আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগমন

এগুলো আমার লেখা। লেখাগুলো কপিরাইটেড।

জামান চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। গত কয়েকদিনের তুলনায় মিলানের তাপমাত্রা এখন কিছুটা বেড়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহ।

বছরের এই সময়ে তাপমাত্রা রাতের বেলাতেও ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এবছর ঠান্ডা যেন যেতেই চাইছে না। বাইরের তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি। জামানের ঘরের হিটার বন্ধ, জানালাও বন্ধ। এখন বাজে রাত ১২ টা ২০ মিনিট।

তার মানে একটু আগে শনিবার শেষ হয়ে রবিবার শুরু হয়েছে। অর্থাৎ আজকের দিনটা ছুটির দিন। এই সময়ে, এত তাড়াতাড়ি জামান ঘুমিয়ে আছে, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক নয়। অবশ্য অস্বাভাবিক বলাটাও পুরোপুরি ঠিক হবে না। নিয়মতান্ত্রিক জীবনে জামান অভ্যস্ত নয়।

জামানের ঘুমানোর ভঙ্গিটা অন্যরকম। সে বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমায়। বাম হাতটা থাকে বালিশের নিচে, ডানহাতে চাদর ধরে সেটা দিয়ে কান অবধি মাথাটা মুড়ে রাখে সে। জামান ঘুমিয়েছে রাত দশটার দিকে, রাতের খাবারো খায়নি। সাধারনত সে দেরী করে ঘুমাতে যায় এবং দেরি করে ঘুম থেকে উঠে।

কিন্তু, আজকের মত যেদিন তাড়াতাড়ি ঘুমায়, সেদিন সে ভোর বেলার দিকে উঠে পড়ে। জামান গভীরভাবেই ঘুমাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যেই তার ডান কানে সুড়সুড়ি লাগা শুরু করল। হাল্কা একটা শিষের মতন শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন কানে ফুঁ দিচ্ছে। জামান ডান হাত দিয়ে চাদরটা ভাল মত টেনে ধরে কান পর্যন্ত।

কিন্তু ফুঁ টা তখন চোখের দিকে এসে লাগতে থাকে। জামান এর গভীর ঘুম এ চিড় ধরে। সে নড়ে চড়ে উঠে, শোওয়া অবস্থাতেই চোখ ডলতে থাকে। ঠিক তখনই বাঁধভাঙ্গা হাসির এক রিন রিন শব্দে পুরো ঘরটা ভরে উঠে। হাসির শব্দটা জামানের পরিচিত, এটা নীলার হাসি বুঝতে পারার সাথে সাথেই জামান তড়াক করে বিছানায় শোওয়া থেকে অর্ধেক উঠে বসে।

“কি লক্ষ্মী বাবু, তোমার ঘুম ভাঙ্গল?”, নীলা হাসতে থাকে জোরে জোরে, “খুব ভালো হয়েছে, খুব খুশী হয়েছি আমি যে ঘুম ভাঙ্গাতে পেরেছি। ” নীলা আবার হাসতে থাকে। জামান ভালো মত চোখ কচলায়, আরে নীলা-ই তো, জামানের বিছানায়, মাথার কাছে বসে আছে। ওর পরনে টকটকে লাল শাড়ী, চোখে কাজল দেয়া, ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক, হাত ভরা চুড়ি। গায়ে থেকে জুঁই ফুলের গন্ধ আসছে, এই পারফিউমটা নীলা আগেও ব্যবহার করত।

হাসির শব্দ থামিয়ে নীলা চোখ গোল গোল করে বলে – “কি ব্যাপার, অত ঘুরে ঘুরে কি দেখছ?” জামান বিছানা ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় – “নীলা, তুমি এখানে?” “হ্যাঁ, এখানে, আপনার ঘরে। কেন আমার কি এখানে প্রবেশ নিষেধ?” “না তা না। কিন্তু তুমি এখানে এলে কেমন করে?” “আচ্ছা এতদিন পর দেখা হল, জিজ্ঞেস করবে তো কেমন আছি?” জামান এক মুহূর্ত ভাবে। একজন মৃত মানুষ কেমন আছে, এটা তাকে জিজ্ঞেস করা কতটুকু সমীচিন। জামান চেয়ার টেনে বসে।

সে বুঝতে পারে না সে স্বপ্ন দেখছে কিনা। জামান কোন কথা বলে না। নীলাই নীরবতা ভাঙ্গে – “আচ্ছা তুমি আর বদলালেনা, তাই না? ঘর এত অগোছালো করে রেখেছ কেন? আমি এত ফিটফাট, টিপটপ, আর তুমি যে কি না! ভাগ্যিস তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়নি, এই গোছ গাছ নিয়ে প্রতিদিনই মনে হয় আমাদের ঝগড়া লাগত, বুঝছ?” বলেই নীলা বিছানা ছেড়ে উঠে। জামানের ঘরের চেয়ারে, সোফায় আলুথালু করে রাখা জিন্সের প্যান্ট আর শার্ট ছিল – নীলা সেগুলো ভাঁজ করতে শুরু করে। ভাঁজ করতে করতে গুন গুন কি একটা গান ধরে।

জামান নীলার দিকে তাকিয়ে থাকে। এক বছর পরে দেখা, গত এক বছরে কোন সরাসরি যোগাযোগ হয়নি তাদের মধ্যে। তিন বছরের প্রেম ছিল, অতঃপর বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের ছয়মাস পরে জামান খবর পায়, নীলা আত্মহত্যা করেছে। খুব অবাক হয়েছিল জামান, খুব কষ্টও পেয়েছিল, কিন্তু অপরাধবোধ তাকে তাড়া করেনি।

দুজনের মধ্যে ম্যাচিং হচ্ছিল না, নিজের ইচ্ছাতেই নীলা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। নীলা কাপড় ভাঁজ করা শেষ করে ওয়ার্ড্রোব এ রাখা শুরু করে। জামান নিচু কন্ঠে প্রশ্ন করে, “তুমি আত্মহত্যা করলে কেন?” নীলার ওয়ার্ড্রোবে কাপড় রাখা শেষ। চেয়ারে না বসে বিছানায় বসতে বসতে বলে – “আমি যে একটা পাগল তাই। তোমার সাথে ব্রেক আপ এর পর আমার আর কোন কিছু ভাল লাগত না।

বারে বারে তোমার কথা মনে পড়ত। অনেক অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলতে, নতুন কাউকে ভালবাসতে, কিন্তু পারিনি। খালি তোমাকে মনে পড়ত, খালি তোমাকে। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে গেলে নাজকে স্বপ্নে দেখতাম। ” নাজ এর কথা জামান এর মনে পড়ে যায়।

নাজ তাদের অনাগত সন্তান। কি ছেলেমানুষী করত ওরা দু’জন, বিয়েরই কোন ঠিক নাই, মেয়ের নাম কি হবে তা পর্যন্ত ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল। জামান এর নাম থেকে ন আর জ নিয়ে নাম ঠিক করা হয়েছিল নাজ – নীলার খুব পছন্দ ছিল নামটা। নাজ শব্দের অর্থ অসম্ভব রকমের সুন্দর। সে সৌন্দর্যে নীলাকেও ছাড়িয়ে যাবে, এরকমি স্বপ্ন ছিল দুজনের।

“কিন্তু তুমিই তো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে!”, জামানের এর কন্ঠে অভিযোগ এর সুর। “হ্যাঁ, তা ছেড়েছি। তুমিও কি তা চাচ্ছিলে না?”, নীলা প্রশ্ন করে। “চাচ্ছিলাম, আমাদের ম্যাচিং হচ্ছিল না” “আর আমাদের রিলেশনটা এত বিশ্রী একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, ওটাকে টিকিয়ে রাখাও অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। দুজন মানুষ একজন আরেকজনকে ভালো না বাসতে পারলে, এক ঘরে থাকা, এক বিছানায় শোওয়াটা আশীর্বাদ না হয়ে বরং অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

” “যখন আর পারছিলেনা, তখন আবার ফিরে আসলে না কেন?” “এটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার জামান। তোমার সাথে আমি সুখী ছিলাম না, তোমাকে ছাড়াও না। তাই ভাবলাম মরে গেলেই বোধহয় সব সমস্যার সমাধান হবে। ” “সমস্যাকে মোকাবিলা করা শিখতে হয়, এড়াতে হয় না। ” বলে জামান মাথা নিচু করে।

কতবার এই কথাটা যে সে নীলাকে আগে বলেছে, তার হিসাব নেই। একটু বিরতি দিয়ে জিজ্ঞেস করে “মরতে কেমন লাগে? অনেক কষ্ট?” “হুম। তবে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপর সব শেষ”। নীলা মাথা নিচু করেছিল, সে মাথা উঁচু করলে জামান দেখতে পায় ওর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। “মৃত্যুর চেয়েও অনেক দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট তুমি আমাকে দিয়েছ, আমি তোমাকে দিয়েছি।

” কিছুক্ষন নীরবতা। জামান কথা পালটায় “কিছু খাবে?” নীলার চোখের বিষাদ দূর হয়ে দুষ্টুমি ভর করে – “তুমি রান্না করেছ?” “হুম। তেমন কিছু না। ভাত, ডাল আর ডিম এর তরকারী” “ইশ, আমার কত্ত শখ ছিল তোমাকে রান্না করে খাওয়াব। প্রতি উইকএন্ডেই নতুন নতুন আইটেম রান্না করব।

খুব ভালো একটা কাস্টার্ড রান্না শিখেছিলাম, রাশিয়ান কাস্টার্ড। বাসায় একবার ট্রাই ও করেছিলাম, তোমাকে খাওয়ানো হল না। নাজ বেচারী ও ওর আম্মুর হাতের টিফিন নিয়ে স্কুলে যেতে পারল না। ” “আমার রান্না খাবে কিনা, বললে না তো কিছু” “মৃত মানুষের খিদে নেই। মৃত মানুষের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে অতীত ভুলের আফশোষ আর না পাওয়ার বেদনা।

” জামান জানালার পর্দার দিকে তাকিয়ে বলে “পর্দার রঙ লক্ষ্য করেছ, সবুজ। তুমি চাইতে যাতে আমাদের ফ্ল্যাট এর পর্দার রঙ সবুজ হয়। ” নীলা চওড়া হাসি হেসে বলে “হয়েছে। মিথ্যা বলার কোন দরকার নাই। আমার পছন্দের পর্দার রঙ সবুজ ঠিক আছে, কিন্তু সেটা ভেবে তুমি নিশ্চয়ই সবুজ পর্দা কিননি।

আমার পছন্দকে গুরুত্ব দেবার মত সময় তোমার কখনো ছিল না। ” নীলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রশ্ন করে – “নতুন কারো প্রেমে পড়নি?” “নাহ, সেরকম কাউকে এখনো পাইনি”। নীলা জানালার কাছে চলে যায়। জানালা আগেই বন্ধ ছিল, কিন্তু পর্দাগুলো একপাশে টানা ছিল। সে পর্দাগুলো জানালার মাঝে টেনে আনতে আনতে ফিক করে হেসে একটা প্রশ্ন করে “আচ্ছা, তুমি কি মৃত মানুষকে ভয় পাও?” “মানে?” “মানে তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?” “প্রথম কিছুক্ষন পাচ্ছিলাম, কিন্তু এখন পাচ্ছি না।

” “তুমি মিথ্যা বলছ। ভয় না পেলে আমাকে একা ঘরে পেলে তুমি সাধারনত যা করতে তা করছ না কেন?” নীলার কন্ঠে পরিষ্কার দুষ্টুমি মেশানো। জামানের মনে পড়ে, নীলাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য, তাকে জড়িয়ে ধরবার জন্য কত রকমের বাহানাই না সে করত। নীলা মনে মনে জামানের এই আচরন খুব পছন্দ করত, কিন্তু বাইরে দেখাত সে খুব রাগ করেছে। মুখ গম্ভীর করে বলত “এই যে মিস্টার কাসানোভা, এইগুলা কি?” “জামান, আমার বাবু, জ্যাম, আমার কাছে আসো না” – নীলার কন্ঠে আকুলতা ঝরে পড়ে।

জামান উঠে দাঁড়ায়, নীলার দিকে আগে বাড়ে, নীলাও এগিয়ে আসে। জামান প্রথমে তার দুহাত দিয়ে নীলার চুলগুলিকে সরিয়ে দেয় কপাল থেকে – সেই পরিচিত প্রশস্ত কপাল। মা বলতেন, কপাল বড় হলে নাকি ভাগ্য ভাল হয়, নীলার ভাগ্যটা এমন হল কেন। “আমাকে আদর করোনা, ঠিক আগের মত করে, প্রথম প্রথম যেভাবে করতে” – নীলার নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে। জামান নীলার কপালের ঠিক মাঝখানে গাঢ় করে চুমু খায়, তারপর দুইহাত রাখে নীলার দুই হাতে, কবজি আর বাহু বেয়ে তা কনুই এর একটু উপরে এসে ঠেকে।

এরপর ওরা একজন আরেকজনকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখ দিয়েই পানি পড়তে থাকে। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে দুইটা শরীরই। নীলা নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলতে থাকে “আমার খুব একা লাগে জ্যাম, আমার খুব একা লাগে। ” জামান নীলার চুলগুলো সামনে টেনে এনে এলোপাথাড়ি ভাবে তার গন্ধ নিতে থাকে – “নীলু, ও নীলু, বল তুমি কি চাও আমার কাছে, বলনা কি চাও।

” “মৃত্যুর ওপারে জীবন অনেক নিঃসঙ্গ জামান, অনেক নিঃসঙ্গ। আমার নাজকে দরকার, নাজকে, আমার অনেক একা লাগে, অনেক বেশী একা …” *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** রবিবার সকালে জামানের ভিয়া জুক্কোলির ফ্ল্যাটে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। কোন এক রহস্যময় কারনে তার সমস্ত মৃতদেহটি থেকে জুঁই ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছিল। // সমাপ্ত //

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।