আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমিতাভ ঘোষের সেমিনারে

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

অমিতাভ ঘোষ ঢাকা আসতেছেন এই সংবাদ তার আসার সপ্তা খানেক আগে পেয়েছিলাম। গ্লাস প্যালেস, শ্যাডো লাইনস, ইন অ্যান অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ডের অমিতাভ ঘোষ। ইনডিয়ান ইংরেজি সাহিত্যের বড় চাঁই। ঢাকার সঙ্গে তার কোনো একটা পারিবারিক যোগাযোগ আছে শুনছিলাম।

শিওর আছিলাম না। ফলে, কী কাজে তিনি ঢাকা আসতেছেন সে নিয়া একটা সংশয় মনে ছিল। তিনি বাঙালি বটে, আসতেই পারেন। ইংরেজি সাহিত্যে বিপুল সেলিব্রেশন নিয়ে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, দেলি, ক্যালকাটা করেন। লেকিন ঢাকায় কী? সংশয় দানা বাঁধার আগেই একটা ইনভাইটেশন কার্ড আসলো।

২২ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক শুক্রবার ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশে অমিতাভ ঘোষ একখানা ওয়াজ করবেন। বলা বাহুল্য, এইটাই মূল আকর্ষণ। ওয়েস্টইন হোটেলে তাকে রিসেপশন দেয়া হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের উপন্যাস থেকে পড়ে শুনাবেন, ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠানিকতায় সায় মিলিলো না। আর তাকে দাওয়াত দিয়েছে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি সেই ইন্দো-বাংলা কালচারাল ইনিশিয়েটিভ। এনারা গতবার বাংলাদেশে শ দুয়েক ইনডিয়ান লেখক-কবি-প্রকাশককে দাওয়াত দিয়ে এনে ঢাকা ঘোষণা করিয়েছিলেন।

এনাদের অস্বচ্ছ কাজকর্ম নিয়া আমি ব্লগে একাধিক পোস্ট দিয়াছিলেম। শুক্রবার অমিতাভ ঘোষকে দেখতে যাবো বলে ঠিক করলাম। সকাল সাড়ে দশটায় যথারীতি আইউবি'র ছোট ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখলাম সব প্রস্তুত। অমিতাভ ঘোষের ওয়াজের বিষয় : অফ ফনাস অ্যান্ড ফোরক্যাসলস : দি ইনডিয়ান ওশান অ্যান্ড এ লস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দি এইজ অফ সেইল। বিষয় ভিমড়ি খাওয়ার মতো।

বলাবহুল্য, শিরোনাম দেইখা কিছুই বুঝি নাই। ফলে, বোকার মতো একটা আসন নিয়া মানুষ দেখতে থাকলাম। সবার মধ্যে মি. ঘোষ মি. ঘোষ ভাব। ইংরেজি ছাড়া কেউ ভুলেও বাংলা বলতেছে না। লোকজনকে দেখে মনে হইলো, অমিতাভ ঘোষের উপন্যাস ফানা ফানা কইরা তবে আজকে সকালে আইসা উপস্থিত হইছে।

কোনো বাংলাভাষীর দেখা-সাক্ষাৎ না পেয়ে অমিতাভ ঘোষের জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হইতেছিল। কিন্তু মি. ঘোষ জেন্টেলম্যান। দেরি করেন নাই। প্রহর দীর্ঘ করে দিয়েছেন এই দিশি ইংরেজরা। একজন লেখক দেখতে যেমন তেমননি মি. ঘোষ।

লাম্বা, কিন্তু ইষৎ আনত। বুঝা যায়, অর্জিত বিনয় তাকে আনত করিয়াছে। সৌম্য, কেশ শুভ্র, কুশল বিনিময়ে বিশেষ মনোযোগী। প্রথমেই যার সঙ্গে কথা বললেন, আমি শুনলাম স্পষ্ট বাংলায় বললেন। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আসন গ্রহণের পর আইইউবির ভিসি, প্রোভিসিরা বক্তব্য দিলেন। তা থেকে জানা গেল, এই বছর থেকে আইইউবি ইংরেজি সাবজেক্ট খুলতেছে। সেইখানে তারা অমিতাভ ঘোষের একটা উপন্যাস পাঠ্য করছেন। প্লাস বাড়তি উদ্যোগ হিসেবে ইউনিভার্সিটির প্রথম প্রফেসর ইন রেসিডেন্স হিসেবে ড. ঘোষকে তারা সম্মানিত করতেছেন। ড. ঘোষ সদয় সম্মতি দিয়ে শুধু আইইউবি-ই নয়, আমাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।

ভাল লাগতে শুরু করলো। অমিতাভ ঘোষের বক্তৃতা যথারীতি ইংরেজিতেই। তবে অন্য বক্তাদের চাইতে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে, বুঝতে বিশেষ ক্লেশ পাইতে হইলো না। যতটুকু বুঝি নাই ততোটুকু স্রেফ বিষয় সম্পর্কে আমার সীমাহীন অজ্ঞানতার কারণেই বুঝি নাই।

প্রথমেই তিনি বললেন, ঢাকায় একটি ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে আসতে পেরে তিনি আনন্দিত। যদি তার মা-বাবা তাকে এভাবে এখানে বক্তৃতা দিতে দেখতেন তবে খুব খুশী হতেন। কারণ তারা দুজনেই বাংলাদেশের মানুষ। একজন ফরিদপুরের অন্যজন মানিকগঞ্জের। (জায়গার নাম ঠিক শুনেছি তো?) অমিতাভ নিজেও ঢাকায় থেকেছেন।

(তার শ্যাডো লাইনস উপন্যাসে ঢাকার কথা আছে। সেখানে ন্যারেটরের ঠাম্মা ঢাকায় তার পুরানা বাড়িতে যান। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর সেখানে, সেই পাকিস্তানে তার কাকু থেকে যান। ঢাকায় তিনি যান কাকুকে ফিরিয়ে ইনডিয়ায় আনতে। ) অমিতাভ বললেন, তিনি সব দিক বিচার করেই একজন বাংলাদেশী।

কথাটা শোনার পর, একটা গভীর বেদনা ও ভালো লাগা আমাকে আপ্লুত করে তুললো। বুঝলাম, অমিতাভ শুধু আইইউবি আর কালচারাল ইনিশিয়েটিভের নিমন্ত্রণে আসেননি। তার থেকে বড় নিমন্ত্রণ মাটি তাকে জানিয়েছে। আপ্লুত হবার আরো কিছু কারণ সামনে ছিল। অমিতাভ বক্তৃতা শুরু করলেন, লন্ডনের ম্যারিটাইম মিউজিয়ামে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে।

তার নতুন বইয়ের খবর কিছুদিন ধরে পড়ছিলাম। বইটার নাম সি অফ পপিজ। পপির সাগর। পপি হইতেই আফিম প্রস্তুত হয়। আফিম ওয়ারের আগের কাহিনী।

বইটা বের হবে এবছরের জুনে। বক্তৃতার বিষয় আর উপন্যাসের বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত। অমিতাভের অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এ উপন্যাসটিও বিপুল গবেষণা, অধ্যাবসায় ও কল্পনার ফসল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ম্যারিটাইম মিউজিয়ামে কোনো এক জাহাজের লগ বুক দেখে অমিতাভ বিস্মত হয়ে যান। মিউজিয়ামের নাম, জাহাজের নাম আপাতত ভুইলা বসছি।

দেখেন সেখানে লস্কর, সারেং, নাবিক হিসেবে যাদের নাম আছে তাদের অধিকাংশই বাংলার সমুদ্রবর্তী অঞ্চলের। দক্ষিণ ভারত চীন ইত্যাদি ইলাকার লোকও সেইখানে শামিল। কিন্তু এই ইলাকার লোক বেশি। তিনি খুঝতে খুজতে পেয়ে যান আরও বহু তথ্য। উনিশ শতকে ইংল্যান্ড ও ভারত, চীনের মধ্যকার বাণিজ্যের মূল মাধ্যম ছিল জাহাজ।

সেই জাহাজের মুখ্য শক্তি ছিল এই লস্কর, সারেং, নাবিকেরা। যাদের আবার বড় অংশ গিয়েছিল বাংলা থেকে। পুরো উনিশ শতক জুড়ে, তার আগে পরে এই বিপুল বাণিজ্যে প্রধান কাণ্ডারীরা কিন্তু ইতিহাসের গতিপথে হারাইয়া যান। সমুদ্র অভিযান নিয়া এত উপন্যাস কল্পকথা গবেষণার মধ্যেও আর তাদের দেখা মিলে না। কিন্তু তাদের ভাষা থাকিয়া যায়।

সে ভাষাও লুপ্তপ্রায়। এই যে ভারতীয়, বাঙালি আর ইংরেজরা মিলে যে সমুদ্র বাণিজ্যের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন, তাতে পরস্পরের যোগাযোগের জন্য একটি ভাষা তৈরি হইছিল। সমুদ্রের সেই ভাষা ছিল কাজের সম্পর্কের ভাষা। তখন যে কেহ ক্যাডেট হিসোবে নিয়োগ পাইতো তাকে সেই ভাষা আয়ত্ত করতে হতো। সমুদ্র ব্যবসায়ীদের সে ভাষা আয়ত্ত করতে হতো।

সে ভাষায় নাম ছিল লস্করী ভাষা। মানে হিন্দুস্তানী সামুদ্রিক ভাষা। উনিশ শতকে লস্করী-ইংরেজি ডিক্সেনারি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। পরে লন্ডন থেকে বের হয়। নতুন করে প্রকাশিত কিছু সংস্করণও নাকি পাওয়া যায়।

এই ভাষায় প্রচুর ভারতীয় ভাষার আলামত আছে। বাংলার বহু শব্দ আছে। বিভিন্ন বাংলা শব্দ সরাসরি ম্যারিটাইম ডিক্সেনারিতে আত্মস্থ হয়ে গিয়েছে। মি. ঘোষ অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। বিশেষ মনে নাই।

তবে খুঁজলে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে জাহাজের অনেক বিষয়ই বাংলা থেকে গিয়েছে। মিশেছে ফার্সি, পুর্তগিজ শব্দও। শব্দ ট্রেক করে করে অমিতাভ আমাদের শোনালেন সেই লুপ্ত ভাষা সমুদ্র অর্থাৎ সেই লুপ্ত সমুদ্রের ভাষার কথা। প্রত্যেকটা শব্দ তিনি বলছিলেন আর আমরা বিমোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম এর অন্তর্গত তাৎপর্য অনুমান করে।

(এ বিষয়ে বেশি বললে ভুল বলা হয়ে যেতে পারে। কারণ শুধু কানই আমার সঙ্গে ছিল। রেকর্ড করতে পারি নাই। ) সেমিনার শেষে মি. ঘোষের সঙ্গে ভক্তরা ফটোসেশন করছিলেন। আর আমরা চা খেতে খেতে তাকে দূর থেকে দেখছিলাম।

ওনাকে কেউ চা সাধছিলেন না। ফলে শেষ দিকে উনি একাই হেঁটে চা পর্যন্ত এলেন। তখন অবশ্য চা শেষ। কিন্তু চা-ই তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ বানিয়ে দিল। কয়েকজন দিশি ইংরেজকে টপকিয়ে আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপনার বক্তব্যটা খুব ভাল লাগালো।

এতো আস্ত একটা হারানো ভাষা। আর এটা গড়ে উঠেছিল কাজের ভাষা হিসেবে। অনেকটা যেভাবে উর্দু ভাষা গড়ে উঠেছিল। উনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, সারেং লস্কর নিয়ে আমাদের এখানে কিছু কাজ হয়েছে।

বিশেষ করে সেলিম আল দীনের হাত-হদাই। ওনার পাশের লোকগুলো একটু অস্থির হয়ে উঠলো আমার কথায়। বললাম, আপনার বক্তৃতাটা কি আমরা পেতে পারি? বললেন, এখনও খসড়া অবস্থায় আছে। চূড়ান্ত হলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আমি বললাম, আপনার ওয়েবসাইট থেকেই পেয়ে যাবো হয়তো।

টুটাফাটা এইরকম আরও কিছু কথা বলে সটকে পড়লাম।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৮ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।