আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভেইল অফ ভিসর; অপরিণত বিভক্তি।

ভালোকে আমার ভয়,ভালো বেশীদিন থাকবেনা... মন্দকে আমার ভয়, কেননা আমি দুর্বল, আঘাত সইতে পারবোনা... সাফল্যকে আমার ভয়, ব্যর্থতাকেও ভয়... নিরন্তর ব্যস্ততার মহাকালে আমার করণীয় কিছুই নেই... যোগ্যের পৃথিবীতে আমি অযোগ্য, অধম... ফায়ারপ্লেসে আগুনের দাপাদাপি বেড়েই চলেছে। আগুন দেখে ভালোলাগার ব্যাপারটা কোনকালেই ছিলনা আমার। কয়লার তীব্র সুগন্ধ। আয়নায় আমার প্রতিচ্ছবি। দেখতে আমার মতো নয়।

আজ ভিন্নরকম দেখাচ্ছে আমাকে। আজকের দিনটাও অন্যদিনের মতো নয়। চেহারায় রাজ্যের অভিমান নিয়ে ও চুপ করে আছে। অন্যদিনগুলোতে ও কথা না বললে দুঃসহ ঠেকতো সব। আজ বিপরীত।

ও বেডে শুয়ে আছে। আমি তাকিয়ে আছি। ওর দিকে না, দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে, পাশেই পড়ে থাকা বোবা কান্নার আর্তির দিকে... শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে ছোট একটা কটেজে থাকি। আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা দুই। আমি, আর পাইলট।

পাইলট দুপুর পর্যন্ত একাই থাকে। অফিস থেকে ফিরে একসাথে লাঞ্চ। রোজ বিকেলে ঝরা ম্যাপেলের পাতা মাড়িয়ে ছ'টি পা হেঁটে যায় রেডস পার্কে। খুব একটা কেউ আসেনা এখানে। ঝোপঝাড়ের কাঁটাগাছগুলো পার হয়ে বেঞ্চিটাতে বসি।

চারপাশে নানা রঙের ফুল। দেখলে কে বলবে যে এদের বেড়ে উঠার পেছনে কারো যত্ন আত্তি ছিলোনা! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কিছু ফুল নিয়ে যায় ঘরে, পাইলটের জন্যে হয়না। ফুল হাত দিলেই '' ঘেউ ঘেউ" বলে প্রতিবাদ করতে থাকে। পার্কে যাবার উদ্দেশ্যটা আমার আর পাইলটের বল ছোড়াছুঁড়ি খেলার মধ্যেই আটকে থাকে। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হবার কারণটাও পাইলট।

বল ছুঁড়ে দিয়ে আনতে বললাম। গেলো, ফিরে আসলো না। একটু পরেই প্রতিবাদী পাইলটের চিৎকার - ঘেউ ঘেউ ঘেউউউ ... এগিয়ে গেলাম। কেউ ফুল ছিঁড়ছে। খোলা চুল, পরনে ছাই রঙয়ের গাউন।

বিকেলের রোদে চিকচিক করতে থাকা সোনালী চুল, ছাই রঙা গাউন, পাতার মর্মর আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুল মিলে এক অপার্থিব দৃশ্য দেখছি। অন্য একজন মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়েও সে পেছন ফিরে চাইলো না! কি নিষ্ঠুর !! জনাকীর্ণ ঝোপের রাজ্যে এই অপার সৌন্দর্যের স্রষ্টা যে রানী, তাকে সামনে থেকে দেখার সাধ আমাকে একটা মুহূর্ত বিলম্ব করতে দেয়নি। শান্ত প্রেমময় চোখ দুটো দিয়ে যেন এই বুকের পাঁজর কেটেকুটে ভেতরে সব ভরিয়ে দিচ্ছে অপরিচিত ভালোলাগায়। গালে গোলাপি আভা। চোখাচোখি হল।

সৌজন্যের হাসি হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়ে ফিরে গেল আগের অবস্থানে। কিছু বলতে পারিনি। হয়তোবা ওইদিনটা বরাদ্দ করা হয়েছিল শুধুই দেখার জন্যে। আমি, পাইলট, ম্যাপেলের পাতা আর নির্জনতার মাঝে জায়গা করে নিল একটি আবছা অবয়বের অপেক্ষা। ভাবনাতেও ছিলনা কোনদিন, এইভাবে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে পারে গোলাপি কোন গালের স্বপ্ন।

এইদিন অন্যদিনের চেয়ে আলাদাভাবে পার্কে যাওয়া শুরু। পাইলট গেলো, বল ছিল। উৎসুক চোখ আর ঠোঁটের কার্নিশে ঝুলে থাকা না টানা সিগারেটের পড়ি পড়ি ছাই নিয়ে ছাই রঙা গাউনের নড়াচড়ার অপেক্ষা ছিল। ও এসেছিল সেদিনও। ফুল কুড়ানোর উদ্যমটাকে ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা জড়িয়ে ছিল নিচু করে রাখা মুখের উপর সাঁতরে বেড়ানো পিচ্ছিল সোনালী চুলের মাঝে।

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলাম, মৃত্যুপথযাত্রী ছাইটা কখন সারা গায়ে মেখে নিলাম বুঝতে পারিনি। সে এলো, ফুল নিলো, পাইলট চিৎকার করে করে হয়রান হল, আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কথা বলার কথা মনে ছিল না। চলে যাবার পর মাথায় আসলো নামটা পর্যন্ত না জিজ্ঞেস করার মতো বোকামির সদ্য সিল লেগে যাওয়া একটা নিরেট গবেটের নির্বুদ্ধিতার কথা! একই ভুল আর না। মনের মধ্যে উথাল পাথাল, মুখে তালা এঁটে বসে থাকার মানে নেই।

নামটা তো অন্তত জানা দরকার। আচ্ছা, ওর নাম কি হতে পারে?? জেইন? ক্যাথি? লিণ্ডা ? অ্যালেক্স? পোশাকের সাথে মিলিয়ে জেইন নামে বেশ মানাবে। পিচ্ছিল সোনালী চুলের জন্যে অবশ্য ক্যাথির সমতুল্য কোন নাম নেই। গোলাপি রঙের গালটার জন্যে লিণ্ডা ভালো লাগবে। নরম হাসির স্রোতে সারাক্ষণ কাঁপতে থাকা ঠোঁট দুটোর জন্যে অ্যালেক্স হওয়াটা অস্বাভাবিক না।

কি যে পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। যেভাবে নাম দিয়ে যাচ্ছি, বেচারি না নাম সংরক্ষণে রাখতে শেষে কাঁধে পার্মানেন্টলি ট্রাভেল ব্যাগটাও লাগিয়ে রাখতে হয়। নাম দেয়ার ইস্তফা। এখন শুধুই পথ চেয়ে থাকা। আসলেই আগে নাম জানার কাজ, তারপর বাদবাকি সব।

আচ্ছা, আসবে আমি কি করে সিওর হলাম? যদি না আসে? হয়তো সকালে এসে ফুল নিয়ে গেছে এমন হতে পারে, এটাও হতে পারে যে আজ ফুল লাগবেনা। অথবা অন্যখানে ফুল আনতে যাবে, এখানে আসবেনা। এসব কথা আগে ভাবিনি কেন? না আসুক, কঠিন একটা শিক্ষা হোক আমার। সন্ন্যাস জীবন নিয়ে মগজের স্বাভাবিক পরিমাণটাও কমিয়ে ফেলছি দিনদিন। হয়তো স্বাভাবিক, হয়তো অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তাকে মুছে দিতে আবার সেই উপস্থিতি।

বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, সাথে চিৎকার করে পাইলটও। থামছেনা, চিৎকার করেই যাচ্ছে। পাইলটটার কাণ্ডজ্ঞান কমছে ভীতিজনকভাবে। শুভাকাঙ্ক্ষী সময় আর রক্ত খারাপ বোধবিবেচনাহীন পাইলট একসাথে থাকাটা অসন্তোষের এবং একইসাথে বিপদজনক। -কোয়াইট পাইলট।

পাইলট কোয়াইট। পাইলট... পাইলটটট... পার্কের নীরবতায় আমার কমান্ড চাবুকের বাড়ির মতো শপাং শপাং শব্দে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে। পাইলট সমান তালে চিৎকার করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর তালে আছে, বুঝতে দেরি হচ্ছে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি কোনটা। বিরক্ত হয়ে বলটা ছুঁড়ে মেরেই কাজ হল। পাইলট তার ঘাড়ত্যাড়া লেজ নিয়ে ছুটে চলে গেল বল খুঁজতে।

একটা স্পেস ... যেটা চেয়েছিলাম। -এক্সকিউজ মি ম্যাম, আমরা দুটো প্রাণী এখানে কথা বললে হয়তো চারদিকের চুপচাপ ভাবটা সহনীয় পর্যায়ে নামাতে পারি। আমার বক্তব্যে একটা ইঙ্গিত আছে। আছে অপরিচিতার প্রতি আহ্বান। উত্তর পেলাম না।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা চুপ করে নেই। হয়তো ঠোঁট নড়ছে নিঃশব্দে, আমি শুনতে পাচ্ছিনা। -আমার স্টার্টিং পারফর্মেন্সটা কি খুব খারাপ ছিল? ( ২য়বার আহ্বান) দুটো দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট বজ্রের মতো এঁটে থেকে ভেতরের সব কথাগুলোকে কেন আটকে রাখছে? -তোমার নামটা বলার মধ্য দিয়েও কিন্তু কাজ শুরু করতে পারি আমরা। -স্টেলা।

স্টেলা!! আমার হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক শব্দ বদলে যায়। S T E L L A প্রতিটি বর্ণের উচ্চারণে রিদম নিয়ে নাচতে থাকে সব অ্যালভিওলাস। এতক্ষণ যাকে হৃদয়হীনা ভাবগম্ভির সন্ন্যাসিনী বলে মনে হয়েছিল, তাকে পেলাম দূর কোন গ্রহের কক্ষপথ থেকে ছুটে এসে আমার জন্যে আমারই সামনে বসে থাকা অপ্সরী রূপে। এইমাত্র নড়ে উঠা ঠোঁটের কি ধারালো রং!! সম্মোহন থেকে সম্বিৎ। -দিস ইজ মার্ক।

-তুমি আমার নাম জানতে না? ছোট্ট কাশি দিলাম, টের পেয়েছে নাকি কিছু?? - না না। কি করে জানবো? তুমিতো এইমাত্র তোমার মৌনব্রত ভাঙলে। স্টেলা হাসে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া কতো নগরী ছুঁয়ে এসে আমার কানে কি যেন বলে যায় চুপিচুপি। সবকিছু অগ্রাহ্য করে আমি ওকে দেখতে থাকি, দেখার কি শেষ আছে?? বদলে যাওয়া বিকেলগুলো আমার কাছে অসম্ভব সুন্দর লাগে।

এতদিন কেন পাইনি ওকে? একটু একটু করে কতো সময় চলে গেল একাকী। ভালোবাসার কথাটা জানানো প্রয়োজন। এই বাড়ির নিঃসঙ্গতার ভুতটা কখন যে আমার ঘাড়ে ভর করে আবার কোন অনর্থ ঘটায়, কে জানে? এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে ওকে আমার চাই। কথায় কথায় জেনেছিলাম, পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। একটা অরফানেজে পালিত হয়েছে রাশ্যান মেয়ে স্টেলা।

সেখানেই এখন শিক্ষিকা হিসেবে কাটায়। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা তাকে অন্য ধাঁচের মানুষ করে তুলেছে। আবেগের উপর কঠিন নিয়ন্ত্রন, বুঝতে পারি। নিজের ভেতর তাই খুব উৎকণ্ঠা বোধ করি, যদি ফিরিয়ে দেয়, এই ভয়ে। - স্টেলা,সুন্দরভাবে বাঁচার জন্যে তোমার একটা মানুষ প্রয়োজন।

অরফানেজে বাচ্চা পড়িয়ে জীবন যাবে? -কি করতে বলো আমাকে? হাত ধরার মানুষ কোথায় মার্ক? বলতে পারো? -মার্ককে পছন্দ হয়না? দেখোইনা একটা সুযোগ দিয়ে। দেবে? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। অপদার্থ পাইলটও চীৎকার করে উঠে। আমিও বুকের কাছে টেনে নেই ওকে, ভাগ্যিস এখানে বিকেলগুলোতে প্রচণ্ড শীত পড়ে ! ! অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে পাগল হয়ে যায় স্টেলা।

অহেতুক ব্যাকুল হয়ে থাকে। পাইলট ওকে মানতে রাজি না। আমি ফেরা পর্যন্ত গেটের কাছে গিয়ে শুয়ে থাকবে, রুচিহীন একটা অকৃতজ্ঞকে পালছি আমি! চার্চে বিয়ের কাজ সেরে যেদিন প্রথম স্টেলাকে বাড়ি আনি, অভ্যর্থনার কেউ ছিলোনা। পা মুড়ে শুয়ে মুখটা বাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে পথের ধারে পড়ে ছিল পাইলটটাও, মেহমানকে পাত্তা দেবেনা, ভাব। রোমহর্ষক আনন্দ বোধ করছিলাম আমি।

নতুন করে পথ চলার শুরু। এই একলা বাড়ি, জিনিসপত্র, আমার সব কিছুর সাথে যখন ওকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলাম, অদ্ভুত নৈকট্যের স্বাদে হৃদয় ভরেছিল। তবুও কেন যেন দুরে দূরে, সারাদিন ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকে। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে ওর সংযম অবাক করে দিতো। পঁচিশ বছরের তরুণী, খাবার খায় দু'বছরের বাচ্চার মতো, অথচ নিজের হাতে এমনভাবে খাইয়ে দিতো, দুনিয়ার খবর থাকতো না আমার।

মাঝে মাঝে এতো নিজের মনে হয়, পরক্ষনেই সব ভেঙ্গে উঠে চলে যায়। এতো কাছে থেকেও কি করে দুরের মানুষ থাকে, আমি কুল পাইনা। নিস্তব্ধ বাড়িটাতে ও নিস্তব্ধতার চলমান রূপ। বিছানায় স্টেলা অসম্ভব রকমের শান্ত। নিজের ইচ্ছেতে কাছে এসেছে, এমন ঘটনা ঘটেনি কোনদিন।

অনেক ভালোবেসে আমার মতো করে নিয়ে তবেই ... কাছে ডেকেছি, ঠোঁটে চুমু দিতে গিয়েছি, অমনি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। ফাইল্যেমোফোবিয়া !! আমি জোর করিনি। ধীরে ধীরে আমার সমস্ত সত্তাকে অধিকার করে নেয় ও। ওর প্রতিটি কথা, অঙ্গভঙ্গি, চলাফেরা চোখের সামনে প্রতি মুহূর্ত দেখতে পাই। খুব একটা বৈচিত্র্য নেই ওর মধ্যে, তবুও অদ্ভুত মোহে ডুবে থাকি।

পাইলটকে হারিয়ে স্টেলা অস্বাভাবিক কান্নায় ভেঙে পড়েছিল যেদিন, আমিও কেঁদেছি। যতটা না পাইলটের জন্যে, তারচেয়ে বেশী ওর কান্নায়। যতবার ব্যালকনিতে দাড়িয়ে পাইলটের বসে থাকার জায়গাটায় রক্তের দাগ দেখেছে, ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে নির্বাক চেয়ে থেকেছে। আকস্মিক কোন দুর্ঘটনায় মানুষ শরীরের অংশ হারালে যেমন হতভম্ব হয়, তেমন করে। ওর দুর্বলতার কথা ভেবে কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি কি হয়েছিলো পাইলটের ।

আফসোস, পাইলট ওকে বুঝতে পারলো না! এই নিস্তরঙ্গ জীবনে আমাদের একটা সন্তানের প্রয়োজন ছিল। প্রথম যেদিন স্টেলার মুখ থেকে সন্তান আগমনের সংবাদ পাই, আমি চলে গিয়েছিলাম অন্য পৃথিবীতে। জানালায় দাঁড়িয়ে একটি তুলতুলে হাত আমাকে বাই বলবে। বাড়ি ফিরলে হাত ধরে ঝুলে ঝুলে পথ আটকাবে, সুখের পেলব অনুভূতি। ওদিকে স্টেলার মুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ভাব।

-মার্ক, আমার ভয় করছে। মনে হয় আমাদের আরও কিছুটা সময় নেয়া উচিত। -শুধু শুধু ভেঙ্গে পড়ছো ডার্লিং, আমার কাছে এটাই উপযুক্ত সময় মনে হচ্ছে। -আর অল্প কটা দিন সময় নেই? অ্যাবরশনটা করিয়ে............... আমি ওর মুখটা আলতো চেপে ধরি। -প্লিজ, আমাদের প্রথম সন্তান!! স্টেলা প্রতিবাদ করেনি।

সময় যতই কাছে ভিড়ছে, কিসের অজানা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে থাকে ওর মিষ্টি মুখটা। -তুমি ভয় পেয়োনা, আমি ছুটি নেবো। সব ঠিকঠাক করা আছে। দক্ষ একজন নার্স হায়ার করেছি। -কিন্তু... ওর মাথাটাকে আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখি।

অফিসে ফোন করে যখন নার্স আমার ছেলের জন্মসংবাদ দিল, বাইরে তখন প্রবল তুষারপাত। প্রাণপণে গাড়ি ছুটিয়ে আসছিলাম, ওকে দেখবো, আমার ছেলে, আমার ভালোবাসার সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধন। জমাট তুষার কাটিয়ে আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি হল। প্রথমে আমি স্টেলাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমার জন্যে এতো বড় উপহার এনেছে সে।

টুলের উপরে কিছু সাজসজ্জার সরঞ্জাম। নার্সকে দেখতে পেলাম না। ল্যাম্পের আগুনটাকে উস্কে দিচ্ছিল ও। -তুমি আমার জীবনটাকে পরিপূর্ণ করেছো। লাভ ইউ সো মাচ স্টেলা।

ও আমার বুকের কাছে সিটিয়ে থাকে। এই মানুষটা পৃথিবীর সব সুখ আমার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। ভালোবাসা আর প্রচণ্ড আবেগে আমি প্রথমবারের মতো ওর ঠোঁটের ওপর আমার ঠোঁট চেপে ধরি। কাঁচা মাংসের উৎকট গন্ধ!!!!! বৈদ্যুতিক শকের মতোই আমাকে সজোরে ধাক্কা দেয় গন্ধটা। চমকে উঠে পিছিয়ে যেতেই পায়ের নীচে শক্ত কিছুর অস্তিত্ব টের পাই।

হাড়গোড়!! ছোট মানুষের!!! নার্স কোথায়?? আমার ছেলে!! আমার ছেলে কোথায়?? অদ্ভুত অকাট্য নিখুঁত গণ্ডগোল!! একটা ষড়যন্ত্র!! গা গুলিয়ে বমি আসতে থাকে আমার। অনেক অজানাকে জেনে যাই। খাবারে অবিশ্বাস্য অনীহা! ফাইল্যেমোফোবিয়া !! পাইলটের বসার জায়গায় রক্তের দাগ!! সন্তান সম্ভবা হয়ে অ্যাবরশনের চিন্তা!! দুশ্চিন্তায় কুঁচকে থাকা কপাল!! - তুমি!! আমার ছেলে!!! আমার পাইলট!!! শূন্য দৃষ্টিতে স্টেলা তাকিয়ে থাকে। যে দুটো হাত দিয়ে ওকে বুকে টেনে নিতাম, সেই দুটো হাত আমার অজান্তে ওর গলা টিপে ধরে। প্রচণ্ড চাপে ওর চোখ দুটো বেরিয়ে আসছে।

আশ্চর্য! একটিবারের জন্যে ও আমাকে বাধা দেয়নি। খুনি ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সাদা ধবধবে ফেনা। গোলাপি গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। কপালের শিরাগুলো ফুলে উঁচু হয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্যে মায়া হল।

না, দুর্বল হলে চলবেনা। শেষ করে দেয়া চাই, আজ, এই মুহূর্তে। চোখ বুজে ওর কণ্ঠনালীতে আঙুলের চাপ বাড়াই। ফায়ারপ্লেসের আলোয় আমার ঘরটা পুরনো ধ্বংসস্তূপের মতো দেখাচ্ছে। আগুনের শিখার নাচানাচিতে যোগ দিয়েছে উড়তে থাকা পর্দাগুলো।

ওদিকটায় পড়ে আছে একটা রক্তভেজা সাদা শাড়ি, একটা বাচ্চার চুল, আর খুবলে নেয়া ছেঁড়া পায়ের পাতা। বিছানায় পড়ে থাকা নিথর স্টেলাকে অপ্সরীর মতো লাগছে দেখতে, ঠিক যেমনটা লেগেছিল প্রথমবার নিজের নামটা বলার সময়। ল্যাম্পের কাচটা খুলে নিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা পুড়তে থাকি। অসহ্য কষ্ট। খুব একা লাগছে আমার।

সব ভালোবাসা কেন এই পিশাচটাকে দিয়ে দিয়েছিলাম? পাইলট গেলো, নার্স গেলো, আমার ছেলেও গেলো। সবচেয়ে কাছে থেকেও কেন আমার কিছু হল না? স্টেলা আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসতো!!!!!!! নিজের হাতে কাজটা শেষ করার আগে একবারও ভাবলাম না কেন!!! এই একাকীত্ব আমি কিভাবে মেনে নেবো? আমার যাবার জায়গা নেই। কিছু করারও নেই। সব কাজ ফুরিয়েছে। পিশাচের বুকে জমিয়ে রাখা ভালোবাসাকে নিজ হাতে খুন করা ..হত্যা... মৃত্যু... শুদ্ধ পৃথিবী... শান্ত বাতাস... আমি একা... কেউ নেই!!!! ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।