ্রষ্টব্য) জানা গেছে, ২০২৩ নাম্বার রুমের তিনজন ছাত্রীকে তারা এক ঘণ্টার মধ্যে রুম ছাড়ার হুমকি দেন। এসময় হলের ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরেও তারা কেউ সেখানে যান নি। প্রথম আলোকে পরিষদের ভিপি বলেন, “অনেক ছাত্রীর নামে কক্ষ বরাদ্দ না থাকলেও তাঁরা কিছু কক্ষ দখল করে রেখেছেন। তাঁদের অন্য কক্ষে যেতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কথা বলতে রাত ১০টায় তিনি ছাত্রীনিবাসে গিয়েছিলেন। তবে তিনি তিন বা চারতলায় ওঠেননি। ” নিউ এজ পত্রিকায় ২২ জানুয়ারি, ২০১৩তে প্রকাশিত হয় যে ভিপি হোস্টেল সুপার-ইন-টেন্ডেন্ট এবং হোস্টেল সেক্রেটারির অনুমতি নিয়েই ছাত্রী হলে প্রবেশ করেন, কিন্তু তিনি নিচতলার গেস্ট রুমে অপেক্ষা করেছিলেম, তিনতলায় যান নি। অন্যদিকে প্রো-ভিপি প্রথম আলোকে জানান, “আমি সেখানে যাইনি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রীরা।

” **২১ জানুয়ারি, ২০১৩ (সোমবার) ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো, কিন্তু হয় নি। সোমবার সকালে তারা অধ্যক্ষের কাছে তাদের নিরাপত্তার দাবী জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। ছাত্রীদের বিক্ষোভের খবর শুনে সেই রাতেই আবারো তাদেরকে হুমকি দেয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। তারা হকি স্টিক নিয়ে ছাত্রী হলে অনুপ্রবেশ করে ভীতি প্রদর্শন করলে ছাত্রীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশ ও সাংবাদিকদের সাহায্য চান। পুলিশ চলে আসার পরে তারা ছাত্রী হলে বাইরে থেকেই তাদের উদ্দেশ্যে বাজে মন্তব্য করতে থাকে।

খবর পেয়ে অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের একটি দল এলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। কালের কণ্ঠ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৩এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, ছাত্রীরা বিক্ষোভ করতে ক্যাম্পাসে বেরোতে চাইলে কলাপসিবল গেটে তালা মেরে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। ছাত্রীরা তালা ভেঙে বের হয়ে ওই রাতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। এ সময় অধ্যক্ষ মো. শহিদুল আলমসহ কলেজের শিক্ষকরা ঘটনার বিচারের আশ্বাস দিলে ছাত্রীরা হোস্টেলে ফিরে যান। **২২ জানুয়ারি, ২০১৩ (মঙ্গলবার) মঙ্গলবার সকালে ছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে মুখে কাপড় বেঁধে মানব বন্ধন করে।

উল্টোদিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করে এবং একটি কক্ষে তালা লাগিয়ে অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রাখে। ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পর আনুমানিক দুপুর ২টায় বরিশাল সিটির মেয়র অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরন শিক্ষকদের উদ্ধার করেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য এক সপ্তাহ সময় চান। (কালের কণ্ঠ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৩ দ্রষ্টব্য) ছবি সূত্র: ডেইলি নিজ এজ যে প্রশ্ন মনে আসে- * এতদিন জমি-বাড়ি-সম্পত্তি নিয়ে অনেক কোন্দলের কথা শুনেছি কিন্তু হলের সামান্য একটা রুম নিয়ে এত বড় কাহিনীর কথা এবারই প্রথম শুনলাম! একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্র পাঁচ বছরের জন্য পড়তে এসে পছন্দনীয় রুম দাবী করার কথাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? এটা কি নিছকই একজন ছাত্রীর রুম ভোগ-দখলের অধিকার ফলাবার চেষ্টা নাকি বন্ধুত্বের সুবাদে তার প্রতিপত্তি দেখাবার সুপ্ত ইচ্ছার প্রকাশ? * ২০২৩ নাম্বার রুমটি যারা নিয়ম অনুযায়ী পেয়েছে, তারা নিতান্তই সাধারণ ছাত্রী। তারা যখন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদেরকে অথবা ঐ ছাত্রীকে অন্য রুম দেবার জন্য অনুরোধ করলো, তখন কর্তৃপক্ষ সেই ছাত্রীর বিশেষ প্রভাব আছে জানা সত্ত্বেও কেন তাদেরকে অন্য রুমে স্থানান্তর করে নি? তাহলে জল অন্তত এতটা গড়াত না। * প্রথম আলো এবং নিউ এজ’এর রিপোর্টে থেকে জানা যায় যে রবিবার রাত সাড়ে ১২টায় ভিপি ছাত্রী হলের গেস্টরুমে অপেক্ষা করছিলেন এবং তিনতলায় যান নি।

অথচ নিউ এজ’এর রিপোর্টেই ছাত্রীদের কাছ জানা গেছে যে তারা সেই রাতে ছাত্রী হলের অনেকগুলো (প্রায় ৪০টি) রুম নক করে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৪০টি রুমে থাকা ছাত্রীরা তাদেরকে স্বচক্ষে ছাত্রী হলের ভেতরে দেখেছে! * প্রথম আলোকে ভিপি আরো জানান যে তিনি হোস্টেল সুপার-ইন-টেন্ডেন্ট এবং হোস্টেল সেক্রেটারির অনুমতি নিয়েই ছাত্রী হলে প্রবেশ করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, হোস্টেল সুপার-ইন-টেন্ডেন্ট এস এম সারোয়ার এবং হোস্টেল সেক্রেটারি নূপুর পাল (শেষ বর্ষের ছাত্রী) দুজনেই ছাত্রী হলে কোন ছেলেকে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন! অথচ হলে থাকা ছাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সেক্রেটারির উপস্থিত থাকা অবস্থায় রাত সাড়ে ১২টায় ভিপি ও প্রো-ভিপি ছাত্রী হলে প্রবেশ করেন! * বিষয়টি যদি রুম বরাদ্দের ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ হয়, তবে ভিপি ও প্রো-ভিপি কেন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ না করে রাতের আঁধারে ছাত্রীদের হলে জোরপূর্বক প্রভাব খাটাতে গেলেন? সাধারণ ছাত্রীরা কি নিজেদের ইচ্ছেমত রুম পছন্দ করে হলে ওঠেন? আমার জানামতে তো, সেটা কখনোই সম্ভব নয়। তাহলে ছাত্রীদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ কী? * পুরো ছাত্রী হলের মেয়েরা মেয়রকে ভিপি ও প্রো-ভিপির অবৈধ অনুপ্রবেশের ব্যাপারে জানালে মেয়র সাত দিনের মাঝে তদন্ত করে এর সত্যতা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। এতগুলো প্রত্যক্ষদর্শীর কথা কি তবে মিথ্যে-বানোয়াট? ভিপি ও প্রো-ভিপি তো তাদেরই মত মেডিকেলের ছাত্র।

মাত্র দু’জন ছাত্রের বিরুদ্ধে এতজন ছাত্রীর সাক্ষ্য তো শুধুই জিঘাংসার পরিচয় হতে পারে না, তাই না? ছাত্র-ছাত্রীদের দাবী- ছাত্র-ছাত্রীদের দশ দফা দাবীর ভেতরে তাদের চাওয়াটুকু খুবই সীমিত। তাদের উল্লেখযোগ্য দাবীগুলো হচ্ছে- ১. অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ২. ছাত্রী হলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা ৩. ছাত্রী হলে পুরুষ হোস্টেল সুপার-ইন-টেন্ডেন্টকে বদলে নারী সুপার-ইন-টেন্ডেন্ট নিয়োগ ৪. হোস্টেল সেক্রেটারি নূপুর পালকে অপসারণ শেষ কথা- একজনের ডাক্তারের পেশাকে মহান হিসেবে এখনো এদেশের সাধারণ মানুষেরা গণ্য করে। তাদের নিজেদের নিরাপত্তা যখন অনিশ্চিত, যখন ভয়ে ভয়ে তাদেরকে মেডিকেল কলেজ ও হলের বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয়, যখন তাদের জীবন ও সম্মানের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্যায়ন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এই লেখাটি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়। এই লেখাটি নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার প্রশ্নে লেখা। বৈধ বা অবৈধভাবে রুম দখল হোক আর যাই হোক, মেয়েদের হলে কেন ছেলেরা মাঝরাত পার করে ঢুকবে? যেখানে নিজেদের বাবা বা ভাইয়েরও প্রবেশাধিকার নেই, সেখানে কেন অন্য ছেলেরা হকিস্টিক নিয়ে ঢুকে হামলা করবে? আজকে পত্রিকার পাতায় পাতায় ধর্ষণের খবর।

আর আজ শেবাচিমের ছাত্রী হলে পুরুষদের অবোধ প্রবেশ। আজকে তারা মাঝরাত পেরিয়ে ঢুকছে, কাল যে তারা কোন নারী ধর্ষণ বা হত্যা করবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? এতই যদি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তাদের তবে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটনার সমাধান তারা করতে পারত না কি? আমরা ডাক্তার সাজিয়ার মত আর কোন ডাক্তার বা মেডিকেল ছাত্রীকে হারাতে চাই না। একটি স্বাধীন দেশের এতগুলো মেধাবী জীবন একসাথে অনিশ্চিত হতে পারে না। আমরা যেন ভুলে না যাই যে তারাই দেশের ভবিষ্যত আলো, তারা নারী, তারা আমাদের আগামী প্রজন্মের রত্নগর্ভা জননী! আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে যেন আমাদের মাথা নিচু করে বলতে না হয় যে আমরা তাদের মায়েদের সম্মান বাঁচাতে পারি নি। যদি কোনদিন বলতে হয়, তবে তা জাতি হিসেবে হবে বড় লজ্জার, ভীষণ অপমানের আর ভয়ঙ্কর আত্মগ্লানির ইতিহাস।

যারা আরো তথ্য পেতে চান তারা ঘুরে আসুন এই লিংকগুলো থেকে- http://www.amaderbarisal.com/english/285.aspx Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link http://www.sachalayatan.com/guest_writer/47626 ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।